নতুন বছরের শুরুতে কাশীরাম দাস স্মরণোৎসব ও মেলা, এই সুযোগে ঘুরে আসুন সিঙ্গি

ভ্রমণ অনলাইনডেস্ক: মহাভারতকে বাঙালির কাছে যিনি আপন করে তুলেছিলেন, তাঁকে আমরা অনেকেই হয়তো ভুলতে বসেছি। কিন্তু ভোলেনি তাঁর জন্মভিটে পূর্ব বর্ধমানের সিঙ্গি। তিনি মহাকবি কাশীরাম দাস।

সঠিক পরিসংখ্যান না পাওয়া গেলেও মনে করা হয় যে ১৫৪৪ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ কাশীরাম দাস এই সিঙ্গি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। মহাকবিকে স্মরণ করেই সিঙ্গি গ্রামে উৎসব বসতে চলেছে। তার নাম দেওয়া হয়েছে ‘মহাকবি কাশীরাম দাস স্মরণোৎসব উদযাপন ও কাশীরাম দাস মেলা ২০২৩।’

এ বারের এই উৎসব ৬১তম বর্ষে পড়ল। আগামী ৬ জানুয়ারি সন্ধ্যা সাতটায় এই উৎসবের উদ্বোধন করবেন কাটোয়ার বিধায়ক রবীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়। তবে ওই দিন সকাল ন’টায় একটি শোভাযাত্রার মধ্যে দিয়ে উৎসব শুরু হয়ে যাবে। ওই শোভাযাত্রাটি গোটা গ্রাম প্রদক্ষিণ করবে।

এই উৎসব ও মেলা চলবে ১০ জানুয়ারি পর্যন্ত। নানা রকম প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়েছে এই উৎসবে। সব মিলিয়ে পাঁচটা দিন আনন্দে মেতে উঠবে গোটা সিঙ্গি গ্রাম।

এই উৎসবের শরিক হতে পারেন আপনিও। গ্রাম্য মেলার দেখার পাশাপাশি সিঙ্গি এবং তার আশেপাশের জায়গাগুলিও ঘুরে নিতে পারেন। সিঙ্গিতে দু’-তিনটে দিন অনায়াসে থাকতে পারেন।

কী দেখবেন

(১) কাশীরাম দাসের বসতবাটী – সিঙ্গি গ্রামেই। বাড়ির ভগ্ন দশা হলেও এখানে একটি ছোট্ট পাতালঘর আছে। শোনা যায়, কবি এখানে তাঁর পাণ্ডুলিপি নিয়ে প্রায়ই আত্মগোপন করতেন।

(২) ক্ষেত্রপাল ঠাকুরের থান – সিঙ্গি গ্রামেই। কোনো বিগ্রহ নেই। অতি প্রাচীন একটি বটগাছকে পূজা করা হয়। গ্রামের প্রান্তিক দেবতা।

(৩) শ্রীবাটী গ্রাম – সিঙ্গি থেকে ২ কিমি, এখানকার তিনটি অসাধারণ টেরাকোটার কারুকার্যসমৃদ্ধ মন্দির আপনার অপেক্ষায় আছে।

(৪) ক্ষীরগ্রাম – সিঙ্গি থেকে ১৮ কিমি, যোগাদ্যা সতীপীঠের জন্য বিখ্যাত, যে গ্রামকে স্মরণীয় করে রেখেছেন ছন্দের জাদুকর সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত তাঁর ‘যোগাদ্যা বন্দনা’য়। গ্রামে ঢুকতেই হাজার বিঘের ক্ষীরদিঘি, যেখানে পড়েছিল সতীর ডান পায়ের আঙুল। রয়েছে যোগাদ্যার মন্দির, অনুচ্চ টিলার টঙে দেবীর ভৈরব ক্ষীরকণ্ঠ শিবের মন্দির।

(৫) মুশারু-সহ চার গ্রাম – সিঙ্গি থেকে ২৬ কিমি, ক্ষীরগ্রাম থেকে ১২ কিমি। চলুন ঝাংলাই কেউটে সাপের গ্রাম মুশারু, ছোট পোষলা, বড়ো পোষলা এবং পলসোনায়। নিজের চোখে দেখবেন বিষধর সাপের সঙ্গে ওই চার গ্রামের বাসিন্দাদের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান।

(৬) ওরগ্রাম – সিঙ্গি থেকে ৫১ কিমি, মুশারু থেকে ৩০ কিমি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে তৈরি এক গোপন বিমানবন্দর দেখতে হলে চলুন ওরগ্রামের জঙ্গলে। রয়েছে কফি গাছের জঙ্গল।     

(৭) জগদানন্দপুর – সিঙ্গি থেকে ১২ কিমি, পুরাতত্ত্বে আগ্রহ থাকলে জগদানন্দপুরের রাধাগোবিন্দ জিউর মন্দির দেখতেই হবে, অসাধারণ সুন্দর পাথরের মন্দির। ১৮৩৯ খ্রিস্টাব্দে তৈরি, ৮২ ফুট উঁচু দ্বিতল পঞ্চচূড়া মন্দির।

(৮) নতুনগ্রাম – সিঙ্গি থেকে ১৫ কিমি, জগদানন্দপুর থেকে ৬ কিমি। কাঠের প্যাঁচা শিল্পীদের গ্রাম, দেখে আসুন কী ভাবে অত্যন্ত স্বল্প সময়ে তৈরি হয়ে যাচ্ছে এই অনবদ্য হস্তশিল্প।

(৯) দাঁইহাট – সিঙ্গি থেকে ১৪ কিমি, জগদানন্দপুর থেকে ৫ কিমি। ২৮০ বছরের পুরোনো, ‘মরাঠা দস্যু’ ভাস্কর পণ্ডিতের দুর্গাবাড়ি। প্রায় ধ্বংস হওয়ার মুখে এই ঐতিহাসিক স্থান।

(১০) কাটোয়া – দাঁইহাট থেকে ১০ কিমি, সিঙ্গি থেকে ১৯ কিমি, ঐতিহাসিক শহর। নিমাইয়ের দীক্ষাস্থল গৌরাঙ্গবাড়িতে দেখে নিন নিমাইয়ের মস্তক মুণ্ডনের স্থান, পাশেই সন্ন্যাসগ্রহণ ও শ্রীকৃষ্ণচৈতন্যগিরি তথা শ্রীচৈতন্য নামগ্রহণের স্থান, কেশব ভারতীর সমাধি, মব্দিরে গৌর-নিতাইয়ের বিগ্রহ। কাটোয়ায় আরও দেখুন জগাই-মাধাইয়ের অন্যতম মাধাইয়ের নামে মাধাইতলা; বাগানপাড়ায় ৩০০ বছরের শাহি মসজিদ, সাহেববাগানে উইলিয়াম কেরির দ্বিতীয় পুত্র জুনিয়ার উইলিয়ামের সমাধি। কাছেই ভাগীরথী ও অজয়ের সঙ্গম।

(১১) কেতুগ্রাম – সিঙ্গি থেকে ৩৪ কিমি, কাটোয়া থেকে ১৬ কিমি। বহুলা সতীপীঠ, দেবীর বাম বাহু পড়েছিল এখানে।

(১২) নিরোল – সিঙ্গি থেকে ৪২ কিমি, কেতুগ্রাম থেকে ৮ কিমি। ঈশানী নদীর পাড়ে অট্টহাস সতীপীঠ। দেবীর ওষ্ঠ তথা ঠোঁট পড়ে এখানে। সেই থেকে নাম ওষ্ঠহাস, সেখান থেকে অট্টহাস। এক নিরালা তপোবন, দেবীর কোনো মূর্তি নেই, ঘটে পুজো। রয়েছেন দেবীর ভৈরব বিশ্বেশ্বর শিব, পঞ্চমুণ্ডির আসনে রটন্তী কালী।  

(১৩) উদ্ধারণপুর – সিঙ্গি থেকে ৪৬ কিমি, কাটোয়া থেকে ২৩ কিমি, কেতুগ্রাম থেকে ১২ কিমি। সাধক সাহিত্যিক অবধূত যে স্থানকে অমর করে রেখেছেন তাঁর ‘উদ্ধারণপুরের ঘাট’-এ, সেই উদ্ধারণপুর ভাগীরথীর পশ্চিম পাড়ে। বাঁধানো ঘাটের পাশেই নৈহাটির রাজার দেওয়ান দিবাকর দত্ত, পরবর্তী কালে নিতাইয়ের প্রিয় শিষ্য উদ্ধারণ দত্ত প্রতিষ্ঠিত গৌরাঙ্গ মন্দির, তাঁর সমাধিমন্দির এবং বিখ্যাত মহাশ্মশান।

(১৪) নূতনহাট – সিঙ্গি থেকে ৩৫ কিমি। দেখে নিন হুসেনশাহি মসজিদের ধ্বংসাবশেষ, মসজিদের গায়ে পোড়ামাটির কাজ; ‘বিক্রমাদিত্যের ডাঙা’ যেখান থেকে মিলেছে শুঙ্গ, কুষাণ ও গুপ্ত সংস্কৃতির নানা নিদর্শন।

(১৫) কোগ্রাম – সিঙ্গি থেকে ৩৮ কিমি, নূতনহাট থেকে ৩ কিমি। ‘ভাঙন ধরা অজয় নদীর বাঁকে’ কবি কুমুদরঞ্জন মল্লিকের ভিটে। চৈতন্যমঙ্গলের কবি লোচনদাসের শ্রীপাট ছিল এই কোগ্রামেই। এখানে রয়েছে লোচনদাসের সমাধিমন্দির।  আর এই হল মঙ্গলকাব্যের উজানিনগর, এখানেই ছিল ভ্রমরার দহ যেখানে নোঙর করা থাকত ধনপতি-শ্রীমন্তদের বাণিজ্যডিঙা। অজয় ও কুনুর নদীর সঙ্গমস্থলে এক ত্রিভুজাকৃতি ভূখণ্ড। কাছেই উজানি সতীপীঠ, দেবী সর্বমঙ্গলার মন্দির।  

(১৬) চুপির চর – সিঙ্গি থেকে ২৫ কিমি। পরিযায়ী পাখিদের দেখতে চাইলে চলুন শীতকালে।  

কী ভাবে যাবেন

কলকাতা থেকে সিঙ্গি পৌঁছোনোর অনেক উপায় আছে।

ট্রেনপথে – হাওড়া বা শিয়ালদা স্টেশন থেকে কাটোয়া লাইনের যে কোনো ট্রেন ধরে কাটোয়ার তিনটে স্টেশন আগে পাটুলি স্টেশনে (শুধুমাত্র লোকাল ট্রেন থামে, মেল/এক্সপ্রেসে এলে কাটোয়া জংশনে নামতে হয়) নেমে শেয়ারে ম্যাজিক/অটো/টোটোয় চড়ে আসতে পারেন, ভাড়া: জনপ্রতি ১৫/২০ টাকা। হাওড়া থেকে লোকাল ট্রেনে পাটুলি স্টেশন পৌঁছোতে সময় লাগে পৌনে তিন ঘন্টা।

শিয়ালদা থেকে কাটোয়া লাইনের ট্রেনের সংখ্যা কম, তুলনায় হাওড়া থেকে অনেক বেশি।

সড়কপথে – গাড়িতে দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে ধরে মেমারি, সেখান থেকে সাতগাছিয়া, মন্তেশ্বর, মালডাঙা, মেঝিরি, সিঙ্গির মোড় হয়ে সিঙ্গি। কলকাতার এসপ্ল্যানেড থেকে এ পথে দূরত্ব ১৩৬ কিমির মতো। সময় লাগে মোটামুটি ৩ ঘন্টা।

এ ছাড়া ডানকুনি থেকে পুরোনো দিল্লি রোড ধরে মগরা হয়ে কালনা, নবদ্বীপ, পারুলিয়া ছুঁয়ে (এসপ্ল্যানেড থেকে মোটামুটি ১৪৭ কিমি) অথবা দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে ধরে বর্ধমান শহর, সেখান থেকে বলগোনা, কৈচর, কৈথন, সিঙ্গির মোড় ছুঁয়েও (এসপ্ল্যানেড থেকে মোটামুটি ১৫৮ কিমি) সিঙ্গি আসা যায়।

থাকা-খাওয়া

এখানে থাকার জন্য রয়েছে শান্তিনিকেতন হোমস্টে। যোগাযোগ: ৭০৪৪৭৯১৪৩৬/৭২৭৮১৮২৯০৯ 

‘শান্তিনিকেতন’ সিঙ্গি গ্রামের একটি (হোমস্টে)। গ্রামের কিছু পরিশ্রমী মানুষের সহযোগিতায় বাইরে থেকে গ্রামে বেড়াতে আসা মানুষদের থাকা, খাওয়ার ব্যবস্থা এবং গ্রামের পরিবেশ চেনানোর কাজ করে শান্তিনিকেতন পরিবার ।

বাড়িতে আছে বিভিন্ন ধরনের ফল, সবজি এবং বিভিন্ন গাছে ছাওয়া দু’টি ছোটো বাগান। আছে খুব ছোট্ট একটি বাঁধানো পুকুর, যেখানে ছোটো মাছ চাষ করা হয়।

অতিথিদের থাকার জন্য মোট ছ’টি ঘর আছে। দোতলায় দু’টি, ত্রিতলে তিনটি এবং একতলায় বাড়ির ভিতরের বাগান সংলগ্ন একটি ঘর আছে। প্রতিটি ঘরেই রয়েছে অ্যাটাচড্‌ বাথরুম। দোতলা ও তিনতলার ঘর দ্বিশয্যা। তবে অতিরিক্ত চার্জের বিনিময়ে অতিরিক্ত বিছানা করে তৃতীয় অতিথির থাকার ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়।   

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *