ভগবানের আপন দেশে ৮ / কলুক্কুমালাই পাহাড়শীর্ষে

view from Kolukkumalai hill top

শম্ভু সেন

কেরলের মতো উপকূলবর্তী রাজ্যে আট হাজারি শৃঙ্গ, ভাবা যায়? না, আট হাজারি মানে আট হাজার মিটার নয়, আট হাজার ফুট। কিন্তু তা-ই বা কম কী! ভারতের হিল স্টেশন বললেই তো দার্জিলিং, শিমলা, মুসৌরি, নৈনিতাল, মানালির কথা মনে পড়ে। ক’ জন আর দক্ষিণ ভারতের দিকে নজর দেয়। আসলে এখানে যে বরফ পড়ে না। অথচ এই আট হাজারি পর্বতশীর্ষের উপরেই রয়েছে বিশ্বের সর্বাধিক উচ্চতার চা-বাগান – কলুক্কুমালাই টি এস্টেট।

চিনাকানালকে পশ্চিম দিক দিয়ে আগলে রেখেছে বেশ কয়েকটা পাহাড়শীর্ষ। এখানকার সর্বোচ্চ শৃঙ্গ আনাইমুদির উচ্চতা ৮৮৪২ ফুট। সে অবশ্য মুন্নার থেকে কিছুটা দূরে। কিন্তু কলুক্কুমালাই বা তার আশেপাশের সব পাহাড়শীর্ষই আট থেকে সাড়ে আট হাজার ফুট উঁচু।

কেরলের পাহাড়ি অঞ্চলে জিপগাড়ির খুব রমরমা। যেখানে ভালো রাস্তা নেই, অথচ রোমাঞ্চ আছে, সেখানে যাওয়ার জন্য জিপই ভরসা। এখানে এই গোটা ব্যাপারটাকে বলা হয় ‘অফ-রোড অ্যাডভেঞ্চার’! এই ‘অফ-রোড অ্যাডভেঞ্চার’-এর মজাই আলাদা। এখানে তো আর পাঁচ জন সাধারণ পর্যটকের পা পড়ে না। কলুক্কুমালাই যাওয়াটাও ‘অফ-রোড অ্যাডভেঞ্চার’।   

এই জিপেই সওয়ারি আমরা।

চিনাকানালে পৌঁছোলেই জিপচালকদের হাঁক শুনতে পাবেন। তাঁদের গন্তব্য, কলুক্কুমালাই। সকালেই ঘুরে এসেছি টপ স্টেশন। আপশোশ মিটিয়েছি। এ বার দুপুরের খাওয়া সেরে অল্প বিশ্রাম নিয়ে আমরা বেরিয়ে পড়লাম কলুক্কুমালাইয়ের উদ্দেশে। যেখানে যেতে হলে জিপই একমাত্র বাহন, সেখানে যাওয়াটা যে বেশ রোমাঞ্চকর হবে, তা আন্দাজ করতে পারছি। কিন্তু রোমাঞ্চের মাত্রা ঠিক কতটা হবে তা বুঝতে পারিনি।

জিপের ভাড়া ২০০০ টাকা। ভাড়া এখানকার ইউনিয়নের তরফেই ঠিক করে দেওয়া রয়েছে। একটা জিপে সর্বোচ্চ সাত জন যেতে পারেন। এ ছাড়া আরও পাঁচশো টাকা লাগবে প্রবেশদক্ষিণা হিসেবে। কলুক্কুমালাই পাহাড়শীর্ষে পৌঁছোতে হলে একটি বেসরকারি চা-বাগানের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। প্রতি গাড়ি থেকে পাঁচশো টাকা করে নেয় তারা। অর্থাৎ এই গোটা সফরের জন্য আপনার পকেট থেকে খসবে মোট আড়াই হাজার টাকা। তবে অসাধারণ কিছু দেখতে হলে এবং অসাধারণ অভিজ্ঞতার সাক্ষী হতে হলে একটু খরচা তো করতেই হয়, তাই না!

চারটের কিছু আগেই হোটেলের সামনে জিপ নিয়ে হাজির প্রবীণ। রতীশও রয়েছে আমাদের সঙ্গে। আকাশ মেঘলা। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হচ্ছে। আমরা বেরিয়ে পড়লাম। না, মুন্নারের পথে নয়। ঠিক তার উলটো পথে। দু’ দিকের পাহাড়-ঢালে চা-বাগানকে রেখে মাঝের পিচ রাস্তা দিয়ে আমরা এগিয়ে চললাম ৯ কিমি দূরের সূর্যনেলি শহরের দিকে। কেরলের সীমানায় অবস্থিত সূর্যনেলি তামিলনাড়ুতে।

দোকানের সাইনবোর্ডে তামিল দেখে বুঝে গেলাম আমরা সূর্যনেলি চলে এসেছি। এখান থেকেই উঠতে হবে কলুক্কুমালাই। জিপ পিচরাস্তা ছেড়ে বাঁ দিকের বাঁধানো কংক্রিটের রাস্তা ধরল। মিনিট খানেকের মধ্যেই আমরা পৌঁছে গেলাম চা প্রস্তুতকারী বেসরকারি সংস্থা, হ্যারিসন প্ল্যান্টেশন-এর প্রবেশদ্বারে। এখানে নিয়মমাফিক কিছু কাজ সারতে হল। একটা ফর্ম পূরণ করতে হল। প্রবেশমূল্য দিতে হল ৫০০ টাকা।

এই হল ‘অফ-রোড’।

চা-বাগানের মধ্য দিয়ে শুরু হল চড়াই ভাঙা। পথ কংক্রিটের। সবুজ চা-বাগিচার মাঝে একটার পর একটা হেয়ারপিন বেন্ড। আমরা ক্রমশ উপরে উঠছি। কিছুক্ষণের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম হ্যারিসন প্ল্যান্টেশনের চা তৈরির কারখানায়। এখানে কিছুক্ষণের বিরতি।  

বিরতির পর আবার চড়াই ভাঙা শুরু। হ্যারিসনের এলাকা ছাড়িয়ে ঢুকে গেলাম কলুক্কুমালাই চা-বাগানের মধ্যে। চা-বিশ্বে এক বিশেষ খ্যাতি রয়েছে কলুক্কুমালাই টি এস্টেটের। এটি হল বিশ্বের সর্বোচ্চ চা-বাগান। বিশ্বের সর্বাধিক উচ্চতায় চা-প্রস্তুতকারী কারখানাও এই কলুক্কুমালাইতে। সমুদ্রতল থেকে প্রায় ৮ হাজার ফুট উচ্চতায়।

আমরা কংক্রিটের রাস্তা ধরেই চলেছি। পথ মসৃণই। এখনও বুঝতে পারছি না কেন জিপে সওয়ার হওয়ার প্রয়োজন পড়ল। চড়াই ভাঙছি বটে, কিন্তু চলেছি আরামেই। আসলে আমাদের কোনো ধারণাতেই ছিল না, এই রাস্তা পাড়ি দিতে হলে কতটা চোখের জলে নাকের জলে হতে হবে।

কংক্রিটের রাস্তা শেষ। শুরু হল আমাদের ‘অফ-রোড অ্যাডভেঞ্চার’। ‘অফ-রোড’ মানে রাস্তা আর নেই। শুধু পাথর আর পাথর। তার ওপরে দিয়েই এগিয়ে চলেছে জিপ। ঝাঁকুনির চোটে প্রাণ ওষ্ঠাগত। এক এক সময় মনে হচ্ছে এই রাস্তায় জিপে আসার চেয়ে হেঁটে আসাই ভালো। তবে এই পথে ভ্রামণিকরা ট্রেকিংও করেন, তবে সেটা ভোরের দিকে।

মেঘ ঢেকে দিচ্ছে চা-বাগান।

তীব্র ঝাঁকুনি সহ্য করেই উঠে চলেছি আমরা। কোমরে বেশ যন্ত্রণা হচ্ছে। আর যেন বসে থাকা যাচ্ছে না। মাঝে মাঝে ঝাঁকুনির জেরে জিপের চালে মাথা ঠুকে যাচ্ছে। তবে কষ্ট করলে তো কেষ্ট মেলে। এই কষ্টকে হার মানিয়ে দিচ্ছে এক একটা জায়গা থেকে দৃশ্য। যত উঠছি, পাহাড়ের চূড়াগুলো তত কাছে আসছে, আর নীচে দেখছি মুন্নার এবং সূর্যনেলি শহর ক্রমশ নীচে নেমে যাচ্ছে। মাঝেমধ্যে চা-বাগানের ট্র্যাক্টরগুলো পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছে। দিনাবসানের মুহূর্তে চা-বাগানের কর্মীরাও নিজেদের কাজ সেরে ফিরে যাচ্ছে। কিন্তু রাস্তা যেন আর শেষ হয় না।

অবশেষে একটা হেয়ারপিন বাঁকের মুখে এসে গাড়ি থামিয়ে দিল প্রবীণ। নীচের কারখানাটা থেকে রওনা হওয়ার পর ঘণ্টা খানেক কেটে গিয়েছে। পরে গুগুল ম্যাপে সার্চ করে দেখেছি, সূর্যনেলি থেকে কলুক্কুমালাই হিল টপ মাত্র ৬ কিমি। এই পথটুকু পাড়ি দিতে সময় লাগল প্রায় এক ঘণ্টা। এতেই বোধহয় মালুম হচ্ছে, কী পথে এসেছি আমরা।

ঘড়িতে এখন সাড়ে ৫টা। কলকাতার সাড়ে ৫টা আর কেরলের সাড়ে ৫টার মধ্যে বিস্তর ফারাক। এখানে পুরোপুরি অন্ধকার নামে সওয়া সাতটা নাগাদ। সুতরাং জায়গাটাকে ভালো করে ঘুরে দেখার জন্য এখনও অন্তত এক ঘণ্টা আমাদের হাতে রয়েছে।

“এই জঙ্গলটার মধ্যে দিয়ে মিনিট পাঁচেক হাঁটলেই হিল টপটা পেয়ে যাবেন।”

গাড়ি থেকেই নেমে প্রথমেই শরীরের ব্যথা মারার চেষ্টা করলাম। তার পর প্রবীণের কথামতো এক জঙ্গুলে পথ দিয়ে এগোতে থাকলাম। আমাদের গন্তব্য, কলুক্কুমালাই হিলটপ।

হিল টপ থেকে।

অবশেষে পৌঁছে গেলাম সেই গন্তব্যে। এই হিলটপটা আদতে একটা গিরিখাত তথা রিজ। দু’ দিকেই খাদ। পূর্ব দিকটা তামিলনাড়ু আর পশ্চিমে কেরল। তবে তামিলনাড়ুর দিকটা খাড়া নেমে গেছে একদম সমতলে আর কেরলের দিকটা নেমেছে বড়ো জোর হাজার তিনেক ফুট।

আরও কিছুটা এগিয়ে যেতেই জাগুয়ার রক। মানে পাহাড়ের গায়ে পাথরের গঠনটা এমন ভাবে হয়েছে, ঠিক মনে হয় যেন জাগুয়ার ‘হাঁ’ করে রয়েছে আমাদের দিকে।

এখান থেকে অপরূপ সূর্যোদয়ের সাক্ষী হওয়া যায়। সূর্যোদয়ের জন্য কলুক্কুমালাই বিখ্যাত। আসলে পূর্ব দিকটা পুরো ফাঁকা, সে কারণেই সূর্যোদয়ের দৃশ্য এখান থেকে অসাধারণ। তবে সূর্যোদয়ের সাক্ষী থাকতে হলে মুন্নার থেকে অন্তত ভোর সাড়ে তিনটে নাগাদ রওনা হতেই হবে।

তামিলনাড়ুর দিক থেকে মেঘ এসে আমাদের ঢেকে দিচ্ছে। মাঝেমধ্যেই এক-দু’ ফোঁটা করে বৃষ্টিও পড়ছে। সেই সঙ্গে বইছে কনকনে হাওয়া। এ বার আমাদের নীচে নামতে হবে। কারণ দিনের আলো থাকতে থাকতেই পেরিয়ে যেতে হবে ‘অফ-রোড’।

জাগুয়ার রক।

কিন্তু যা ভাবা যায় তা কি সব সময় হয়? একটার পর একটা উতরাই ভেঙে নেমে আসছি। এর পরেই আচমকা একটা বাধা। চা বাগানের একটা ট্র্যাক্টর খারাপ হয়ে দাঁড়িয়ে গিয়েছে রাস্তায়। পুরো রাস্তাটাই ও আটকে দিয়েছে। ওকে না সরালে কোনো ভাবেই আমরা আর এক চুলও এগোনো যাবে না।  

দিনের আলো পুরোপুরি কমে এসেছে। অন্ধকার নামল বলে। আর অন্ধকার নামলে টুকটাক চিতাবাঘের আনাগোনা যে হতে পারে, সেটা আগেই জেনে এসেছি।

ট্র্যাক্টরটাকে সারানোর কাজ চলছে পুরোদমে। আমাদের সারথিও হাত লাগিয়েছে। উপায়ান্তর না দেখে নেমে পড়লাম জিপ থেকে। আর তখনই একটা অসাধারণ দৃশ্য ধরা দিল চোখের ক্যামেরায়। পেছনের ঢাল বেয়ে নেমে এসেছে চা-বাগান, বাগানের ওপরে ভেসে বেড়াচ্ছে মেঘ। অন্ধকার হওয়ার মুহূর্তে একটা অসাধারণ ছবি।

ট্র্যাক্টরটা ঠিক হতেই আমাদের নামা শুরু হল। সূর্যনেলিতে চা-পানের বিরতি দিয়ে কুয়াশামাখা অন্ধকার পথে ফিরে চললাম চিনাকানাল। পেছনে পড়ে থাকল রোমাঞ্চে ভরা কলুক্কুমালাই। (চলবে)

ছবি: শ্রয়ণ সেন

আরও পড়তে পারেন

ভগবানের আপন দেশে ৭ / ঘুরে এলাম টপ স্টেশন

ভগবানের আপন দেশে ৬ / পৌঁছে গেলাম মেঘে ঢাকা মুন্নারে  

ভগবানের আপন দেশে ৫/ সন্ধ্যা কাটল মাত্তানচেরি, ফোর্ট কোচিনে

ভগবানের আপন দেশে ৪/ সেই আরুকুট্টি হারিয়ে গিয়েছে

ভগবানের আপন দেশে ৩/ আরুরের ‘চিনাভালা’য়

ভগবানের আপন দেশে ২/ কোচি ছুঁয়ে এলাম আরুরে

ভগবানের আপন দেশে ১/ আথিরাপ্পিল্লি দেখে কোচির পথে

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *