শম্ভু সেন
চেনা পথে চলে এলাম চালাকুড়ি। মাঝে খানিকটা বৃষ্টি হল। খুব বেশি নয়, খুব কমও নয়। বৃষ্টি হচ্ছে না বলে আমরা হা-হুতাশ করছি। প্রকৃতিদেবী বোধহয় আমাদের আপশোশ কিছুটা মেটানোর চেষ্টা করলেন।
পড়লাম সেই জাতীয় সড়কে, ৫৪৪ বা ৪৭, যে নম্বরেই ডাকি না কেন। বাঁ দিকে ঘুরে কোচির পথ ধরলাম। চালাকুড়ি শহরটা বেশ বড়ো। হাইওয়ে দিয়ে যেতে যেতে বুঝলাম। স্টেশন থেকে আথিরাপ্পিল্লি যাওয়ার সময় এটা মালুম হয়নি। খুব তাড়াতাড়ি শহরের সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছিলাম। হাইওয়ের দু’ ধারে চালাকুড়ির বিভিন্ন অঞ্চল। গ্রাম কেরলের স্বাদ খুব একটা পাচ্ছি না। বেশিটাই শহরাঞ্চল বলে মনে হয়। পেরোচ্ছি নানা জনপদ – কোরাট্টি, এলাভুর, কারায়াম্পরাম্বু।
সোয়া ১২টা নাগাদ এসে পৌঁছোলাম অঙ্গামালি। এখান থেকে কালাড়ি মাত্র ৮ কিলোমিটার। আদি শংকরাচার্যের জন্য বিখ্যাত কালাড়ি। কিন্তু এ যাত্রায় আর যাওয়া হল না। রতীশ জানাল, মন্দির বন্ধ হয়ে গিয়েছে। ট্রেন দু’ ঘণ্টা লেটের খেসারত দিতে হল আমাদের।

তবে এর আগে কালাড়ি গিয়েছি দু’ বার – প্রথম বার ১৯৮৩-তে, যখন ‘অ্যাডভ্যান্সড জার্নালিজম’-এর কোর্স করতে এসে দেড় মাস ছিলাম কোট্টায়ামে। আর দ্বিতীয় বার ২০০১-এ, সপরিবার কেরল ভ্রমণে এসে। পেরিয়ার তথা পূর্ণা নদীর তীরে অবস্থিত কালাড়ি আদি শংকরাচার্যের জন্মস্থানের জন্য বিখ্যাত। সালটা ছিল ৭৮৮ খ্রিস্টাব্দ। বৈশাখ মাসের শুক্ল পক্ষে এক রক্ষণশীল হিন্দু পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন শংকরাচার্য।
সন্ন্যাস নেওয়ার ব্যাপারে শংকরাচার্য কী ভাবে মায়ের অনুমতি আদায় করেছিলেন, তা নিয়ে একটা কাহিনি প্রচলিত আছে। শংকরকে একবার কুকুর ছুঁয়ে দিয়েছিল। প্রবীণরা নির্দেশ দিলেন নদীতে স্নান করে শংকরকে শুদ্ধ হতে হবে। শংকর চললেন পূর্ণায় স্নান করতে, সঙ্গে মা। নদীতে নামতেই কুমির এসে শংকরের পা কামড়ে ধরল। কিছুতেই ছাড়ে না। শংকর মাকে বললেন, তিনি যদি শংকরকে সন্ন্যাস নেওয়ার অনুমতি দেন, তা হলে কুমির ছেড়ে দেবে। না হলে…। বাধ্য হয়ে মা শংকরকে সন্ন্যাস নিতে অনুমতি দিলেন। সেই ঘাট আজ কালাড়ির পুণ্য তীর্থ।
এই কালাড়িতে আছে পূর্ণা নদীর উত্তর তীরে শৃঙ্গেরি মঠ পরিচালিত শংকর মন্দির, বেলুড় মঠের আদলে তৈরি রামকৃষ্ণ অদ্বৈত আশ্রমের মন্দির, কাঞ্চী কামকোঠি মঠের তৈরি করা আটতলা স্মারকসৌধ ‘শ্রী আদি শংকর কীর্তি স্তম্ভ মণ্ডপম’ ইত্যাদি।
কালাড়ি বাঁ দিকে পড়ে থাকল। আমরা এগিয়ে চললাম। আরও শহর পেরোলাম – আলুভা (যাকে অনেকেই আলওয়ে নামে চেনে), দেশম। পেরিয়ার নদী পেরিয়ে পৌঁছে গেলাম কোচির শহরতলিতে। কোচি শহরেও মেট্রো চলে এসেছে। এবং সে যে বেশ বিস্তৃত তা বোঝাই যাচ্ছে। কোচি পুলিশ এলাকাতেও ঢুকে পড়লাম।

রতীশ জানাল, কোচির জ্যাম বিখ্যাত। আমাদের যেতে হবে আরুর, কোচি শহর পুরো টপকে বেম্বানাড় পেরিয়ে। এই জ্যাম ঠেলে যেতে যেতে আমাদের খুব দেরি হয়ে যাবে। এ দিকে পেটে ছুঁচোয় ডন মারছে। বিকল্প পথ ধরল রতীশ, কোচি বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরের মধ্য দিয়ে। কোচি শহরকে অনেকটাই কাটিয়ে আমরা এসে পড়লাম কুম্বালাম সাউথে। তার পর বেম্বানাড় হ্রদ পেরিয়ে চলে এলাম আরুরে।
বেম্বানাড় ভারতের মধ্যে সব চেয়ে দীর্ঘ এবং কেরলের বৃহত্তম হ্রদ। লম্বায় সাড়ে ৯৬ কিলোমিটার এই হ্রদের আয়তন ২০৩৩ বর্গ কিলোমিটার। কোট্টায়াম, ভাইকম, চাঙ্গানাশেরিতে এর পরিচয় বেম্বানাড়ু লেক হিসাবে। আলাপুঝা, পুন্নাপ্পারা আর কুট্টানাড়ে এই লেক হয়ে গিয়েছে পুন্নামাড়া লেক। আর কোচিতে এটি কোচি লেক। সে যা-ই হোক, যে নামেই তাকে ডাকা হোক না কেন, কেরলের ভূপ্রকৃতিতে এই বেম্বানাড় হ্রদের বিশাল ভূমিকা আছে।
কোচি শহরতলির যে সব এলাকা বেম্বানাড়ের ও-পারে, সে সব জায়গায় একসময়ে পৌঁছোতে হত ফেরিতে চেপে। এখন বেম্বানাড়ের ওপর নানা জায়গায় তৈরি হয়েছে সেতু। এ রকমই একটি সেতু পেরিয়ে আমরা যখন আরুরের হোমস্টেতে এসে পৌঁছোলাম তখন ঘড়িতে ২টো বাজে। (চলবে)
ভগবানের আপন দেশে ১/ আথিরাপ্পিল্লি দেখে কোচির পথে