গুজরাত বেশ বড়ো রাজ্য, একবারে ঘোরা যায় না। আর এই গুজরাত ভ্রমণের আদর্শ সময় নভেম্বর থেকে মার্চ, ভ্রমণ অনলাইন সাজিয়ে দিচ্ছে গুজরাতের ভ্রমণ-ছক। আজ প্রথম কিস্তি।
ভ্রমণ শুরু করুন বডোদরা তথা বরোদা থেকে। হাওড়া-অমদাবাদ এক্সপ্রেস রাত ১১.৪০-এ হাওড়া ছেড়ে বডোদরা পৌঁছোয় তৃতীয় দিন সকাল ৯.৪৮ মিনিটে। এ ছাড়া হাওড়া, শালিমার ও কলকাতা স্টেশন থেকে আরও কিছু সাপ্তাহিক, দ্বিসাপ্তাহিক ট্রেন রয়েছে বডোদরা যায়। তবে সব ট্রেনই ভোর ভোর বা সকালে বডোদরা পৌঁছে যায়।
দিল্লি থেকে বডোদরা আসার অনেক ট্রেন আছে, যা বডোদরা পৌঁছে দেয় সকালের মধ্যে। মুম্বই থেকে বডোদরা পাঁচ-ছ’ ঘণ্টার ট্রেন জার্নি। সকালে বডোদরা পৌঁছে দেওয়ার বেশ কিছু ট্রেন আছে। ট্রেনের বিস্তারিত সময় পাবেন erail.in-এ।
ভারতের প্রায় সব বড়ো শহরের সঙ্গে বডোদরা বিমানপথে যুক্ত।
ভ্রমণসূচি
প্রথম ও দ্বিতীয় দিন – রাত্রিবাস বডোদরা।
শ্রীঅরবিন্দের স্মৃতি বিজড়িত বডোদরা পৌঁছে প্রথম দিন দেখে নিন শ্রীঅরবিন্দ নিবাস, লক্ষ্মীবিলাস প্যালেস, সুরসাগর লেক, লেকের পাড়ে ন্যায়মন্দির, তিলক রোডে সওয়াজি বাগ, স্টেশন থেকে তিন কিমি দূরে ইএমই স্টিল টেম্পল, নন্দলাল বসুর দেওয়াল-অঙ্কন সমৃদ্ধ কীর্তিমন্দির, বরোদা মিউজিয়াম অ্যান্ড আর্ট গ্যালারি, শ্রীসওয়াজি সরোবর ইত্যাদি।
দ্বিতীয় দিন চলুন চম্পানের-পাওয়াগড়-জম্বুঘোড়া।
বডোদরা থেকে চম্পানের- পাওয়াগড় ৪৯ কিমি, আরও ২৮ কিমি দূরে জম্বুঘোড়া, সেখান থেকে বডোদরা ৬১ কিমি।
ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকাভুক্ত চম্পানের-পাওয়াগড় প্রত্নতাত্ত্বিক পার্ক। ১৫২৩-এ সুলতান বাগেড়ার তৈরি জামা মসজিদ শৈল্পিক উৎকর্ষে অনবদ্য। দেখে নিন কেভাদা মসজিদ, লীলা গুম্বজ কি মসজিদ, নাগিনা মসজিদ ও সেনোট্যাফ। পাহাড়ের নীচে রাজপুত-কীর্তি সাত মাইল প্রাসাদ। ৪ কিমি দূরের মাচি থেকে দেড় কিমি হেঁটে বা ৭০০ মিটার দীর্ঘ রোপওয়ে চড়ে পৌঁছে যান ৮২০ মিটার উঁচু পাওয়াগড়ের পাহাড়চুড়োয়। সোলাঙ্কিদের দুর্গ ও প্রাসাদের ধ্বংসাবশেষ দেখুন। ২২৫ সিঁড়ি উঠে পাওয়াগড় শিখরে দেখুন মহাকালিকা মন্দির। আছে লাকুলিসা মন্দির, এক গুচ্ছ জৈন মন্দির, দুধিয়া তালাও, ছাঁছিয়া তালাও, ত্রিতলিকা চম্পাবতী মহল।
চম্পানের-পাওয়াগড় দেখে চলুন ২৮ কিমি দূরের জম্বুঘোড়া অভয়ারণ্য। সবুজ জঙ্গল-পাহাড়-জলাশয়ে মোড়া প্রকৃতিবীক্ষণ কেন্দ্র।
তৃতীয় দিন – বডোদরা থেকে ডাকোর হয়ে মহেসানা আসুন। রাত্রিবাস মহেসানা।
বডোদরা থেকে মহেসানা আসার ট্রেন থাকলেও গাড়ি ভাড়া করে আসুন এবং পথে দেখে নিন ডাকোরে রণছোড়জি তথা শ্রীকৃষ্ণের মন্দির। কথিত আছে, দ্বারকার রণছোড়জি ডাকোরে আসেন ভক্ত বোদানোর সঙ্গে। দ্বিমতে, ১২৬৯-এ ডাকোরবাসীরা দ্বারকা থেকে রণছোড়জিকে চুরি করে নিয়ে আসেন ডাকোরে। ডাকোরের বর্তমান মন্দিরটি আড়াইশো বছরের পুরোনো। প্রশস্ত অঙ্গনের মাঝে কারুকার্যমণ্ডিত এই মন্দির দেখার মতো। বডোদরা থেকে ডাকোর ৬২ কিমি। সেখান থেকে মহেসানা ১৬০ কিমি।
চতুর্থ দিন – আজও থাকুন মহেসানায়।
এ দিন সকালেই গাড়ি ভাড়া করে বেরিয়ে পড়ুন। প্রথমে চলুন মহেসানা থেকে ২৫ কিমি দূরের মধেরা। এখানে দেখে নিন আট শতকের সূর্যমন্দির, ভাস্কর্যে অনবদ্য। ভারতের চার সূর্যমন্দিরের একটি মধেরায়, বাকি ৩টি ওড়িশার কোনারক, জম্মু-কাশ্মীরের মার্তণ্ড এবং মধ্যপ্রদেশের খাজুরাহো। মধেরার মন্দিরের সামনে সূর্যকুণ্ড এবং তাকে ঘিরে ১০৮টি খুদে মন্দির। উৎসাহীরা পাহাড় চড়ে প্রাচীন দুর্গটিও দেখে নিতে পারেন।
মধেরা থেকে চলুন ১৪ কিমি দূরের বেচারাজি। এখানে দেখে নিন দেবী বেচারাজি তথা সাত দিনের প্রতীক সাত বাহনে মা দুর্গাকে।
এখান থেকে চলুন পাটন। পথ মধেরা হয়েই গিয়েছে, দূরত্ব ৪৮ কিমি। সোলাঙ্কি রাজাদের রাজধানী পাটন। ১০৮ জৈন মন্দির রয়েছে। তবে আরও বেশি দ্রষ্টব্য হল শিল্পসুষমায় মণ্ডিত ১০৫০ সালে তৈরি গুজরাতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ স্টেপওয়েল রানি কি ভাভ। পাটন থেকে ফিরে আসুন মহেসানায়। দূরত্ব ৫৬ কিমি।
পঞ্চম দিন – চলুন অমদাবাদ। সারা দিনই মহেসানা থেকে অমদাবাদ আসার অনেক ট্রেন আছে। মোটামুটি সময় লাগে ঘণ্টা দুয়েক। গাড়ি বা বাসেও আসতে পারেন, দূরত্ব ৭৫ কিমি। রাত্রিবাস অমদাবাদ।
ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম দিন – রাত্রিবাস অমদাবাদ।
সবরমতীর ধারে অমদাবাদ। সম্প্রতি ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের তকমা পেয়েছে। এখানে দ্রষ্টব্য অনেক। প্রায় তিনটে দিন লেগে যায় অমদাবাদ দেখতে। শুরু করুন রিভার ফ্রন্ট দিয়ে। চলুন লাল দরোজার কাছে সিদি সৈয়দ জালি মসজিদ। এর পর ভদ্রা ফোর্ট ও ভদ্রকালী মন্দির দেখুন। তার পর চলুন সরখেজ রোজায় সুলতান মামুদ বেগারার সমাধি দেখতে। দেখুন রানি সিপ্রির মসজিদ, স্বামীনারায়ণ মন্দির, জামা মসজিদ, তিন দরওয়াজা। দেখুন এক গুচ্ছ মিউজিয়াম — ক্যালিকো মিউজিয়াম অব টেক্সটাইলস, বেচার ইউটেনসিল মিউজিয়াম, কাইট মিউজিয়াম। দেখে নিন সর্দার পটেল মিউজিয়াম। বিনোদনের হরেক ব্যবস্থা সহ কাঁকারিয়া হ্রদ। হ্রদের পাড়ে বাল বাটিকা। দেখে নিন রেলস্টেশনের দক্ষিণে সারঙ্গপুর রোডে শেকিং মিনারেট তথা ঝুলতা মিনার।
দেখুন গান্ধীজির গড়া সবরমতী আশ্রম। এলিস ব্রিজে সবরমতী নদী পেরিয়ে শহর থেকে ৭ কিমি উত্তরে সবরমতীর ধারে আশ্রম। এলিস ব্রিজে সবরমতী পেরোনোর আগে দেখুন ভিক্টোরিয়া গার্ডেন।
রয়েছে আরও দ্রষ্টব্য — শাহ আলমের রৌজা (শহর থেকে ৩ কিমি দক্ষিণ পুবে), রানি রূপমতী মসজিদ (মির্জাপুরে), মসজিদ-ই-নাগিরা (মানেকচকে), দরিয়া খাঁয়ের সমাধি (গুজরাতের সর্বোচ্চ গম্বুজ), আদালজ ভাভ তথা স্টেপওয়েল (১৯ কিমি), অক্ষরধাম মন্দির (২৩ কিমি দূরে গান্ধীনগরে) ইত্যাদি।
অমদাবাদ অবস্থানকালে এক দিন ঘুরে আসুন লোথাল ও নল সরোবর – অমদাবাদ থেকে ৭৫ কিমি, ট্রেনে তিন ঘণ্টার পথ লোথাল। বাসও চলে। তবে সময় বাঁচাতে গাড়ি ভাড়া করে নেওয়াই ভালো। সিন্ধু সভ্যতার সমসাময়িক সভ্যতার নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে লোথালে। বলা হয়, হরপ্পা ধ্বংস হয়ে যাওয়ার ৫০০ বছরে পরেও লোথাল সভ্যতা টিকে ছিল। পরবর্তী কালে বন্যায় ধ্বংস হয় এই সভ্যতা। লোথাল দেখে চলুন ৪০ কিমি দূরের নল সরোবর পাখিরালয়। দেশ-বিদেশ থেকে আসা পাখিরা শীতে আস্তানা গাড়ে নল সরোবরের বেট থেকে বেটে। বেট অর্থে দ্বীপ। নল সরোবর দেখে ফিরে আসুন ৬৬ কিমি দূরের অমদাবাদে।
নবম দিন – ঘরে ফেরা। অমদাবাদ থেকে কলকাতা-সহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় ফেরার ট্রেন আছে। বিমানেও ফিরতে পারেন।
কোথায় থাকবেন
একমাত্র অমদাবাদে রয়েছে গুজরাত পর্যটনের হোটেল। অমদাবাদ রেলস্টেশন থেকে ৮ কিমি এবং বিমাববন্দর থেকে ৬ কিমি দূরে সবরমতী গান্ধী আশ্রমের উলটো দিকে রয়েছে গুজরাত পর্যটনের হোটেল তোরণ গান্ধী আশ্রম। অনলাইনে বুক করার জন্য লগইন করুন booking.gujarattourism.com। এ ছাড়া সব জায়গাতেই রয়েছে বেসরকারি হোটেল এবং রিসোর্ট। হোটেল বুকিং-এর একাধিক ওয়েবসাইট থেকে তা বুক করতে পারেন।
কী ভাবে ঘুরবেন
(১) বডোদরা থেকে ৪৫ কিমি দূরে চম্পানের, আরও ৪ কিমি দূরে পাওয়াগড়। বডোদরা থেকে নিয়মিত বাস পাওয়া যায় চম্পানের-পাওয়াগড় পথে হিল স্টেশন মাচি পর্যন্ত। গাড়ি ভাড়া করেও আসতে পারেন। গাড়ি ভাড়া করে এলে জম্বুঘোড়া অভয়ারণ্য ঘুরে নেওয়া সুবিধার।
(২) অমদাবাদে স্থানীয় গাড়ি ভাড়া করে ঘুরুন।
মনে রাখবেন
(১) বডোদরায় লক্ষ্মীবিলাস প্যালেসের কিছু কিছু অংশ দেখা যায়। তার জন্য দর্শনী লাগে।
(২) নল সরোবরে অবশ্যই বোটিং করবেন। সেটাই মজার। বন দফতরেকে দর্শনী দিতে হয়। বোটিং চার্জ আলাদা। দরাদরি করতে হয়। সঙ্গে গাইড নিতে পারলে ভালো।
(৩) লোথালে প্রত্নতাত্ত্বিক সর্বেক্ষণের সংগ্রহশালা ছুটির দিন ও শুক্রবার ছাড়া সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত খোলা।
(৪) ট্রেনের বিস্তারিত সময়ের জন্য দেখে নিন erail.in
(৫) উড়ানের সময় গুগুল সার্চ করে পেয়ে যাবেন।
(প্রথম ছবিটি মধেরা সূর্য মন্দিরের)
আরও পড়তে পারেন
চলুন ঘুরে আসি রাজস্থান ৪: মাউন্ট আবু-উদয়পুর-চিতোরগড়-বুন্দি-রনথম্ভোর
চলুন ঘুরে আসি রাজস্থান ৩: বিকানের-জৈসলমের-বাড়মের-জোধপুর
চলুন ঘুরে আসি রাজস্থান ২: জয়পুর-ফতেপুর-বিকানের-অজমের
চলুন ঘুরে আসি রাজস্থান ১: আগ্রা-ভরতপুর-দৌসা-জয়পুর-সরিস্কা-অলওয়র