ভগবানের আপন দেশে ৪/ সেই আরুকুট্টি হারিয়ে গিয়েছে

Chellanam Beach

শম্ভু সেন

সারা রাতই যে বৃষ্টি পড়েছে, তা ঘুমের মধ্যেই টের পেয়েছি। মাঝেমধ্যেই ঘুম ভেঙেছে আর বৃষ্টি পড়ার শব্দ শুনেছি। কেরলে বর্ষার যে ঘাটতি চলছে, তা বোধহয় পুষিয়ে গেল।

খুব ভোর ভোর ঘুম ভেঙে গেল। ঘরের বাইরে বেরিয়ে দেখি, বৃষ্টি নেই, তবে আকাশের মুখ বেশ ভার। গাড়িবারান্দায় বসে ভোরের বেম্বানাড় উপভোগ করছিলাম। এখন বোধহয় ভাটার সময়। জলপ্রবাহের গতি দেখে তা-ই মনে হল।

একটু পরেই ঋভু বেরিয়ে এল। প্রথমেই আকাশের দিকে নজর। কী বুঝছিস? ঋভু আবহাওয়া-টাবহাওয়া নিয়ে কী সব স্টাডি করে। আমার প্রশ্নের উত্তরে আশ্বাস দিল, এখন বৃষ্টি হবে না। কী করে বুঝল ওই জানে।

একটু হেঁটে আসবে? ঋভুর প্রস্তাবে সাড়া দিলাম। কলকাতায় তো এত ভোরে হাঁটা হয় না। ঋভু আশ্বাস দিয়েছে বটে, তবু বিশ্বাস নেই। হাতে ছাতা নিয়েই বেরিয়ে পড়লাম।

প্রধান ফটক থেকে বেশ কিছুটা গলিপথ। না, ঠিক গলি বলতে যা বোঝায় তা নয়। সরু রাস্তা বলা চলে। এই পথে তো মোটরগাড়ি চলাচল করে। বাঁ-দিক ডান-দিক করতে করতে মূল সড়কে এসে পড়লাম। কাল ঠিক বুঝিনি। মূল সড়ক থেকে আমাদের হোমস্টে বেশ কিছুটা দূরে। অন্তত আধ কিলোমিটার তো হবেই।

এটা জাতীয় সড়ক – বাঁ দিকে গিয়েছে আলাপুঝা আর ডান দিকে বেম্বানাড় পেরিয়ে কোচির পথে। হাঁটতে হাঁটতে বেম্বানাড়ের ব্রিজের কাছে চলে এলাম। এ বার ফেরার পথ ধরলাম। রাস্তার উলটো দিকে বেশ সুন্দর একটা চার্চ – আরুর চার্চ। আজ রবিবার। তাই বেশ লোক সমাগম হয়েছে।

আরুর চার্চ।

ফিরে এসে প্রাতরাশ সারলাম। প্রাতরাশের মেনুতে রয়েছে আপম আর এগ কারি। কেরলের স্টাইলে বেশ মশলাদার করে বানানো ডিমের পদটা। আর আপম, চালগুঁড়ি দিয়েই বানানো একটা পদ, কেরলের অন্যতম নিজস্ব খাদ্য। আপম আগেও খেয়েছি, কিন্তু চিনাভালার আপম আরও টেস্টি।

আজ সকালের ভ্রমণসূচিতে রয়েছে আরুকুট্টি গ্রাম আর চেল্লানাম বিচ ও ফিশিং হারবার।

না, আরুকুট্টি গ্রাম কোনো ট্যুরিস্ট স্পট নয়। এ হল আমার একান্ত আপন একটি জায়গা, এর আগে এখানে এসেছিলাম ২০০১ সালে। এই গ্রামের সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমার অনেক স্মৃতি। আরুকুট্টি আমার অত্যন্ত প্রিয় অগ্রজ সহকর্মী নায়ারদার গ্রাম। লেখক-সাংবাদিক গোপালন বিক্রমণ নায়ার। নায়ারদা আনন্দবাজার পত্রিকার বর্ষীয়ান সাংবাদিক, ‘পশ্চিম দিগন্তে প্রদোষকালে’ এবং ‘দুই ইউরোপের দিনলিপি’ গ্রন্থ দু’টির লেখক। 

কত কথা মনে পড়ছে। নায়ারদা তখন আমাদের কলকাতা অফিস থেকে বদলি হয়ে চলে এসেছেন চেন্নাইয়ে, আনন্দবাজার পত্রিকার বিশেষ সংবাদদাতা হিসাবে। আমাকে খুব স্নেহ করতেন। নায়ারদার কাছেই আমি মালায়ালাম ভাষায় পাঠ নেওয়া শুরু করেছিলাম। নায়ারদা চেন্নাইয়ে বদলি হতেই প্ল্যান করলাম চেন্নাই যাব বেড়াতে, সঙ্গে কেরল। এবং সেই ভ্রমণে অবশ্যই থাকবে নায়ারদার গ্রাম। নায়ারদার কাছেই শুনেছিলাম গ্রামের নাম আরুকুট্টি, কোচি থেকে ফেরিতে যেতে লাগে ঘণ্টা দেড়েক।

২০০১-এর নভেম্বরের এক বিকেল। চেন্নাই সেন্ট্রাল স্টেশনে নায়ারদা হাজির। আমাদের নিয়ে গেলেন তাঁর চেন্নাই-আবাসে। নায়ারদাকে নিয়েই একদিন পরেই বেরিয়ে পড়লাম। গন্তব্য কেরল। নায়ারদারই ব্যবস্থাপনায় কয়েকটা দিন এর্নাকুলামে কাটালাম। তার পর চললাম আরুকুট্টি।  

টুরিস্ট স্পট তো কত দেখেছি, কিন্তু অন্য রাজ্যের গ্রাম দেখতে যাব। সকাল থেকে একটা অন্য রকম অনুভূতি হচ্ছিল সে দিন। ঘণ্টা দেড়েকের জলভ্রমণের পর পৌঁছে গেলাম আরুকুট্টিতে। জেটি থেকে নায়ারদার বাড়ি খুব দূরে ছিল না। আমরা হেঁটেই চলে এলাম।  কাউকেই চিনি না। কিন্তু সবাই আমাদের এমন ভাবে স্বাগত জানালেন যেন কত দিনের পরিচয়। নায়ারদা মা-ও ছিলেন। আমরা আসব বলে কালাড়ি থেকে নায়ারদার বোন-ভগ্নিপতি এসেছেন। অন্যরা ইংরেজি জানলেও, নায়ারদার মা মালায়ালাম ছাড়া কিছু বলতে পারেন না। কিন্তু আমার স্ত্রী টুকাইকে এমন ভাবে আপন করে নিলেন, যেন মনে হচ্ছে কত দিনের পরিচিত দু’ জনে। নায়ারদার মা কথা বলছেন মালায়ালামে, টুকাই-ও হেসে ঘাড় নেড়ে প্রত্যুত্তর করছে ইংরেজিতে। 

চেল্লানাম মৎস্যবন্দর।

গ্রাম বলতে যা বোঝায়, আরুকুট্টি সে রকম ছিল না। প্রতিটা বাড়িই পাকা, সামনে বাগান। সব বাড়ির সামনেই হয় গাড়ি, নয় বাইক। দু’-একটা মন্দির, একটা বড়ো গির্জা। একটা ছোট্ট কারখানাও চোখে পড়ল। সবাই মহিলাকর্মী।

দুপুরের খাবারে কী এলাহি আয়োজন হয়েছিল ভাবা যায় না। ভাত, ডাল, তরকারির পাশাপাশি ছিল রুই আর পমফ্রেট। অবশ্যই নারকেল তেলের রান্না। কিন্তু সেই নারকেল তেলের রান্না স্বাদে অপূর্ব। আসলে রান্নায় বিভিন্ন মশলার পাশাপাশি যে অনেকখানি ভালোবাসা মেশানো ছিল।

একটা দিন-রাত কাটিয়েছিলাম নায়ারদার বাড়িতে। গল্পে-আড্ডায় কোথা দিয়ে যে সময় কেটে গিয়েছিল বুঝতেই পারলাম না। ফেরার সময় নায়ারদার মায়ের চোখে জল দেখেছিলাম। নায়ারদাও আমাদের সঙ্গে এর্নাকুলাম ফিরে আসছেন, হয়তো সে কারণেই মায়ের মন খারাপ। এই ছেলেই তো স্কুলের পড়া শেষ করে চলে এসেছিলেন শান্তিনিকেতনে, রবীন্দ্রনাথের টানে। সেখানে পড়াশোনা করে আসেন যাদবপুরে। ফের পড়া। তার পর সাংবাদিক। সেই নায়ারদা দু’ বছর পরেই আমাদের সকলকে ছেড়ে চলে গেলেন। খুব বেশি বয়স তো হয়নি। মেরেকেটে ৬৫। মা তো তখন রয়েছেন।

এ বার কেরল ভ্রমণে এসে সেই আরুকুট্টি ভীষণ মন টানছিল। কোচিকে বলা হয় ‘আইল্যান্ড সিটি’, অর্থাৎ দ্বীপের শহর। বেম্বানাড় হ্রদের মধ্যে অসংখ্য ছোটো-বড়ো দ্বীপ নিয়ে কোচির বিস্তার। তেমনই একটি দ্বীপে যেমন আরুর, তেমনই আর-একটি দ্বীপে আরুকুট্টি। আগে এই সব দ্বীপ-শহরের মধ্যে যাতায়াতের মাধ্যম ছিল ফেরি। এখন প্রায় সব দ্বীপ সেতুতে সংযুক্ত। বেনি বলে দিয়েছেন আরুর থেকে মাত্র দশ মিনিটের ড্রাইভেই পৌঁছে যাওয়া যাবে সেখানে। প্রাতরাশের পর্ব চুকিয়ে রতীশের কথামতো বেরিয়ে পড়লাম।

চিনাভালা হোমস্টে থেকে বেরিয়ে খানিকটা গিয়ে বাঁ দিকে ঘুরলাম। কিছুটা গিয়ে অডিটোরিয়ামের পাশ দিয়ে গিয়ে ডান দিক। আবার একবার ডান দিক, আর এক বার বাঁ দিক করে চলে এলাম আলাপুঝাগামী জাতীয় সড়কে। কিছুটা গিয়েই আরুকুট্টি, আরুর থেকে খুব বেশি হলে ৪ কিলোমিটার।

কিন্তু না, কিছুই চিনতে পারলাম না আরুকুট্টির। বেম্বানাড়ের ওপরে সেতু পেরিয়ে আরুকুট্টি ঢুকতেই একটা ধাক্কা খেলাম। আরুকুট্টি তখন ছিল গ্রাম, এখন পুরোদস্তুর শহর। ক্লাব মাহিন্দ্রার বিলাসবহুল রিসর্ট এই আরুকুট্টিকে আরও বিখ্যাত করেছে। সব মিলিয়ে এলাহি ব্যাপার।

কোনো রকমে সেই গির্জার কাছে পৌঁছোলাম। গির্জার তো অনেক ভোল বদল হয়েছে। এই গির্জার কাছেই ছিল নায়ারদার বাড়ি। একতলা টালির চালের বাড়ি, অনেকটা খোলামেলা জায়গা। রতীশকে সঙ্গে নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করলাম। কিন্তু কিছুই ঠাওর করতে পারলাম না। স্থানীয় মানুষজনের সঙ্গে কথা বলেও কিছু হদিশ করতে পারলাম না। কাউকে দোষ দেওয়া যায় না। যে নায়ারদা স্কুলের পাট চুকিয়েই চলে এসেছিলেন শান্তিনিকেতনে এবং এই বাংলাতেই যাঁর কর্মকাণ্ড, তাঁকে তাঁর নিজের গ্রাম মনে রাখবে না, সেটাই তো স্বাভাবিক!

বিফল মনোরথ হয়ে চললাম পরবর্তী গন্তব্যের উদ্দেশে – চেল্লানাম সৈকত ও ফিশিং হারবার। আরুকুট্টি থেকে ১৫ কিলোমিটার।

কিছুটা অনামা এই সৈকত ও হারবার। তথাকথিত ট্যুরিস্টদের পা খুব একটা পড়ে না এখানে। তবে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর এই জায়গা। এখানে এলে ঠকবেন না, এটুকু আশ্বাস দেওয়াই যায়।

ব্যবসায়িক কাজকর্ম চলছে প্রচুর। সার দিয়ে মাছ ধরার ট্রলার বাঁধা। এখান থেকে বহু ট্রলার প্রতিনিয়ত ভেসে পড়ে সমুদ্রের বুকে মাছের সন্ধানে। চেল্লানামের চেহারাটা অনেকটাই আমাদের পটুয়াখালির মতো। পটুয়াখালি, কাঁথির কাছে মৎস্যবন্দর।

বেলা বেশ অনেকটাই হয়ে গিয়েছে। বেনি রাফেলকে বলা ছিল, বাইরেই মধ্যাহ্নভোজ সেরে নেব। সেইমতো আরুরে এসে গতকালের সেই রেস্তোরাঁতেই দুপুরের আহার সেরে নিলাম। তবে পদ আর ভাত-মাছ নয়, ওনিয়ন উত্তপম। (চলবে)

আরও পড়তে পারেন

ভগবানের আপন দেশে ৩/ আরুরের ‘চিনাভালা’য়

ভগবানের আপন দেশে ২/ কোচি ছুঁয়ে এলাম আরুরে

ভগবানের আপন দেশে ১/ আথিরাপ্পিল্লি দেখে কোচির পথে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *