শম্ভু সেন
আইডিয়াটা ছিল রতীশের। রতীশ বিজয়ন, আমাদের এ বারের কেরল ভ্রমণের সারথি। আমাদের ভ্রমণ-পরিকল্পনা নিয়ে ঋভুর সঙ্গে ফোনে কথা হয়েছিল রতীশের। কোচি দিয়ে আমাদের ভ্রমণ শুরু হচ্ছে। সেখানে দু’ দিন থাকার অবকাশে ঘুরে আসব আথিরাপ্পিল্লি আর ভাঝাচল জলপ্রপাত।
রতীশ বলেছিল, “আথিরাপ্পিল্লির কাছাকাছি দিয়েই তো আসবেন। তা হলে কোচিতে এসে আবার সেখান থেকে পিছিয়ে যাবেন কেন? তা ছাড়া কোচি থেকে দূরত্ব যদিও মাত্র ৭৩ কিলোমিটার, তবুও কোচি শহরের জ্যাম ঠেলে যেতে অনেক সময় লাগবে। তার চেয়ে ভালো হয়, কোচির অনেক মাগে চালাকুড়িতে নেমে যাবেন, সেখান থেকে আথিরা মাত্র ৩৩ কিমি। আথিরা দেখে চলে আসবেন কোচি। আমি আপনাদের চালাকুড়িতে পিক আপ করে নেব।”

সেইমতোই চালাকুড়িতে নামলাম। ট্রেন দু’ ঘণ্টা লেট। পৌঁছোনোর কথা সকাল সাড়ে ৬টায়, পৌঁছোল সাড়ে ৮টায়। গত রাতে কেএসআর বেঙ্গালুরু থেকে কন্যাকুমারী এক্সপ্রেস বলা নেই, কওয়া নেই, প্রায় আড়াই ঘণ্টা দেরিতে ছাড়ল। রাত ৮.১০-এর জায়গায় সাড়ে ১০টায়। কেন দেরি, তার কোনো ঘোষণা হচ্ছে না। প্রতি মুহূর্তে আশঙ্কা, ট্রেন বাতিল হল নাকি! যাত্রীদের ধৈর্যের বাঁধ যখন প্রায় ভাঙার মুখে তখন ঘোষণা হল, ট্রেন সাড়ে ১০টায় ছাড়বে। ভারতীয় রেলের হাল এখন এ রকমই।
সুতরাং দু’ ঘণ্টা বিলম্বে আমাদের কেরল সফর শুরু হল। আমাদের তিন জনের সফর, ২০১৫-এর পর আবার। তারও আগে আমরা বারকয়েক কেরলে এসেছি। তবে চালাকুড়ি থেকে ভ্রমণ শুরু এই প্রথম। কারণ এ বারেই প্রথম, আমাদের কেরল ভ্রমণসূচিতে আথিরাপ্পিল্লি-ভাঝাচল।
স্বাগত জানাল রতীশ, ফোনালাপ ছিল, চাক্ষুষ আলাপ হল। স্টেশনের বাইরেই তার মাহিন্দ্রা ভেরিটো গাড়িটা নিয়ে অপেক্ষা করছিল। আদ্যন্ত বৈষ্ণব সুভদ্র যুবক রতীশ খুব তাড়াতাড়িই ঘনিষ্ঠ হয়েছিল আমাদের। তার একটা কারণ, আমাদের বার বার কেরল আসা, কেরল রাজ্যটাকে ভীষণ ভালোবাসা।

স্টেশনের খুব কাছেই ইন্ডিয়ান কফি হাউসে বেশ তৃপ্তি করেই প্রাতরাশ সেরে নিলাম দক্ষিণী ইডলি, বড়া আর কফি দিয়ে। ৯টা বেজে গিয়েছে। রওনা হলাম আথিরাপ্পিল্লির পথে। একটু পরেই পেরিয়ে গেলাম কোচি থেকে সালেমগামী ৫৪৪ নম্বর জাতীয় সড়ক (পুরোনো নম্বর ৪৭)। ধরলাম আথিরাপ্পিল্লির রাস্তা। এই রাস্তাই আথিরা ছাড়িয়ে চলে গিয়েছে ভাঝাচল। আরও এগিয়ে ঢুকে পড়েছে তামিলনাড়ুতে।
পেরিয়ে চলেছি ছোটো ছোটো জনপদ – কাভুঙ্গাল, পারিয়ারাম, ভেলুক্কারা। গ্রাম বলতে আমরা যে ছবি দেখি এই বাংলায়, মাটির বাড়ি, বিস্তীর্ণ খেত, সে ধরনের গ্রাম কেরলে নেই। বাড়ি-ঘরদোর সবই পাকা। চালাকুড়ি ছাড়িয়ে আসার পর থেকে ফাঁকা জায়গা খুব বেশি দেখছি না। এর প্রধান কারণ, আর্থিক প্রাচুর্য তুলনামূলক ভাবে বেশি কেরলে। কিন্তু জায়গাটা যে পাহাড়ি তা বোঝাই যাচ্ছে।
ভেলুক্কারা পেরিয়ে যেতেই শুরু হল ঘাট রাস্তা। রাস্তার একেবারে ধার থেকেই পাহাড়ের গা বেয়ে উঠেছে সবুজ জঙ্গল। কিন্তু যে আশায় এই বর্ষায় কেরল ভ্রমণে এসেছি তার দেখা নেই। বৃষ্টির নামগন্ধ নেই, বেশ গরম।

ভারতে বর্ষা আসে প্রথম কেরলে। সাধারণত ১ জুন তার আগমন ঘটে। এ বার আবহাওয়া দফতরের খবর অনুযায়ী, তার দিনদুয়েক আগেই বর্ষা ঢুকে গিয়েছে কেরলে। মনে মনে বাসনা ছিল, এই ভ্রমণে কেরলে বর্ষার আগমন উপভোগ করব। কিন্তু কোথায় কী? আজ ৪ জুন। বৃষ্টির ছিটেফোঁটাও নেই। রতীশও জানাল, এখনও সে ভাবে বর্ষা নামেনি। ঋভু একটু-আধটু আবহাওয়া নিয়ে চর্চা করে। সে জানাল, গত এক সপ্তাহে যা বৃষ্টি হয়েছে তাতে কেরলে বর্ষার ব্যাপক ঘাটতি। এবং আগামী কয়েক দিনও জোর বৃষ্টির তেমন কোনো পূর্বাভাস নেই। সুতরাং এই পরিস্থিতিতে ‘দক্ষিণ ভারতের নায়াগ্রা’ আথিরাপ্পিল্লি আমাদের কতটা আনন্দ দেবে তা নিয়ে সংশয় থেকেই যায়। তাই মানসিক ভাবে নিজেকে প্রস্তুত করে রেখেছিলাম।
ইতিমধ্যে ঘাটরাস্তা পেরিয়ে এলাম। কিন্তু এর পরের পথ সোজা নয়, প্রচুর বাঁক। রাস্তা একবার উঠছে, একবার নামছে। জঙ্গল কিছুটা হালকা হতেই চলে এলাম আর-এক জনপদে – কন্নাকুড়ি। একটু পরেই পৌঁছে গেলাম আথিরাপ্পিল্লিতে। প্রথম দিকে বেশ ঘরবাড়ি, গ্রামীণ সরকারি অফিস, পঞ্চায়েত অফিস ইত্যাদি। জনপদ শেষ হতেই পৌঁছে গেলাম জলপ্রপাতের জায়গায়। নির্দিষ্ট জায়গায় গাড়ি পার্ক করে, প্রয়োজনীয় প্রবেশ-দক্ষিণা দিয়ে হাঁটা শুরু করলাম। মূল সড়কের ডান দিক থেকে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে নেমে গেছে বাঁধানো পথ।
আজ যে শনিবার, তা মালুম হচ্ছে পর্যটকের সংখ্যা দেখে। স্থানীয় মানুষজনের ঢল নেমেছে আথিরায়। এখনও দেশে কোভিড-আক্রান্তের সংখ্যায় কেরল একদম প্রথম সারিতে। কিন্তু এখানে তা দেখে বোঝার উপায় নেই। আমাদের ছাড়া গোনাগুনতি কয়েক জনের মুখে মাস্ক।

বাঁধানো পথের পর বড়ো বড়ো পাথরে পা রেখে নেমে চলা। অতি সন্তর্পণে নেমে এলাম জলপ্রপাতের ধারে। চালাকুড়ি নদী উপর থেকে ৮০ ফুট ঝাঁপিয়ে পড়ে এই জলপ্রপাতের সৃষ্টি করেছে। এখন খুব বেশি জল নেই, তবে খুব কমও নেই। খুব বেশি হতাশ করেনি আথিরাপ্পিল্লি। তবে এর আসল রূপ খোলতাই হয় জুলাইয়ে, ভরা বর্ষায়। অন্তত রতীশ তা-ই বলল।
চালাকুড়ি থেকে মিনিট পঁয়তাল্লিশ লেগেছিল আথিরা পৌঁছোতে। ঘণ্টাখানেক এখানে কাটিয়ে রওনা। এখান থেকে ভাঝাচল ৭ কিমি, আরও সামনে। রতীশ বলল, গিয়ে লাভ নেই, জল আথিরার চেয়ে অনেক কম। আর নামতেও হবে বেশ খানিকটা। নামা মানেই তো ফেরার পথে ওঠা। টুকাইয়ের কষ্ট হবে। তাই ভাঝাচল দর্শন বাতিল। রওনা হলাম কোচির উদ্দেশে। (চলবে)
আরও পড়তে পারেন
চোখধাঁধানো স্থাপত্যের প্রাসাদ: উজ্জয়ন্ত প্রাসাদ, আগরতলা
পুজোয় অদূরে ৩ / রাঁচি-নেতারহাট-বেতলা
পুজোয় অদূরে ২ / রাঁচি-ম্যাকলাস্কিগঞ্জ