দুর্গাপার্বণ: আজও ভিয়েন বসিয়ে হরেক রকম মিষ্টি তৈরি হয় চুঁচড়ার আঢ্যবাড়ির দুর্গাপুজোয়

নিজস্ব প্রতিনিধি: পশ্চিমবঙ্গের বনেদিবাড়ির পুজোগুলোয় নানা বৈচিত্র্য, নানা বৈশিষ্ট্য। কোথাও দেবী দশভুজা, কোথাও বা দ্বিভুজা। কোথাও তিনি মহিষাসুরদলনী আবার কোথাও শিবনন্দনী।

এমনই এক বনেদি বাড়ি হল হুগলি জেলার চুঁচড়ায় আঢ্য পরিবারের পুজো। এই বছর তাঁদের পুজো ২৮৮তম বর্ষে পড়তে চলেছে। চুঁচড়ার কামারপাড়ায় দেশবন্ধু মেমোরিয়াল স্কুলের স্টপেজের কাছেই এই আঢ্যবাড়ি।

এই বাড়িরই সপ্তমপুরুষ শংকর আঢ্য মহাশয়ের সঙ্গে কথা বলে এই বনেদি পরিবার সম্পর্কে অনেক কিছু জানা গেল। তিনি জানান, আঢ্যবাড়ির পূর্বপুরুষরা আদিসপ্তগ্রাম থেকে এসেছিলেন চুঁচড়ায় এবং এখানে এসে বসতি স্থাপন করেন। এই আঢ্য পরিবার মূলত ব্যবসায়ী পরিবার হলেও এই পরিবারের যোগীন্দ্রলাল আঢ্য ওরফে জগু মাস্টার ছিলেন হুগলির স্টেশনমাস্টার। পরবর্তী কালে উচ্চারণ বিভ্রাটে জগু মাস্টার হয়ে যান যদু মাস্টার এবং লোকমুখে প্রচলিত ছড়াও সৃষ্টি হয় – ‘আইকম বাইকম তাড়াতাড়ি, যদু মাস্টার শ্বশুরবাড়ি…।’

এই আঢ্য পরিবারের প্রাণপুরুষ ছিলেন বদনচন্দ্র আঢ্য মহাশয়, যিনি হুগলির আঢ্যবাড়িতে দুর্গাপুজো শুরু করেন। বর্তমানে পরিবারের উত্তরসূরিরা নিষ্ঠা সহকারে পুজো করে আসছেন।

আঢ্যবাড়ির দুর্গাপুজোর সূচনা হয় রথযাত্রার দিন কাঠামোপুজোর মাধ্যমে। চুঁচড়ার আঢ্যবাড়ির মৃন্ময়ীকে যাঁরা রূপদান করেন তাঁরা বংশপরম্পরায় সেই কাজ করে চলেছেন। তাঁরা আঢ্যবাড়িতে এসে প্রতিমা গড়েন। শুধুমাত্র প্রতিমাশিল্পীই নন, এই বাড়ির পুজোর সঙ্গে যুক্ত পুরোহিত, ভিয়েনের ঠাকুররাও বংশপরম্পরায় কাজ করে আসছেন। তাঁরাও পুজোর সময় এই বাড়িতে চলে আসেন।

আঢ্যবাড়ির দুর্গাদালান।

আঢ্যবাড়িতে দেবী শিবদুর্গা রূপে পূজিতা অর্থাৎ তিনি শিবক্রোড়ে অধিষ্ঠিতা এবং তাঁর দুই হাত। এক হাতে তিনি বরদাত্রী এবং অপর হাতে তিনি অভয়দায়িনী রূপে বিরাজিতা। সঙ্গে রয়েছেন লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক ও গণেশ অর্থাৎ সপরিবার তিনি বিরাজ করেন আঢ্যবাড়ির পুজোর দালানে। এই বাড়ির বিগ্রহের সাজসজ্জা হয় শোলা ও রাংতা দিয়ে নির্মিত ডাকের সাজে এবং পারিবারিক প্রাচীন স্বর্ণালংকারে দেবীকে সাজিয়ে তোলা হয়।

এই বাড়িতে একটি রীতি এখনও পালন করা হয়। তা হল দুর্গাপুজোর সাত দিন আগে থেকে ভিয়েন বসে। সেখানে তৈরি হয় নানান রকমের মিষ্টান্ন, যেমন প্যারাকী, মিষ্টিগজা, নারকেল নাড়ু, মুগের নাড়ু, সুজির নাড়, বোঁদের নাড়ু ইত্যাদি।

আঢ্যবাড়িতে দেবীর বোধন শুরু হয় মহালয়ার পরের দিন অর্থাৎ প্রতিপদ তিথিতে। সেই দিন থেকেই বাড়িতে চণ্ডীপাঠ শুরু হয়, যে রীতি আজও অব্যহত রয়েছে। সপ্তমীর দিন সকালে কলাবউ স্নান হয় ষাণ্ডেশ্বর তলার ঘাটে, তার পর দেবীর পুজো শুরু হয়। সম্পূর্ণ বৈষ্ণবমতে পুজো হয় এই আঢ্যবাড়িতে। এখানে মন্ত্রে বলিদান হলেও কোনো দিন এই পরিবারে বলিদানপ্রথা ছিল না বলেই উল্লেখ করেন শঙ্করবাবু।

দুর্গাপুজোর মহাষ্টমীর দিন এই বাড়িতে এক মণ আতপচালের নৈবেদ্য দেওয়া হয়। তার সঙ্গে থাকে বিভিন্ন রকমের ফল, মিষ্টি ইত্যাদি। এই বাড়িতে অন্নভোগের রীতি না থাকলেও দেবীকে লুচি, রাধাবল্লভী দেওয়া হয়। সাথে থাকে নানান রকমের ভাজা, হালুয়া, ক্ষীর, জিবেগজা, পদ্ম নিমকি ইত্যাদি নানান রকমের পদ।

অতীতে দুর্গাপুজোর মহাষ্টমীর সন্ধিপূজার সময় বন্দুক দাগানো হত, বর্তমানে সেই প্রথা বন্ধ রয়েছে। আঢ্যবাড়িতে নবমীর দিন হয় কুমারীপুজো এবং হোম-যজ্ঞ।

দুর্গাপুজোর দশমীর দিন দর্পণে প্রতিমা বিসর্জন হওয়ার পর পরিবারের বিবাহিত মহিলারা মাছ-ভাত খান – এই প্রথাই চলে আসছে পরিবারে। তার পর হয় দেবীবরণ এবং কনকাঞ্জলিপ্রথা, অর্থাৎ বাড়ির মেয়ে শ্বশুরবাড়িতে যাচ্ছে বলে তার জন্য কনকাঞ্জলি দেওয়া হয়। তার পর কাঁধে চেপে বিসর্জনের পথে রওনা হন আঢ্যবাড়ির শিবদুর্গা। বিসর্জনের শেষে পরিবারের সদস্যরা ঠাকুরদালানে এসে শান্তিজল গ্রহণ করেন এবং সকলকে মিষ্টিমুখ করানো হয়।

কী ভাবে যাবেন?

হাওড়া থেকে লোকাল ট্রেনে পৌঁছে যান চুঁচুড়া। স্টেশন থেকে অটো, রিকশা বা টাউন সার্ভিসের বাসে পৌঁছে যান কামারপাড়ার দেশবন্ধু মেমোরিয়াল স্কুলের স্টপেজ। সেখানে কাউকে জিজ্ঞেস করলেই আঢ্যবাড়ির ঠিকানা পেয়ে যাবেন।

আরও পড়তে পারেন

পুজোয় সারা রাত চলবে মেট্রো, জেনে নিন সময়সূচি

তিন দিনের মধ্যে বর্ষা বিদায় শুরু, পুজোয় উত্তর ভারতে দুুর্দান্ত আবহাওয়া থাকার সম্ভাবনা

এ বার পুজোয় ঠাকুর দেখুন পরিবহণ দফতরের বিশেষ প্যাকেজে

গ্রামবাংলায় আনন্দময়ীর আগমনবার্তা নিয়ে এল ভাদ্র-সংক্রান্তির ‘অরন্ধন’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *