ভগবানের আপন দেশে ৫/ সন্ধ্যা কাটল মাত্তানচেরি, ফোর্ট কোচিনে

Chinese Fishing Nets

শম্ভু সেন

কোচির দ্রষ্টব্য বলতেই বোঝায় বেম্বানাড় হ্রদের ধারে চাইনিজ ফিশিং নেট, মাত্তানচেরি প্রাসাদ, সিনাগগ, সেন্ট ফ্রান্সিস চার্চ। কোচি এলেই এগুলো দেখা চাই-ই। আমার তো কোচি আসা কম বার হল না, কিন্তু কোনো বারই এই দ্রষ্টব্যগুলো বাদ যায়নি। এ বারও তার অন্যথা হল না।

দুপুরে একটা ছোট্ট ভাতঘুম (যদিও দুপুরের আহারে ভাত ছিল না) দিয়ে রতীশকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। সকালে যে পথে আরুকুট্টি গিয়েছিলাম, এ বার আর সে পথ নয়। এমনকি গতকাল যে পথে বেম্বানাড়ের সেতু পেরিয়ে আরুর ঢুকেছিলাম, সে পথও নয়। এ বার আমরা চলেছি বেম্বানাড়কে ডান দিকে রেখে।

চলে এলাম মাত্তানচেরি তথা কেরলের জু-টাউনে। জু-টাউন মানে ইহুদিদের শহর। নাম শুনেই বোঝা যায়, কোচির সঙ্গে ইহুদিদের একটা সম্পর্ক রয়েছে। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে, সেই সম্পর্ক দু’ হাজার বছরের পুরোনো। ৬৮ খ্রিস্টাব্দে এখানে ইহুদিদের প্রথম পা পড়ে।

জু-টাউন দিয়ে হাঁটা।

পঞ্চদশ এবং ষোড়শ শতাব্দীতে ইহুদিদের সংখ্যা আরও বাড়ে কোচির এই অঞ্চলে। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে আরবদেশ থেকেও কিছু ইহুদি পরিবার কোচির এই মাত্তানচেরি অঞ্চলে বসবাস শুরু করে। একই সম্প্রদায় হলেও তারা কিন্তু দু’টি নামে পরিচিত। প্রথম দিকে যারা এসেছিল, স্থানীয় লোকজনেরা তাদের মালাবারি ইহুদি বলে আর যারা পরে এসেছিল তারা পরদেশি ইহুদি নামে পরিচিত। পরদেশি অর্থাৎ বিদেশি।

শোনা যায়, ‘মাত্তানচেরি’ নামটির পিছনেও ইহুদিদের অবদান আছে। হিব্রু ভাষায় ‘মথন’ শব্দের অর্থ উপহার, আর মালায়ালাম ভাষায় ‘চেরি’ শব্দের অর্থ ভূমি বা দ্বীপভূমি। হিন্দু রাজা এই অঞ্চল মালাবারি ইহুদিদের উপহার দিয়েছিলেন। তাই নাম মাত্তানচেরি। তবে এই নামের আরও একটি ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। বলা হয় ‘মাত্তানচেরি’ নামটা এসেছে ‘আনচেরি মাত্তম’ থেকে। নাম্বুদিরি ব্রাহ্মণদের পৈতৃক বাড়িকে বলা হয় ‘আনচেরি মাত্তম’। বিদেশি বণিকরা তাকে বলত মট-আনচেরি। কালক্রমে তা হয়ে যায় মাত্তানচেরি।

এ সব ইতিহাস আপাতত থাক। এগিয়ে যাওয়া যাক জু-টাউনের রাস্তা ধরে। রাস্তার দু’ ধারে সাজানো দোকানপাট। অজস্র মুরাল, কারুকাজ করা কাঠ, তামা, পিতল ও পাথরের মূর্তি দিয়ে সুন্দর পরিপাটি করে সাজানো সব কিছু। রাস্তার ধারের আলো, টালির চালের বাড়ি – সব কিছু দেখলে মনে হবে, এ দেশে নয়, আমরা রয়েছি অন্য কোনো দেশে। এই শহরের কাঠ-পাথরে রয়েছে প্রাচীনত্বের ছোঁয়া।  

