ভগবানের আপন দেশে ৩/ আরুরের ‘চিনাভালা’য়

Aroor

শম্ভু সেন

বেম্বানাড়ের সেতু পেরোতেই শুরু হল আরুর এলাকা। কোচির দক্ষিণ শহরতলি হলেও আরুর আলাপুঝা জেলায়। সেতু পেরিয়ে কিছুটা এগিয়েই বাঁহাতি রাস্তা। সেই পথে খানিকটা যেতে একেবারে বেম্বানাড়ের ধারে বেনি রাফেলের ‘চিনাভালা হোমস্টে’। কেন নাম চিনাভালা, তা পরে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন বেনি রাফেল।

ঋভুর ভ্রমণসংস্থার নাম ‘ট্রাভেলিজম’। সেই ট্রাভেলিজম করার সূত্রেই ঋভুর সঙ্গে আলাপ বেনির। ঋভুর সঙ্গে তার বাবা-মাকে আসতে দেখে প্রচণ্ড খুশি মধ্যবয়সি বেনি ও তাঁর স্ত্রী। ঋভুর বাবা আমি, তাই আমাকে বেনি ‘ফাদার’ বলে ডাকতে শুরু করলেন। এখানে পৌঁছোনোর পর থেকেই অদ্ভুত একটা ভালোবাসার বন্ধনে জড়িয়ে গেলাম।

বেনি রাফেলের এই হোমস্টে মালায়ালাম সংবাদপত্র ‘মালায়ালা মনোরমা’র অফিসের ঠিক পাশেই বেম্বানাড় হ্রদের ধারে অনেকটা এলাকা জুড়ে। আদতে এটা বেনির বাংলোবাড়ি। নিজের বাংলোবাড়িটাকেই করেছেন হোমস্টে। সস্ত্রীক থাকেনও এখানেই।

গাছগাছালিতে ভরা আরুরের হোমস্টে। ছবি: শ্রয়ণ সেন।

আমরা একটা ভুল করেছিলাম। এখানে আসার আগে বেনিকে জানানো উচিত ছিল কখন আসছি এবং পৌঁছে লাঞ্চ করব কিনা। আজ যে আসছি, তা জানতেন বেনি। কিন্তু সেটা যে একেবারে দুপুরের খাওয়ার সময়, এতটা আন্দাজ করতে পারেননি। আর এখন প্রায় আড়াইটে বাজে। মধ্যাহ্নভোজনের যাবতীয় আয়োজন শেষ। এটা হোটেল নয়, হোমস্টে। বেনির স্ত্রী নিজেই রান্না করেন। তাঁকে নতুন করে রান্না চাপানোর কথা বলাও যায় না। তা ছাড়া এর পর যদি রান্না চাপানো হয়, তা হলে খেতে খেতে বিকেল গড়িয়ে যাবে। এ দিকে আমাদেরও খিদের চোটে কাহিল অবস্থা।

দুপুরের খাবার দিতে পারলেন না বলে বেনি বার বার দুঃখ প্রকাশ করলেন। বাড়িতে অতিথি এসেছে, অথচ তিনি কিছু খাওয়াতে পারছেন না যে। তবে উপায় বাতলে দিলেন তিনিই। জানিয়ে দিলেন, আরুরের মোড়েই একটা সুন্দর একটা রেস্তোরাঁ আছে। তিনি নিজেই সেখানে ফোন করে বলে দিলেন। ঘরে কোনো রকমে মালপত্র রেখে রতীশকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম।   

দুর্দান্ত মধ্যাহ্নভোজন হল। দুর্দান্ত আইটেম এবং দুর্দান্ত স্বাদ। কেরল মূলত উপকূলবর্তী রাজ্য। তাই এখানকার বেশির ভাগ মানুষ মৎস্যপ্রেমী। তাই কেরলে বেড়াতে এসে বাঙালিদের খাওয়ার ব্যাপারে খুব একটা অসুবিধা হয় না। দুপুরের আহার সারলাম কিংফিশের মশলাদার ঝোল দিয়ে। এই কিংফিশ অনেকটা আমাদের সাডিন মাছের মতো।

বেনি রাফেলের হোমস্টেতে ‘চিনাভালা’। ছবি: শ্রয়ণ সেন।

কেরলের অধিকাংশ মানুষের মতো বেনি রাফেলও মাছের ভক্ত। এতটাই ভক্ত যে তাঁর হোমস্টেতে চাইনিজ ফিশিংনেট বানিয়ে রেখেছেন। সেটা বসিয়েছেন বেম্বানাড়ের ধারে। এই চাইনিজ ফিশিংনেট কোচির অন্যতম দ্রষ্টব্য। তারই একটা ছোটো সংস্করণ রয়েছে বেনি রাফেলের হোমস্টেতে।

মধ্যাহ্নভোজ সেরে ফিরে এলাম বেনির বাড়িতে। পেট ঠান্ডা। ভালো করে ঘুরে ঘুরে হোমস্টেটা দেখলাম। মূল বাংলোবাড়িটা যে খুব বড়ো তা নয়। ঘরের সংখ্যা খুব বেশি নয়। মাত্র চারটে। আসলে এটা তো হোমস্টে, তাই ঘরের সংখ্যা বেশি বাড়াননি বেনি। হোটেল-রিসর্ট হলে হয়তো অন্য ব্যাপার হত। কিন্তু অনেকটা এলাকা জুড়ে এই হোমস্টে। রয়েছে অনেক গাছ। তার মধ্যে বেশ কয়েকটা আম গাছ। তাকিয়ে দেখলাম বেশ বড়ো বড়ো আম ফলেছে।

হোমস্টের পাড়ে ধাক্কা মারছে বেম্বানাড়ের জল। যেখানে জল ধাক্কা মারছে, সেই জায়গা থেকে কয়েক পা পিছিয়ে এলেই আমাদের ঘর। ঘরের জানলা খুলে দিলেও সুন্দর হ্রদটা ধরা দেয়। ঘরের সামনে একটা সুন্দর গাড়িবারান্দার মতো বসার জায়গা। সেখানে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে হ্রদ দেখতে দেখতে দিব্যি সময় কাটিয়ে দেওয়া যায়।

আজ পূর্ণ বিশ্রাম। মধ্যাহ্নভোজ সেরে এসে ঘণ্টাখানেক ভাতঘুম দিলাম। বিকেল হতেই ঘরের লাগোয়া গাড়িবারান্দায় এসে বসলাম আমরা। পশ্চিম আকাশে মেঘের ঘনঘটা। এ তো বৃষ্টির বার্তাবাহক। একটু পরে চলে এলেন বেনি। আর এল চা, সঙ্গে পাকাকলার বড়া। কী অপূর্ব স্বাদ!

সন্ধ্যায় সেজেছে চিনাভালা হোমস্টে। ছবি: শ্রয়ণ সেন।

কথায় কথায় জানতে চেয়েছিলাম ‘চিনাভালা’ কথার অর্থ কী। চাইনিজ ফিশিংনেটকেই মালায়ালাম ভাষায় বলে ‘চিনাভালা’। সেখান থেকেই নিজের হোমস্টের নাম ‘চিনাভালা’ দিয়েছেন বেনি। এই ফিশিংনেট কী ভাবে কাজ করে জানতে চেয়েছিলাম। আমরা সবাই ফিশিংনেটের কাছে হাজির হলাম। বেনি সানন্দে মাছ ধরার প্রক্রিয়া দেখাতে শুরু করে দিলেন। দক্ষিণ ভারতীয় টানে ইংরেজি এবং ভাঙা ভাঙা হিন্দিতে বোঝাতে শুরু করলেন এই ফিশিংনেট দিয়ে কী ভাবে মাছ ধরা হয়। বেম্বানাড় হ্রদ দু’ রকম ভাবে বয়ে যায় এখানে। জোয়ারের সময় সে বয়ে যায় সমুদ্রের দিক অর্থাৎ পশ্চিম দিক থেকে। ভাটার সময় ঠিক উলটো ব্যাপার। জোয়ার হলে এই ফিশিংনেটে নোনাজলের মাছ ধরা পড়ে আর ভাটার সময় মিষ্টিজলের মাছ। তবে কাঁকড়া, চিংড়ি জাতীয় মাছই বেশি ধরা পড়ে এই জালে।

বেনি কি আমার মনের কথা বুঝতে পেরেছিলেন? বিকেলেই স্থানীয় একজনকে ডেকে এনে শুরু হল আম পাড়ানো। গোটা ব্যাপারটা তদারকি করছেন বেনির স্ত্রী। বিশাল বিশাল সাইজের আম দেখে আমাদের তো রীতিমতো চক্ষুচড়কগাছ। এই রকম বড়ো সাইজের আম আমাদের বঙ্গে সচরাচর দেখা যায় না। মালদার ফজলিও এত বড়ো হয় না। সেই আমও চলে এল প্লেটে। সন্ধ্যায় বারান্দায় বসে বেম্বানাড়ে নজর রাখছিলাম, তখনই আম নিয়ে হাজির বেনি। পিস পিস করে কেটে প্লেটে সুন্দর করে সাজানো। অপূর্ব স্বাদ সেই আমের।  

বিকেল থেকেই যার প্রস্তুতিপর্ব চলছিল, সন্ধ্যাতেই সে যেন ভেঙে পড়ল। আকাশভাঙা বৃষ্টি। বৃষ্টি হচ্ছে না বলে আমাদের যে ক্ষোভ তা পুষিয়ে দিতে প্রকৃতিদেবী যেন হাত উপুড় করে দিলেন। কেরল সফরের প্রথম দিনই চলে এল বৃষ্টি। রুটি আর কারিমিন মাছের কারি দিয়ে যখন রাতের খাবার খাচ্ছি, তখনও ধারাপাত হয়ে চলেছে অবিরাম। আজ বোধহয় সারা রাতই এই খেল চলবে। (চলবে)

ভগবানের আপন দেশে ২/ কোচি ছুঁয়ে এলাম আরুরে

ভগবানের আপন দেশে ১/ আথিরাপ্পিল্লি দেখে কোচির পথে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *