কেনারাম ভট্টাচার্য (সেবাইত)
বাংলা ভাষায় মহাকাব্য মহাভারতের রচয়িতা মহাকবি কাশীরাম দাসের জন্মভূমি এই সিঙ্গি গ্রাম। সিঙ্গি বর্তমানে পূর্ব বর্ধমান জেলার কাটোয়া ২ নং ব্লকের অধীন একটি বর্ধিষ্ণু গ্রাম। গ্রামটি প্রায় বর্গাকার বলা যায় – পূর্ব, পশ্চিম, উত্তর, দক্ষিণ – সব দিকেই দৈর্ঘ্যে ১ কিমি। জনসংখ্যা প্রায় ৬ হাজার। গ্রামে বহু দেবদেবীর মূর্তি ও মন্দির আছে। সেই সব দেবদেবী ও মন্দিরকে ঘিরে নানা পূজা-উৎসব হয়। কিন্তু এর মধ্যে সব চেয়ে প্রাচীন ও ঐতিহ্যশালী দেবী হল ভট্টাচার্য বংশের ‘মঠের বাড়ির দুর্গাপূজা’। কিন্তু এই দুর্গাপূজা কতটা প্রাচীন সঠিক জানা যায় না। তবে মনে করা হয় এই পূজা সাড়ে তিনশো বছরেরও বেশি পুরোনো। তবে কাটোয়া মহকুমায় যে ক’টি প্রাচীন দুর্গাপূজা আছে তার মধ্যে ‘মঠের বাড়ির দুর্গাপূজা’ যে অগ্রগণ্য তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
দুর্গাপূজার শুরুর কাহিনি
কথিত আছে, এক সময়ে বর্ধমান রাজবাড়িতে সিঙ্গি গ্রামের ভট্টাচার্যদের কোনো এক পূর্বপুরুষ কুলপুরোহিত ছিলেন। তিনি জ্যোতিষশাস্ত্রে সুপণ্ডিত ছিলেন। কোনো এক সময়ে তিনি পাঁজিতে উল্লিখিত সূর্যগ্রহণের সময় মিথ্যা প্রমাণ করে তাঁর গণনার সময়কে অভ্রান্ত প্রমাণ করেছিলেন। তাই সিঙ্গির ভট্টাচার্য বংশকে ‘সুয্যিপুরের বংশ’ বলা হয়।
যাই হোক, কুলপুরোহিত ভট্টাচার্য মহাশয়কে বর্ধমানরাজ অত্যন্ত ভক্তিশ্রদ্ধা করতেন। এই পুরোহিত প্রতি বছর রাজবাড়ির দুর্গাপূজাও করতেন। ক্রমে তাঁর বয়স বাড়ল। তাঁর পক্ষে আর দুর্গাপূজা ও কুলপুরোহিতের কাজ করা সম্ভব হচ্ছিল না। তাই তিনি একদিন রাজাকে জানালেন, তাঁর বয়স হয়েছে। তাঁর পক্ষে আর এই গুরু দায়িত্ব পালন করা সম্ভব হচ্ছে না। তিনি ছুটির আবেদন জানালেন। তাঁর ইচ্ছা, এ বার নিজের গ্রাম সিঙ্গিতে ফিরে গিয়ে পরিবারের অন্যদের সঙ্গে জীবনের বাকি দিনগুলো কাটাবেন
কুলপুরোহিতের আর্জি শুনে মহারাজ খুবই দুঃখ পেলেন। কিন্তু তিনি ছিলেন দানবীর। তিনি পণ্ডিতমশাইকে জানালেন, তিনি তাঁর রাজ্যের অধীনে ইন্দ্রাণী পরগণায় ৪০০ বিঘা নিষ্কর সম্পত্তি তাঁকে দান করবেন। এবং কিছু নগদ টাকাও দেবেন। তাঁর ইচ্ছা, কুলপুরোহিত সিঙ্গি গ্রামে ফিরে গিয়ে একটি মন্দির প্রতিষ্ঠা করে দুর্গাপূজা শুরু করুন। নিজের পরিবার এবং রাজ্যের কল্যাণের জন্যই তিনি এই ব্যবস্থা করছেন বলে জানালেন। এর পরেই স্থাপিত হল মঠের বাড়ির মন্দির এবং শুরু হল দুর্গাপূজা। সেই পূজাই আজও হয়ে আসছে।
‘মঠের বাড়ির দুর্গাপূজা’র বৈশিষ্ট্য
দেবী অত্যন্ত জাগ্রতা। সিঙ্গি ও পার্শ্ববর্তী গ্রামের লোকেরা মঠের মাকে অত্যন্ত ভক্তিশ্রদ্ধা করেন এবং মঠের বাড়ির নিয়ম মেনে গ্রামের অন্যান্য দুর্গাপূজা চালিত হয়। বর্তমানে গ্রামে চারটি পারিবারিক পূজা এবং ১৪টির মতো সর্বজনীন পূজা হয়। একমাত্র মঠের বাড়ির দুর্গাপূজায় কৃষ্ণানবমী তিথিতে ধুমধাম করে বাদ্যিবাজনা সহকারে দেবীর ঘট আনা হয় এবং সে দিন ছাগবলি ও নানা প্রকার ভোগ-অন্ন দিয়ে দেবীর পূজা শুরু হয়। ১২ দিন ধরে একটি নির্দিষ্ট ঘরে দু’ বেলা পূজা হয়।
এর পর শুক্লাসপ্তমী তিথিতে নবপত্রিকা স্নানের মধ্য দিয়ে কলাবউকে নিয়ে আসা হয় এবং মূল মন্দিরে মায়ের পূজা শুরু হয়। সপ্তমী, অষ্টমী, মহাসন্ধি ও নবমী তিথিতে শাস্ত্র মেনে পূজা হয় ও প্রতি দিন একটি করে ছাগ বলি হয়। সন্ধিপূজার দিন ছাগবলির ২ মিনিট আগে ঢাক ও বাজনা বাজিয়ে বহু দূর থেকে ঢাকি আসেন এবং একটি থ্রিলিং আবহাওয়া তৈরি হয়। বলিকাষ্ঠের কাছে পাটকাঠির মশাল জ্বালানো হয়। বহু গ্রামের লোক এই মুহূর্তটি দেখার জন্য ভিড় করেন.
মঠের বাড়ির সন্ধিপূজার বলিদানের পর অন্যান্য জায়গায় বলিদান হয়। আগে দোনলা বন্দুক ফায়ারিং করে পার্শ্ববর্তী মালঞ্চ, ছোটো মেইগাছি গ্রামের পূজা কমিটিকে সন্ধিপূজা বলিদান শুরু করার সংকেত দেওয়া হত। এখন অবশ্য সকলে ঘড়ি ধরে বলিদান সম্পন্ন করেন।
প্রতি দিন বলিদানের পর সেই ছাগমাংস রান্না করে মঠের বাড়ির মাকে ভোগের সঙ্গে দেওয়া হয়। এটি মঠের বাড়ির দুর্গাপূজার বিশেষ বৈশিষ্ট্য.
আর একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হল মঠের বাড়ির দুর্গাপূজার পুরোহিত সেবাইতদের মধ্য থেকেই নির্বাচিত হন। অন্য কোনো পুরোহিত পূজা করতে পারেন না। এই নিয়ম পূজার সূচনা থেকেই চলে আসছে।
দুর্গাপূজার নবমীর দিন ভট্টাচার্য বংশের সকল সেবাইত ও তাঁদের পরিবার-পরিজন মায়ের মন্দিরে একত্রিত হয়ে আনন্দ করে পংক্তিভোজন করেন। দশমীর দিন আনুমানিক ১০০ জন সেবাইত মাকে পুষ্পাঞ্জলি দেন এবং মেয়েরা সিঁদুরখেলায় মাতেন। দশমীর বিকেলে বাদ্যিবাজনা সহকারে গোটা গ্রাম প্রদক্ষিণ করে মঠের মাকে নির্দিষ্ট পুকুরে বিসর্জন দিয়ে সকলে কোলাকুলি করেন এবং শুরু হয় বিজয়ার প্রণাম। আর সবাই প্রার্থনা করেন, ‘মাগো সামনের বছর আবার এসো।’
কী ভাবে যাবেন
কলকাতা থেকে সিঙ্গি পৌঁছোনোর অনেক উপায় আছে।
ট্রেনপথে – হাওড়া বা শিয়ালদা স্টেশন থেকে কাটোয়া লাইনের যে কোনো ট্রেন ধরে কাটোয়ার তিনটে স্টেশন আগে পাটুলি স্টেশনে (শুধুমাত্র লোকাল ট্রেন থামে, মেল/এক্সপ্রেসে এলে কাটোয়া জংশনে নামতে হয়) নেমে শেয়ারে ম্যাজিক/অটো/টোটোয় চড়ে আসতে পারেন, ভাড়া: জনপ্রতি ১৫/২০ টাকা। হাওড়া থেকে লোকাল ট্রেনে পাটুলি স্টেশন পৌঁছোতে সময় লাগে পৌনে তিন ঘন্টা।
সড়কপথে – গাড়িতে দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে ধরে মেমারি, সেখান থেকে সাতগাছিয়া, মন্তেশ্বর, মালডাঙা, মেঝিরি, সিঙ্গির মোড় হয়ে সিঙ্গি। কলকাতার এসপ্ল্যানেড থেকে এ পথে দূরত্ব ১৩৬ কিমির মতো। সময় লাগে মোটামুটি ৩ ঘন্টা।
কোথায় থাকবেন
সিঙ্গিতে থাকার জন্য রয়েছে শান্তিনিকেতন হোমস্টে। যোগাযোগ করুন Travelism-এর সঙ্গে: ৮২৭৬০০৮১৮৯/৯৯০৩৭৬৩২৯৬।
আরও পড়তে পারেন
দুর্গাপার্বণ: আজও ভিয়েন বসিয়ে হরেক রকম মিষ্টি তৈরি হয় চুঁচড়ার আঢ্যবাড়ির দুর্গাপুজোয়
দুর্গাপার্বণ: দশমীতে মাছপোড়া খেয়ে নিয়ম ভঙ্গ করে পশ্চিম বর্ধমানের খান্দরার সরকার পরিবার
ভুটান খুলল, কিন্তু রাত্রিবাসে বাড়তি টাকার চাপ পর্যটকরা নিতে পারবেন তো?