জু-শহরের সঙ্কীর্ণ রাস্তা দিয়ে আমরা এগিয়ে চলেছি সিনাগগের দিকে। সিনাগগ অর্থাৎ প্রার্থনাঘর। ১৫৬৭ সালে তৈরি হওয়া এই বিরাট অট্টালিকা নানা ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আজও দাঁড়িয়ে রয়েছে। বাড়িটায় পর্তুগিজ স্থাপত্যের ছাপ স্পষ্ট।

সিনাগগের গা ঘেঁষেই মাত্তানচেরি প্রাসাদ। প্রবেশদক্ষিণা দিয়ে ঢুকলাম প্রাসাদে। কেরলের স্থাপত্যশৈলীর সঙ্গে ঔপনিবেশিক স্থাপত্যশৈলীর মিশেলে তৈরি হয়েছে এই প্রাসাদ। এ এক অনন্য স্থাপত্যশৈলীর নজির। ১৫৪৫ সালে এই প্রাসাদটি তৈরি করে পর্তুগিজরা ভেট দেয় কোচির তৎকালীন রাজা বীর কেরল বর্মাকে। সেগুন কাঠের এই প্রাসাদপুরী ১৬৬৩-তে ডাচরা দখল করে নেয়। তাই একে ডাচ প্রাসাদও বলা হয়।

প্রাসাদটি বর্তমানে মিউজিয়াম। ভারতের পুরাতাত্ত্বিক সর্বেক্ষণ তথা এএসআই-এর তত্ত্বাবধানে রয়েছে এই প্রাসাদ-সংগ্রহশালা। প্রাসাদটি দোতলা। পুরোনো দিনের উঁচু ধাপওয়ালা বেশ কয়েকটা সিঁড়ি ভেঙে প্রবেশ করলাম। ১৮৬৪ থেকে কোচিনে যত জন রাজা হয়েছেন, তাঁদের সকলেরই প্রতিকৃতি রয়েছে এই মিউজিয়ামে। তাঁদের ব্যবহৃত অস্ত্রশস্ত্র, মুকুট, বসন-ভূষণ, আসবাবপত্র প্রদর্শিত হয়েছে। পাশাপাশি রামায়ণ, মহাভারতের গল্প, কালিদাসের কাব্য মুরালের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে এখানে। কোচি সাম্রাজ্যের কুলদেবী পাড়ায়ান্নুর ভাগবতীকে স্থান দেওয়া হয়েছে এই প্রাসাদে। গুরুভায়ুরের শ্রীকৃষ্ণর মুরালও রয়েছে প্রাসাদের দেওয়ালে।  

মাত্তানচেরি প্রাসাদ।

প্রাসাদ দেখে জু-টাউন ছেড়ে আমরা চললাম ফোর্ট কোচির উদ্দেশে। কোচি শহরের অন্যতম প্রাচীন এই অঞ্চলের নাম ফোর্ট কোচি কেন?

১৫০৩ সালে এখানেই একটি দুর্গ তৈরি করেছিল পর্তুগিজরা। নাম দিয়েছিল ফোর্ট এমানুয়েল। জানা যায়, কোচির তৎকালীন সম্রাট এবং পর্তুগিজ বণিকদের বন্ধুত্বের নিদর্শন এই দুর্গ। তবে পরবর্তী কালে এই দুর্গ পর্তুগিজদের হাত থেকে চলে আসে প্রথমে ডাচ তথা ওলন্দাজদের হাতে এবং পরে ব্রিটিশদের হাতে। উনিশ শতকে দুর্গের প্রায় অনেকটাই ধ্বংস করে ফেলে ব্রিটিশরা। সে কারণে ফোর্ট কোচি নামটা থেকে গেলেও সেই দুর্গের আর কার্যত কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না।

ফোর্ট কোচির অন্যতম বিখ্যাত দর্শনীয় স্থান হল সেন্ট ফ্রান্সিস গির্জা। ১৫০৩ সালে পেড্রো আলভারেজ ডি ক্যাব্রাল এই গির্জা নির্মাণ করেন। পারস্য শৈলীতে বানানো এই গির্জা। এর পরে এই শহরে এ রকম বেশ কিছু গির্জা তৈরি হয়।

আসল গির্জাটি ছিল সম্পূর্ণ কাঠের তৈরি এবং এর নাম ছিল সেন্ট বার্থোলোমিউ। পরে ১৫১৬ সালে এই গির্জাটি সংস্কার করা হয় এবং তখন এর নাম সেন্ট ফ্রান্সিস চার্চ। ইউরোপ থেকে ভারতে আসার সমুদ্রপথ আবিষ্কার করেন ভাস্কো-দা-গামা। তাঁর সমুদ্রপোত ভারতের মাটি ছোঁয় কেরলের কোঝিকোড় শহরে, ১৪৯৮ সালে। ভাস্কোর পরেই এখানে আসেন এই গির্জার প্রতিষ্ঠাতা ডি ক্যাব্রাল। তিনি কোচিনের রাজার অনুমতি নিয়েই এখানে একটি কেল্লা গড়েন এবং তার ভিতরেই তৈরি করেন এই গির্জা।

এই গির্জায় ঢুকলে প্রথমেই চোখে পড়বে একটা ক্রস। এ ছাড়া যেটি সব চেয়ে আকর্ষণীয় তা হল কাপড়ের ফ্যান। এ ছাড়া কাঠের সিলিং, ছাদ এবং মেঝের টাইলস আপনাকে নিয়ে যাবে কয়েক শো বছর আগে।

তৃতীয় বার ভারতে এসে মারা যান ভাস্কো-দা-গামা। সালটা ছিল ১৫২৪। তাঁর মৃত্যুর পর এই সেন্ট ফ্রান্সিস গির্জাতেই তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়। ১৪ বছর পরে তাঁর দেহ লিসবনে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু এখনও এই গির্জায় রয়েছে তাঁর সমাধিফলক।

সেন্ট ফ্রান্সিস চার্চ।

ফোর্ট কোচিতে সেন্ট ফ্রান্সিস গির্জার দক্ষিণে রয়েছে সান্তাক্রুজ ব্যাসিলিকা। ১৫৫৭-য় তৈরি ব্যাসিলিকা পরের বছর ক্যাথেড্রাল-এ রূপান্তরিত হয়। এই ক্যাথেড্রাল ব্রিটিশরা গুঁড়িয়ে দিলে ১৮৮৭-তে নতুন করে চার্চ তৈরি হয়। ১৯৮৪-তে পোপ জন পল এটিকে ব্যাসিলিকায় রূপান্তরিত করেন।

এর পর চলে এলাম বেম্বানাড়ের একেবারে ধারে চাইনিজ ফিশিংনেট দেখতে। হ্রদের ধারে নির্দিষ্ট কিছু দূরত্ব বরাবর লাগানো রয়েছে মাছ ধরার এই বিশেষ ধরনের জাল। ক্যান্টিলিভারধর্মী বাঁশের কাঠামোয় ছাকনির মতো ঝুলে থাকা চিনাবালা বা চিনা জাল। দক্ষিণ চিন, ইন্দোনেশিয়া ছাড়াও ভারতের এই কেরলে এই ধরনের জালের সাহায্যে মাছ ধরার প্রচলন রয়েছে।  

জানা যায়, চতুর্দশ শতকে চিনা অভিযাত্রীরা এই কোচিনে এসে এই পদ্ধতিতে মাছ ধরার প্রচলন করেছিলেন। এমনকি কোচিন নামটাও সেখান থেকেই এসেছে — কো-চিন, অর্থাৎ চিনের মতো। বর্তমানে এই শহরের নাম অবশ্য কোচি। চাইনিজ ফিশিংনেট থেকে সূর্যাস্তের দৃশ্য নয়নাভিরাম।  

এই ফিশিংনেটগুলোকে ডান দিকে রেখে বেম্বানাড়ের পাড় বরাবর সামনের দিকে হেঁটে চললাম। মিনিট পাঁচেক হাঁটার পরেই এসে পৌঁছোলাম মহাত্মা গান্ধী সৈকতে। আরব সাগর এবং বেম্বানাড় হ্রদের সংগমস্থলে এই সুন্দর সৈকতটি।

কোচির দু’টো দিন আমাদের বেশ ভালোই কাটল। কাল সক্কালেই বেরিয়ে পড়ব কোচি পরবর্তী গন্তব্য মুন্নারের উদ্দেশে। (চলবে)

আরও পড়তে পারেন

ভগবানের আপন দেশে ৪/ সেই আরুকুট্টি হারিয়ে গিয়েছে

ভগবানের আপন দেশে ৩/ আরুরের ‘চিনাভালা’য়

ভগবানের আপন দেশে ২/ কোচি ছুঁয়ে এলাম আরুরে

ভগবানের আপন দেশে ১/ আথিরাপ্পিল্লি দেখে কোচির পথে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *