শম্ভু সেন
সেই পথে আবার। আবার ২১ বছর পরে। তফাৎ শুধু একটাই। সে বার রওনা হয়েছিলাম এর্নাকুলাম শহরের একেবারে কেন্দ্রস্থল থেকে, আর এ বার কোচি শহরতলির পঞ্চায়েত এলাকা আরুর থেকে।
তখনও সকালের আলো ভালো করে ফোটেনি। আসলে পুবের সঙ্গে পশ্চিমের এটাই বড়ো তফাৎ। সকাল ৭টাতেও আলো সে ভাবে ফোটে না। সারথি রতীশের ভরসায় এগিয়ে চললাম কেরলের শৈলশহর মুন্নারের পথে।
বেম্বানাড়ের সেতু পেরিয়ে হাইওয়ে ছেড়ে দিলাম। চললাম মারাডু হয়ে। ডান দিকে পড়ে রইল কোট্টায়ামের পথ। এই শহরটার সঙ্গে আমার কিছু নস্টালজিয়া কাজ করে। প্রায় ৪০ বছর আগে এই কোট্টায়ামে কাটিয়ে গিয়েছিলাম দেড়টা মাস। সাংবাদিকতার কাজে।
অনেক পালটে গিয়েছে কোচি থেকে মুন্নারগামী এই পথ। সেটাই স্বাভাবিক। সে বার শহর যেন নিমেষেই ছাড়িয়ে গিয়েছিলাম। এ বার ত্রিপুন্নিতুরাতেও এসে দেখছি, কোচি শহরটা যেন গায়ে লেপটে রয়েছে। একে একে পেরিয়ে গেলাম পি কে বেবি জংশন, সিলভার ভ্যালি জংশন, চালিক্কারা, মুল্লেপেড়ি, বারিকোলি। একের পর এক শহর। ভূমি উঁচু-নিচু। সেই তালে রাস্তাও চলেছে। সমতল নেই বললেই চলে। সেই অল্প পাহাড়ি জমির ঢালে গড়ে উঠেছে শহুরে জনপদ।

ঋভুর সঙ্গে আলোচনা করছিলাম। সে বার কোথায় ব্রেকফাস্ট করেছিলাম? এ সব ব্যাপারে ওর স্মরণশক্তি খুব কাজ করে। যদিও ও তখন ১০ বছরের শিশু। ঋভু জানাল, মুভাত্তুপুড়ায়। এখন ঘড়িতে সাড়ে ৮টাও বাজেনি। মুভাত্তুপুড়া পৌঁছে গেছি। এখনই ব্রেকফাস্ট সারব? রতীশকে বলতেই, ও বলল পরে আরও ভালো জায়গা আছে।
মুভাত্তুপুড়া থেকেই আমরা মুন্নারগামী জাতীয় সড়ক ৪৯ ধরলাম। এই রাস্তাই কোচি থেকে মুন্নার-মাদুরাই হয়ে ধনুষ্কোডি পর্যন্ত চলে গিয়েছে। একের পর এক ছাড়িয়ে চলেছি জনপদ – কারাকুন্নাম, মাতিরাপিল্লি, কোঠামঙ্গলম, নেলিমাত্তম। নেলিমাত্তম ছাড়াতেই রতীশ ডান দিকে গাড়ি ঢুকিয়ে দিল। বেশ খোলামেলা খাওয়ার জায়গা। নামটাও সুন্দর – ক্লে ওভেন।
প্রাতরাশ সেরে ফের রওনা। ঘড়িতে সাড়ে ৯টা। মিনিট দশেক যাওয়ার পরেই শুরু হয়ে গেল ঘাটরাস্তা। আর একটু এগিয়ে রাস্তা দু’ ভাগ – উপরের রাস্তা চলে গেল ইডুক্কি। আমরা চললাম বাঁ দিকের রাস্তা ধরে।
আধ ঘণ্টা পরে এই পথের সব চেয়ে আকর্ষণীয় জায়গায় পৌঁছে গেলাম। এই জায়গাটাকে ফল্সের ঘাঁটি বলা যেতে পারে। পর পর জলপ্রপাত। হ্যাঁ, ঝরনা না বলে জলপ্রপাতই বললাম। শীত-গ্রীষ্মে যাকে ঝরনা বলা যায়, বর্ষায় তাকে জলপ্রপাত বলতেই হয়। জাতীয় সড়কের ধারে এমন সুন্দর সুউচ্চ ফল্স খুব কমই দেখেছি। বর্ষায় এর রূপ আরও খোলতাই হয়েছে।

প্রথমে বাঁ দিকে পড়ল চিয়াপ্পারা ফল্স। যাত্রার সাময়িক বিরতি। তীব্র বেগে জল অনেক উঁচু থেকে গড়িয়ে পড়ছে ধাপে ধাপে। একে আগেও দেখেছি। তবে সময়টা ছিল নভেম্বর মাস। স্বাভাবিক ভাবেই ফল্সের এমন রূপ পাইনি। রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে থেকে জলের তোড়ে ভিজেই গেলাম আমরা। জলপ্রপাতের ছবি ক্যামেরাবন্দি করে আর একটু এগিয়ে গেলাম। পড়ল ভালারা ফল্স। এ যেন চিয়াপ্পারার যমজ বোন।
ভালারাও একেবারে ভরা। তবে রাস্তা থেকে সামান্য দূরে। তাই ছিটেফোঁটা ছাড়া খুব একটা জল গায়ে আসছে না। আর একটু এগিয়ে দেভিয়ার ফলস। নীচে ২০ মিনিট হেঁটে নামতে হয়। আমরা গেলাম না। যেখান থেকে দেভিয়ার ফলসের হাঁটা শুরু সেখানেই রাস্তার ধারে একটা স্পাইস গার্ডেন আছে। উচ্চতা মাপার অ্যাপ বলছে আমরা এখন সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৭০০ ফুট উপরে আছি। এখনও কিন্তু খুব একটা উচ্চতায় আসিনি।
একটু পরেই পৌঁছে গেলাম আদিমালি। দেখেই মনে হয়, পাহাড়ের গায়ে লেপটে থাকা শহরটা বেশ বড়ো। মুন্নারের পথে অনেকটাই চলে এসেছি। আরুর থেকে মুন্নারের দূরত্ব ১২৭ কিমি। মুন্নার পৌঁছোতে এখনও ৩১ কিমি পথ বাকি। মুন্নারের উচ্চতা ৫ হাজার ফুটেরও বেশি। সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে, কম পথ পাড়ি দিয়ে অনেক বেশি উচ্চতায় উঠতে হবে আমাদের।
আদিমালি থেকেই পথ ক্রমশ উপরে উঠেছে। একটু পরেই আমরা চা-বাগানের রাজ্যে পৌঁছে গেলাম। রাস্তার বাঁ দিক থেকে উঠে যাওয়া পাহাড়ের ঢাল বরাবর চা-বাগান। আবার ডান দিকে যে খাদ নেমে গেছে, তার গায়েও চা-বাগান। বুঝতে পারছি মুন্নার আর খুব বেশি দূরে নেই। পথেই ফেলে এলাম পল্লিভাসাল ভিউ পয়েন্টে যাওয়ার রাস্তা।
একটা অনামি জায়গায় চা-পানের বিরতি দিলাম। মুন্নার এখান থেকে ৮ কিমি। অ্যাপ জানান দিল, আমরা ৩৮৪৯ ফুট উপরে এসেছি। অর্থাৎ মাত্র ৮ কিমির মধ্যে আমরা আরও ১২০০ ফুটেরও বেশি উঠব।

মুন্নার যে কাছে এসে গেছে তা বেশ বুঝতে পারছিলাম, মেঘের আনাগোনা দেখে। আস্তে আস্তে মেঘ ঢেকে দিল আমাদের। আমাদের দৃষ্টিপথ প্রায় ঢেকে গেল, গাড়ির গতি হয়ে গেল শ্লথ, ফগলাইট জ্বলে গেল। মনে পড়ে গেল ২১ বছর আগের কথা। সে বারেও, সেই নভেম্বর মাসে, মেঘে ঢাকা মুন্নার আমাদের স্বাগত জানিয়েছিল।
আমরা অবশ্য মুন্নার দেখতে এলেও, শহর-মুন্নারে থাকব না। এখানে আমাদের দিন দুয়েকের বাস চিনাকানালে। যাব আরও ২০ কিমি উজিয়ে মাদুরাই-থেক্কাড়ির দিকে। এই জাতীয় সড়ক চিনাকানালে গিয়ে দু’ ভাগ হয়েছে। বাঁ দিকের পথ গেছে তামিলনাড়ুর সীমানা পেরিয়ে মাদুরাই, আর ডান দিকের পথ গেছে থেক্কাড়ি হয়ে কেরলের অন্দরে।
মুন্নার শহর ছাড়িয়ে আমরা চললাম মাদুরাইয়ের পথে। সরকারি ভেষজ উদ্যানকে বাঁ দিকে রেখে এগিয়ে চললাম। মুন্নারের মুকুটে নতুন পালক এই ভেষজ উদ্যান। দেখার ‘স্পট’ আরও বেড়েছে তা হলে মুন্নারে। এ দিকের জাতীয় সড়কে কাজ হচ্ছে, রাস্তা চার লেনের হচ্ছে। চিনাকানাল ফল্স রাস্তা থেকে দেখেই গাড়ি বাঁ দিকের পথ ধরল। ডান দিকের পথ চলে গেল থেক্কাড়ি। সামান্য সময় পরেই আমরা পৌঁছে গেলাম মুন্নারে আমাদের দু’ দিনের ঠিকানায়। (চলবে)
আরও পড়তে পারেন
ভগবানের আপন দেশে ৫/ সন্ধ্যা কাটল মাত্তানচেরি, ফোর্ট কোচিনে
ভগবানের আপন দেশে ৪/ সেই আরুকুট্টি হারিয়ে গিয়েছে
ভগবানের আপন দেশে ৩/ আরুরের ‘চিনাভালা’য়