সুদীপ মাইতি
কোচি বিমানবন্দরে নেমে গাড়িতে উঠতে যাব, গাড়ির গায়ে লেখাটায় চোখটা আটকে গেল। আমাদের ন’ জনের জন্য একটা ভ্যান ঠিক করে রেখেছিল আমাদের ট্যুরিস্ট সংস্থা। ড্রাইভারের নাম বিষ্ণু। কথা আগের দিনই হয়েছিল। বিমানবন্দর থেকে বেরিয়ে কাছাকাছি একটা হোটেলে পৌঁছে আগে পেটপুজো করে নেওয়া হল। তার পর সোজা কোচির বিখ্যাত ব্যাকওয়াটারের দিকে রওনা।
ব্যাকওয়াটারের পথে যেতে যেতে বিষ্ণুকে জিজ্ঞাসা করলাম, আপনার গাড়িতে লেখা আছে ‘গড্স ওন কান্ট্রি’ (god’s own country)। ব্যাপারটা কী? ভগবান কি এখানেই থাকতে ভালোবাসেন?

সবুজই হল কেরলের প্রাণ।
সে যা বলল তার মোদ্দা অর্থ হল, এই যে চারিদিকে সবুজ দেখছি, ওই লেখার মূল কারণ হল এটাই। জবাবে ঠিক সন্তুষ্ট হলাম না। আরও কিছু শোনার প্রত্যাশায় কোচি থেকে মুন্নার, মুন্নার থেকে আলেপ্পি, আলেপ্পি থেকে তেক্কাড়ি, তেক্কাড়ি থেকে পেরিয়ার, এমনকি কোভালমের সমুদ্রতীরে চা-পকোড়ার দোকানে প্রশ্ন করে বসলাম। নানা জবাব শুনতে শুনতে অন্ধের হস্তি দর্শনের মতো সেগুলো জুড়ে নিয়ে একটা অবয়ব পাওয়া গেল, আর কিছুটা অনুভব করতে হল।
বিষ্ণুর উত্তরটা সব জায়গায় পেলাম। তার সঙ্গে জুড়ে গেল এই কেরল রাজ্যের তাপমাত্রা প্রসঙ্গ। সারা বছর জুড়ে খুব একটা গরম নেই। শীতকালও সে রকম জবরদস্ত নয়। শুধু সারা বছরই নয়, সারা দিন রাত খুবই মনোরম আবহাওয়া। কিছু বিশেষ জায়গা ছাড়া গরম জামাকাপড় খুব একটা পরতে হয় না। সেই সঙ্গে উঠে এল এই রাজ্যে ভিন্ন ভিন্ন ধর্মের মানুষের সহাবস্থান প্রসঙ্গ। এই রাজ্যে নিশ্চিন্তে, নিরুপদ্রবে বাস করে হিন্দু, মুসলিম, খ্রিস্টান-সহ ভিন্ন ভিন্ন ধর্মের মানুষ। প্রাকৃতিক সহাবস্থানও রয়েছে। রয়েছে সমুদ্র, নদী, লেক, পাহাড়, জঙ্গল – প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের একেবারে আদর্শ জায়গা। সেই সঙ্গে রয়েছে শিক্ষিতের হার, যা দেশের মধ্যে সর্বোচ্চ। এরাই এই রাজ্যটিকে সবুজে সাজিয়ে রাখতে পেরেছে। ঈশ্বর তাঁর বাসস্থানের জন্য এ সবের বাইরে আর কি চাইতে পারেন? সবই রয়েছে। কোচির ব্যাকওয়াটারের পাশে বসে আসরাফ তাই বলেছিলেন, কেরলই ভগবানের আপন দেশ। আসরাফের পুরো নামটা আর মনে নেই। ওঁর ব্যাবসা ব্যাকওয়াটারে নৌকা চালানো।

চাইনিজ ফিশিং নেট, কোচি।
ব্যাকওয়াটারের কোচিতে
কোচি শহরের পা পড়েছে ভাস্কো ডা গামার। পর্তুগিজ, ব্রিটিশরা এখানে ব্যাবসাবাণিজ্যের জন্য বহু বছর ধরে রাজত্ব করে গেছে। এখানে রয়েছে ফোর্ট কোচি, আকর্ষণীয় ভাবে অবস্থান করছে গির্জা। রয়েছে সেগুন কাঠের তৈরি মাত্তানচেরি প্যালেস, কোচি মিউজিয়াম-সহ অনেক দর্শনীয় স্থান।
কেরলের সারা সমুদ্র-উপকূল ছড়িয়ে রয়েছে ব্যাকওয়াটার আর লেক। এই কোচিতেই রয়েছে বেম্বানাড় লেক। লম্বায় ৯৬.৫ কিমি বিশিষ্ট এই লেক ভারতবর্ষের মধ্যে দীর্ঘতম। শুধু তা-ই নয় ২৩০ বর্গ কিমি আয়তন বিশিষ্ট এই লেক কেরলের সব চেয়ে বড়ো লেক। তেঙ্গু থুড়ি নারকেল গাছ দিয়ে ঘেরা এই লেক খুবই সুন্দর।

ব্যাকওয়াটারে সূর্যাস্ত।
এই লেকে দ্বিপ্রহরে বোটিং করতে করতে চোখে পড়ল মাছ ধরার জাল। না, একটু অন্য রকম বলেই চোখে পড়ল। একটি খুঁটির মাথায় জালের শীর্ষ দিকটি বাঁধা। আর জালটির নীচের অংশ বিছানো আছে একেবারে জলের তলায়। মাছ নিজের অজান্তেই ওই জলের উপর দিয়েই যাওয়া-আসা করে। আর সময়-সুযোগ বুঝে সেই জাল দড়ির টানে মাছ-সহ উপরে উঠে আসে। এ হল ‘চাইনিজ ফিশিং নেট’। এই জাল চিনারা এখানে থাকার সময় মাছ ধরার কাজে ব্যবহার করত। তাদের অনেক কিছু মুছে গেলেও মাছ ধরার পুরোনো এই পদ্ধতি আজও কেরলের এই অঞ্চলে বেশ জনপ্রিয় এবং কার্যকর বলে জানাল বোটের চালক।
ব্যাকওয়াটার ভ্রমণের গির্জা, ফোর্ট, মাত্তানচেরি প্যালেস পেরিয়ে যখন আরব সাগরের তীরে পৌঁছেছিলাম তখন অবাক হয়ে দেখতে পেলাম সূর্য তার লাল আভা ছড়িয়ে দিচ্ছে সমুদ্রে ভাসমান বোট আর তীরে জাল ফেলে মাছ ধরার জেলেদের মাথার উপর। বিকালের সূর্য আর সন্ধ্যার সূর্যের এই যে বৈপরীত্য তা ভোলার নয়।

মুন্নারের প্রকৃতি।
কোচি থেকে মুন্নারে
মুন্নার যাওয়ার পথে পড়বে বেশ কয়েকটা জলপ্রপাত। পড়বে মসলার বাগান। আয়ুর্বেদ ওষুধের বিভিন্ন গাছগাছালি। পথে পড়বে পাহাড়ের ঢালে ঢালে সবুজে সবুজে মাখানো চায়ের বাগান। শুনলাম এখানকার তেয়িলা থুড়ি চা-পাতা ঘ্রাণে ও স্বাদে অতুলনীয়। এ ছাড়াও পাবেন রংবেরঙের ফুলের বাগান। আপনার চোখ সেখান থেকে সরবে না। এ ভাবেই পাহাড়ের চড়াই-উতরাই পেরোতে পেরোতে চোখ-না-ফেরানোর মতো দৃশ্য দেখতে দেখতে আপনি কখন যে সমুদ্রতল থেকে ৫২০০ ফুট উচ্চতায় কেরলের ইড্ডুকি জেলার মুন্নারে পৌঁছে যাবেন তা টেরই পাবেন না।
মালায়ালম ভাষায় ‘মুন’ কথাটির অর্থ তিন। আবার ‘আর’ এই শব্দটির অর্থ হচ্ছে নদী। তিন নদীর সঙ্গমস্থলে অবস্থিত বলে এই জায়গার নাম হয়েছে মুন্নার। এই পর্যটনকেন্দ্রটির সৌন্দর্যের এতটাই খ্যাতি রয়েছে যে একে দক্ষিণ ভারতের কাশ্মীর বলা হয়। আর মধুচন্দ্রিমা যাপনের পক্ষেও সারা ভারতবর্ষের মধ্যে খুবই আকর্ষণীয় এবং পরিচিত পর্যটনকেন্দ্র এই মুন্নার। মুন্নার শহরের আশেপাশে রয়েছে একটি সুন্দর হ্রদ ও কংক্রিটের তৈরি বাঁধ। পোশাকি নাম মাট্টুপেট্টি জলাধার। কাছেই রয়েছে একটি দর্শনীয় জলবিদ্যুৎ প্রকল্প। রয়েছে এরাভিকুলম ন্যাশনাল পার্ক ও একটি আকর্ষণীয় জলপ্রপাত। পরিকল্পনা অনুযায়ী মুন্নারে এক থেকে চার চারটে দিন কাটাতেই পারেন। তবে ভোর ভোর উঠে জানালার ফাঁক দিয়ে প্রকৃতিকে দেখা, কিংবা আর একটু এগিয়ে বিছানা ছেড়ে হোটেলের ছাদে উঠে ভোরের সূর্যোদয় থেকে সকালের কুয়াশামাখা প্রকৃতি দেখতে পারলে তা আপনার মনের আয়নায় রয়ে যাবে আজীবন, এটুকু বলা যেতেই পারে। আর মুন্নারের প্রতিটি স্পটই হল ফটোশ্যুটের জায়গা।

পেরিয়ারে জলভ্রমণে।
পেরিয়ার ভ্রমণ
কেরল বেড়াতে গেলে পেরিয়ার লেক ভ্রমণ অতি আবশ্যকীয় কাজ। সকালে জঙ্গলের মধ্যে এক বিশাল লেকে লঞ্চে ভ্রমণ। আবার গভীর রাতে সেই জঙ্গলে পদব্রজে ট্রেকিং। সকালে রকমারি সুন্দর, অতীব সুন্দর, বিভিন্ন জানা-অজানা পাখির কিচিরমিচিরের মাঝে লঞ্চের ডেক থেকে দূরে হরিণের জল খাওয়া, হাতি, বাইসন, বিভিন্ন বন্যপ্রাণীর বিচরণ দেখতে দেখতে ঘণ্টা দুয়েকের জলভ্রমণ এক অনাবিল আনন্দ এনে দেয়। আবার রাতের অন্ধকারে সেই জঙ্গলে হঠাৎ যদি হরিণ, বাইসনের জ্বলন্ত চোখের মুখোমুখি হওয়া যায় কিংবা সঙ্গী-প্রহরী যদি বলে এই জায়গায় অনেক সময় হিংস্র ভালুক এবং ওঁত পেতে বসে থাকা চিতাবাঘের দেখা মেলে তা হলে কেমন লাগে?
এই পেরিয়ার লেক ভারতের অন্যতম জাতীয় উদ্যান ও বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য হিসাবে বিখ্যাত। এটি কেরল রাজ্যের ইড্ডুকি এবং পতনমতিট্টা জেলার প্রায় ৯২৫ বর্গ কিমি জায়গা জুড়ে অবস্থিত। এখানে এশিয়ান হাতি, বাংলার বাঘ, ভারতীয় বাইসন, সম্বর, হরিণ, বুনো কুকুর, লেপার্ড, বিষযুক্ত ও বিষহীন বহু রকমের সাপ রয়েছে। আর এই সকাল ও রাতে পেরিয়ার লেক ও জঙ্গল দেখার মাঝে হোটেলে শুয়ে না থেকে বেরিয়ে পড়তে পারেন জিপ সাফারিতে। কাছাকাছি দেখতে পেয়ে যেতে পারেন আঙুরের খেত, জলপ্রপাত। আর এবড়ো-খেবড়ো রাস্তা পেরিয়ে ছোটো ছোটো নদীর পাড় বেয়ে পাহাড়ি রাস্তা বেয়ে উঠে গেলে দেখতে পাওয়া যাবে পাহাড়, জঙ্গলের নয়নাভিরাম সবুজের দৃশ্য। মনে হতেই পারে শহরের কোলাহল ভুলে নির্জন এই সব পাহাড়ের কোলে আজীবন এখানেই ঘর বাঁধি।

পেরিয়ারে পক্ষীদর্শন।
সবুজের রাজ্য
কেরল আর চায়ের বাগান ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। সুন্দর, নয়নাভিরাম। বড়ো রাস্তার ধারে গাড়ি দাঁড় করিয়ে নেমে পড়ুন। একটু এঁকে বেঁকে নেমে যান ঢাল বেয়ে। কিংবা চড়াই-উতরাই সামলে উঠে যান সবুজ চা বাগানের মধ্য দিয়ে। সেটা সকালের নরম আবহাওয়ায় হোক বা দুপুরের মিষ্টি রোদে কিংবা বিকালের মেঘলা আকাশে। সব সময়ই পাওয়া যাবে এক পরিপূর্ণ তৃপ্তি।
আবার গাড়িতে সওয়ার হয়ে যখন কেরলের ছোটো ছোটো পাহাড়ি আঁকা বাঁকা পথ বেয়ে এই চা বাগান কিংবা দু’ পাশে সবুজে সবুজে পূর্ণ পথ বেয়ে এগিয়ে যাবেন তখন যদি একটু ঝিরঝির বৃষ্টি পেয়ে যান তা হলে তো কথাই নেই।

আলেপ্পির হাউসবোট।
আলেপ্পিতে থাকুন হাউসবোটে
কেরলে পা দিযে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লেই আপনার কানে আসবে শুধু একটাই শব্দ – ব্যাকওয়াটার। আসলে আরব সাগর এই কেরলে যেন ব্যাকওয়াটার রূপে চতুর্দিকে খেলা করে চলেছে। আরব সাগরের তীর বরাবর প্রায় ৬০০ কিমি উপকূল জুড়ে রয়েছে এই কেরল রাজ্যটি।
কেরল (মালায়ালমে কেরলম, উচ্চারণে কেরালা) নামটি এসেছে ‘কের’ (অর্থ নারকেল গাছ) আর ‘আলম’ (অর্থ দেশ বা ভূমি) শব্দ দুটি জুড়ে। সারা কেরল জুড়ে রয়েছে অজস্র খাঁড়ি, নদী, খাল। সবই যুক্ত ওই আরব সাগরের সঙ্গে। আর এই সাগর থেকে আসা বিপুল জলরাশি যার পোশাকি নাম ব্যাকওয়াটার ঘিরে রেখেছে রাজ্যের বেশ কিছু শহরকে। এ রকমই একটি শহরের নাম আলেপ্পি (বর্তমান নাম আলাপুঝা), যা ‘প্রাচ্যের ভেনিস’ নামে খ্যাত।
আলেপ্পির পাশে আরব সাগর অন্য পাশে কেরলের বৃহত্তম লেক বেম্বানাড়। এই আলেপ্পিতে লেকের মধ্যে বোটে করে ঘুরে বেড়ানোর ব্যবস্থা আছে। তবে একটি রাত হাউসবোটে কাটাতে পারলে আরও ভালো হয়। তিন বেলা খাওয়াদাওয়া-সহ দু’ বারে প্রায় চার-পাঁচ ঘণ্টা ওই হাউসবোটে করে লেকভ্রমণ অবশ্যই এক অন্য ভ্রমণের স্বাদ দেবে।
কোভালম বাদ দেবেন না
কেরলে ঘুরে বেড়ানোর জায়গায় অভাব নেই। দশ-পনেরো দিন ধরে ঘুরে বেড়ালেও আপনার ক্লান্তি আসবে না। কিন্তু কেরল বেড়াতে গিয়ে কোভালম বিচ যদি না দেখতে যান তবে কেরল-দর্শনে এক ফোঁটা চোনা পড়ে যাওয়ার মতো অবস্থা হবে। কোভালম শব্দের অর্থ হচ্ছে নারকেল গাছের সারি। শান্ত, দীর্ঘ অগভীর সমুদ্র সৈকতে নারকেল গাছের সারি এই সমুদ্রসৈকতকে এক আলাদা মাত্রা দিয়েছে। আর সেই সৌন্দর্য উপভোগ করতে বহু বিদেশি পর্যটকেরই আনাগোনা লেগেই থাকে। এই সৈকতে পর্যটকরা তাদের পছন্দমতো সূর্যস্নান, সৈকতস্নানের পাশাপাশি প্যারাগ্লাইডিং ও হার্বাল বডি ম্যাসেজের সুযোগ পান।

কয়েকটা দিন আনন্দে কাটল কেরলে।
তিনটি অর্ধচন্দ্রাকৃতি সৈকত নিয়ে এই কোভালম সমুদ্রসৈকত – হাওয়া সৈকত, লাইটহাউস সৈকত ও সমুদ্র সৈকত। কোভালম বিচে এক-দু’ দিন কাটানোর মাঝে এখন থেকে মাত্র ১৬ কিমি দূরে রাজ্যের রাজধানী তিরুঅনন্তপুরম অবশ্যই ঘুরে আসা যেতে পারে। তিরুঅনন্তপুরমের অর্থ ‘পবিত্র অনন্তনাগের শহর’ – ‘তিরু’র অর্থ পবিত্র, ‘অনন্ত’ মানে অনন্তনাগ এবং ‘পুরম’ মানে শহর। তিরুঅনন্তপুরমের অন্যতম দ্রষ্টব্য পদ্মনাভস্বামী মন্দির। ধুতি পরে খালি গায়ে এই মন্দিরদর্শন কেরল ভ্রমণে এক আলাদা মাত্রা যোগ করবে।
ছবি: লেখক