ভগবানের আপন দেশে ৭ / ঘুরে এলাম টপ স্টেশন  

view from Top Station

শম্ভু সেন

একুশ বছর আগেকার আপশোশটা মিটিয়ে নিলাম এ বার, এই মুন্নারে এসে। ব্যাপারটা খোলসা করেই বলি।

সে বার মুন্নারে তিনটে দিন ছিলাম। ফলে সব ক’টা দ্রষ্টব্যই আমাদের দেখা হয়েছিল। এমনকি, যে দ্রষ্টব্য তখন তেমন জনপ্রিয় ছিল না, তাও আমাদের ভ্রমণসূচি থেকে বাদ থাকেনি। কিন্তু যেতে পারিনি টপ স্টেশনে, কেরল-তামিলনাড়ুর সীমানায় মুন্নারের অন্যতম সুন্দর ভিউপয়েন্টে। পুজোর পরে পরেই এসেছিলাম সে বার। কিন্তু প্রবল বৃষ্টি আমাদের সাধে বাধ সেধেছিল। বৃষ্টির জন্য টপ স্টেশনের রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়।

তাই এ বার মুন্নারে এসে প্রথম লক্ষ্য ছিল টপ স্টেশন। অন্য কোনো জায়গা দেখা হোক ছাই না হোক, টপ স্টেশন যাবই। আর সেই আশা পূরণ হল।

কুন্ডলা ড্যামের পথ ধরে হাঁটা।

মুন্নারে গত কাল কার্যত অলসই কাটিয়ে দিলাম। কোচি থেকে পৌঁছোতে পৌঁছোতে দুপুর হয়ে গিয়েছিল। খাওয়াদাওয়া সেরে হোটেলের বারান্দায় বসে প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ করছিলাম। কখনও মেঘ, কখনও আলো। এক এক সময় মেঘের পুরোপুরি আড়ালে ঢেকে যাচ্ছে চিনাকানাল। কিছুক্ষণ পরেই সেই মেঘ সরে গিয়ে সবুজ চা-বাগানগুলো বেরিয়ে আসছে। মাঝে মাঝে বৃষ্টিও পড়ছে। ঠান্ডাটাও বেশ মনোরম।

গত বারের মতো এ বারেও রয়েছি চিনাকানালে। ফলসের থেকে জায়গার নাম। মুন্নার থেকে কুড়ি কিলোমিটার দূরে এই চিনাকানাল। একুশ বছরে খুব পালটায়নি এই চিনাকানাল।

আজ সকালে প্রাতরাশের পরেই বেরিয়ে পড়লাম। টপ স্টেশনের পথে। কাল যে রাস্তায় মুন্নার থেকে চিনাকানাল এসেছিলাম, সে রাস্তায় মুন্নার এলাম।  

মুন্নারের মোড়ে নজরে পড়ল এখানকার দ্রষ্টব্য স্থানগুলোর দিকনির্দেশ সংক্রান্ত বোর্ড। তালিকার প্রথমেই রয়েছে এরাভিকুলাম জাতীয় উদ্যান। নীলগিরি থরের জন্য বিখ্যাত এই জাতীয় উদ্যান। মনে পড়ে গেল একুশ বছর আগে সেই দিনটার কথা, যে দিন পাহাড়ি পথ বেয়ে হাঁটার সময় থরে থরে থর আমাদের ঘিরে ধরেছিল। ভীষণ আদুরে এই প্রাণীগুলো। এরা ভেড়া আর ছাগলের মিশ্রণ। মুন্নার শহর থেকে মাত্র ৮ কিমি দূরে এরাভিকুলাম জাতীয় উদ্যানের প্রবেশফটক।

টপ স্টেশন থেকে।

এরাভিকুলামের পথ বাঁ দিকে রেখে থরদের সঙ্গে সেই আলাপের কথা ভাবতে ভাবতেই আমরা চলেছি টপ স্টেশন। এই পথেও এসেছিলাম একুশ বছর আগে, দেখেছিলাম মাট্টুপেট্টি, ইকো পয়েন্ট, কুন্ডলা ড্যাম। কুন্ডলা ড্যাম ছাড়িয়ে টপ স্টেশনের পথ। বৃষ্টি সে বার বাধা দিয়েছিল। এ বারেও বৃষ্টি আমাদের সঙ্গী। সে তো হবেই, এ তো বর্ষাকাল। আমরা তো জেনেশুনেই বর্ষার কেরল দেখতে এসেছি।

বৃষ্টি হচ্ছে ঝিরিঝিরি, তবে আমাদের ভ্রমণে কোনো বাধা সৃষ্টি করেনি এখনও পর্যন্ত। কুয়াশামাখা রাস্তা ধরে ক্রমশ উঠছি। কিন্তু এখনও মুন্নার শহরের সীমার মধ্যেই রয়েছি। শহর বেশ বেড়েছে। অনেকটা উঠে আসার পরেও হোটেল এবং রিসর্টের ছড়াছড়ি। তবে জঙ্গলও রয়েছে বেশ ভালোই। আর তাই হাতির ব্যাপারে সতর্ক থাকার অনুরোধ জানিয়ে কয়েক কিলোমিটার অন্তর রয়েছে সাইনবোর্ড। টপ স্টেশন থেকে ফেরার পথে আচমকাই হাতির দেখা পেয়ে যাব, ভাবতেই পারিনি। সে কথায় পরে আসছি।

টপ স্টেশন থেকে।

পথেই পড়ল মাট্টুপেট্টি জলাধার আর ইকো পয়েন্ট। মুন্নারের খুব গুরুত্বপূর্ণ জলাধার এই মাটুপেট্টি। চারি দিক পাহাড়ে ঘেরা এই জলাধারে প্রাকৃতিক কারণেই প্রতিধ্বনি হয়। হ্রদের এ-পার থেকে চিৎকার করলে, ও-পারের পাহাড়ে ধাক্কা খেয়ে তা ফিরে আসে। এখানে সেই পরীক্ষায় ব্যস্ত থাকেন অনেক পর্যটক। ইকো পয়েন্ট থেকে আরও কিছুটা এগোতেই কুন্ডলা জলাধার।

কুন্ডলা জলাধারকে পাশে রেখে আরও এগিয়ে চললাম। চা-বাগানের মধ্যে দিয়ে পিচ রাস্তা ধরে আরও উপরে উঠে পৌঁছে গেলাম টপ স্টেশনের দোরগোড়ায়। তামিলনাড়ু পর্যটন দফতরের বোর্ড দেখে বুঝতে পারলাম, আমরা কেরল ছেড়ে তামিলনাড়ুতে ঢুকে পড়েছি। টপ স্টেশন মুন্নার শহর থেকে ৩৫ কিলোমিটার দূরে। আর আমরা যে হেতু আছি মুন্নার শহর থেকে ২০ কিমি দূরের চিনাকানালে, তাই আমাদের ৫৫ কিমি পথ পাড়ি দিতে হল।

ব্রিটিশ রাজত্বে যখন চা-বাগান চালু হয়েছিল, তখন বিভিন্ন চা-বাগান থেকে চা-পাতা তুলে রোপওয়েতে করে আনা হত। সেই কারণে তিনটি স্টেশন বানানো হয়েছিল, বটম স্টেশন, সেন্ট্রাল স্টেশন ও টপ স্টেশন। বটম আর সেন্ট্রাল স্টেশন ভ্রামণিকদের জন্য জনপ্রিয় নয়। তবে টপ স্টেশন থেকে যে দৃশ্য দেখা যায়, এক কথায় তা অনবদ্য।

টপ স্টেশন থেকে।

ইকো পয়েন্ট থেকে আরও কিছুটা এগোতেই কুন্ডলা জলাধার। এখানেও তৈরি হয়েছে একটি হ্রদ। এই কুন্ডলা হ্রদকে ভারতের একটি অন্যতম পরিচ্ছন্ন লেক হ্রদ বলা হয়। হ্রদের জলে পা ডুবিয়ে রাখার মজাই এখানে আলাদা।

গাড়ি যেখানে পৌঁছে দিল, সেখান থেকে কয়েক মিনিট হাঁটাপথে ভিউ পয়েন্ট। সেখানে রয়েছে একটি নজরমিনার, তামিলনাড়ু পর্যটন দফতরের তৈরি। তবে এই হাঁটাপথটি একটা রিজ অর্থাৎ গিরিখাতের ওপর দিয়ে গিয়েছে। দু’ দিকে খাদ, মাঝখান দিয়ে পায়ে চলা রাস্তা। কিন্তু পথের দু’ পাশেই দোকানের সারি। তাই সেই ভাবে উপভোগ করা গেল না সেই গিরিখাতকে।  

তবে নজরমিনার দুঃখ কিছুটা ভুলিয়ে দিল। বেশ সুন্দর দৃশ্য উপভোগ করলাম। এক দিকে পশ্চিমঘাট পর্বতশ্রেণির সুউচ্চ শৃঙ্গ, অন্য দিকে তামিলনাড়ুর থেনি জেলার উপত্যকা। বেশ কিছুটা সময় এই নজর মিনারে কাটিয়ে ফিরে চললাম চিনাকানালের উদ্দেশে।

কুন্ডলা ড্যাম।

পথে সেই হস্তিদর্শন। কুন্ডলা ড্যামে খানিকক্ষণ কাটিয়ে চলেছি মুন্নারের পথে। রাস্তার ধারে একটা জায়গায় বেশ ভিড় দেখে রতীশ গাড়ি থামিয়ে দিল। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, পাশের জঙ্গল থেকে হাতি বেরিয়ে এসেছে। রাস্তার ধারে একটা বাগানে সে ঘুরে বেড়াচ্ছে। অন্য ভ্রামণিকদের দেখাদেখি আমরাও বেরিয়ে পড়লাম গাড়ি থেকে, ওই গজরাজকে এক ঝলক দেখার জন্য। কিছুক্ষণের জন্য দাঁড়িয়ে আবার পথ চলা শুরু। বিকেলেই একটা রোমাঞ্চকর যাত্রায় বেরোতে হবে। (চলবে)

ছবি: শ্রয়ণ সেন

আরও পড়তে পারেন

ভগবানের আপন দেশে ৬ / পৌঁছে গেলাম মেঘে ঢাকা মুন্নারে  

ভগবানের আপন দেশে ৫/ সন্ধ্যা কাটল মাত্তানচেরি, ফোর্ট কোচিনে

ভগবানের আপন দেশে ৪/ সেই আরুকুট্টি হারিয়ে গিয়েছে

ভগবানের আপন দেশে ৩/ আরুরের ‘চিনাভালা’য়

ভগবানের আপন দেশে ২/ কোচি ছুঁয়ে এলাম আরুরে

ভগবানের আপন দেশে ১/ আথিরাপ্পিল্লি দেখে কোচির পথে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *