ভ্রমণঅনলাইন ডেস্ক: শারদোৎসবের পরেই এসে গেল দীপাবলি, আলোর মালায় সেজে উঠতে চলেছে প্রতিটি বাড়ি। কলকাতা-সহ বঙ্গের বিভিন্ন কালীমন্দিরে শুরু হয়েছে দীপান্বিতা অমাবস্যার চূড়ান্ত প্রস্তুতি। চলুন যাওয়া যাক শান্তিপুর।
বহু দূরদূরান্ত থেকে সাধারণ মানুষ বছরে দু’ বার শান্তিপুরে ছুটে আসেন – এক বার রাস উৎসবে আর এক বার দীপান্বিতা কালীপুজোয়। শান্তিপুরের বহু প্রাচীন কালীপূজার মধ্যে সব থেকে আগে যাঁর নাম প্রথমেই উঠে আসে তিনি হলেন মা আগমেশ্বরী।
দক্ষিণাকালীর পূজাপদ্ধতির যে গ্রন্থ সর্বজনের আদৃত সেই ‘তন্ত্রসার গ্রন্থ’-এর প্রণেতা নবদ্বীপের কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ। তাঁর এই গ্রন্থ অনুসরণ করেই সর্বত্র কালীপুজো অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। প্রচলিত লোককথায় কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ স্বয়ং মা কালীর মৃন্ময়ী রূপের সূচনা করেছিলেন। তার আগে নাকি মায়ের কোনো মৃন্ময়ী রূপ ছিল না, মা ঘটে পূজিত হতেন। সেই কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশের প্রপৌত্র সার্বভৌম আগমবাগীশের উদ্যোগেই আনুমানিক চারশো বছর আগে শান্তিপুরে শুরু হয়েছিল আগমেশ্বরী কালীপুজো। তাঁরা আগমশাস্ত্রজ্ঞ ছিলেন বা সেই শাস্ত্রে পাণ্ডিত্য লাভ করেছিলেন বলে তাঁদের আগমবাগীশ উপাধি দান করা হয়। আগমবাগীশের আরাধ্যা বলেই দেবী এখানে আগমেশ্বরী নামেই পরিচিত।
এ-ও এক সহিষ্ণুতার কাহিনি। বৈষ্ণব আর শাক্তের বিরোধ মেটানোর এক ঐকান্তিক প্রয়াস জড়িয়ে আছে অদ্বৈতভূমির বুকে চার শতক আগে শুরু হওয়া কালীপুজোর সঙ্গে। এক দিকে বৈষ্ণব সাধনা, অন্য দিকে তন্ত্রসাধনা – এই দুই বিপরীতধর্মী সাধনাই কার্যত এখানে মিলিত হয়েছে। এই ইতিহাসকে সঙ্গী করেই শান্তিপুরের আগমেশ্বরী কালীপুজো আজও মানুষের কাছে এক অমোঘ আকর্ষণ, যার টানে ছুটে আসেন আট থেকে আশি।
সার্বভৌম আগমবাগীশ তন্ত্রসাধনা করতেন। সেই সময়ে শাক্ত এবং বৈষ্ণবদের মধ্যে বিরোধ চলছিল বলে কথিত। সেই বিরোধ মেটাতে শান্তিপুরের অদ্বৈতাচার্যের পৌত্র মথুরেশ গোস্বামী নিজ কন্যার বিবাহ দেন নবদ্বীপের সার্বভৌম আগমবাগীশের সঙ্গে। তাঁর আশা ছিল এর ফলে বৈষ্ণব-শাক্তে বিরোধ মিটবে, যদিও এর পরও সেই বিরোধ মেটেনি। বরং তা আরো জটিল আকার নেয়। ফলে এক সময় বাধ্য হয়েই মথুরেশ গোস্বামী তাঁর মেয়ে ও জামাইকে নবদ্বীপ থেকে নিয়ে আসেন শান্তিপুরে। শান্তিপুরের গোস্বামীরা যে হেতু প্রত্যক্ষ ভাবে শক্তির উপাসনা করেন না তাই মথুরেশ গোস্বামী তাঁর বাড়ির পুর্ব দিকে একটি পঞ্চমুণ্ডির আসন স্থাপন করেন জামাতার জন্য। আর এ ভাবেই বৈষ্ণব সাধনার প্রাণপুরুষ অদ্বৈতাচার্যের বংশের সঙ্গে সংযোগ হয় সেই সময়কার তন্ত্রসাধনার প্রাণপুরুষ সার্বভৌম আগমবাগীশের। আর তখন থেকেই দুই বিপরীতধর্মী সাধনার এক সঙ্গে পথ চলা শুরু। বর্তমানে পঞ্চমুণ্ডির আসন সংলগ্ন স্থানটি ‘আগমেশ্বরীতলা’ নামেই পরিচিত।
কথিত আছে, এক রাতে সার্বভৌম স্বপ্নাদেশ পান। দেবী তাঁকে স্বপ্নে দেখা দিয়ে বলেন, সকালে উঠে তিনি যাঁকে দেখবেন তিনিই তাঁর আরাধ্যা দেবী। পরের দিন ভোরে আগমবাগীশ ঘুম থেকে উঠে একটি কৃষ্ণবর্ণের মেয়েকে ঘুঁটে দিতে দেখেন। এর পর স্বপ্নাদেশের কথা মাথায় রেখে গঙ্গামাটি এনে সেই মেয়ের আদলে মূর্তি তৈরি করেন। মূর্তি তৈরির শেষে আগমবাগীশ সেই মূর্তিই পুজো করেন এবং পুজো শেষে সেই রাতেই বিসর্জন দেন।
মথুরেশ গোস্বামীর উত্তরপুরুষ শান্তিপুরের বড়ো গোস্বামী পরিবারই এই পুজো পরিচালনা করেন। তবে পুজোর উপদেষ্টামণ্ডলীতে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি থেকে শুরু করে পুলিশ ও প্রশাসনের কর্তারা রয়েছেন। শুধু ইতিহাসই নয় এই পুজোর কিছু আচারও তাকে স্বকীয়তা দান করেছে। বিজয়াদশমীর দিন মা আগমেশ্বরীর পাটে সিঁদুর দেওয়া হয় ও পূজা করা হয়। কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোর দিন ‘পাটখিলান’ অনুষ্ঠান পালন করা হয় প্রাচীন রীতি মেনেই, সঙ্গে পুজোও হয়। এই আগমেশ্বরী মায়ের উচ্চতা প্রায় ১৬-১৮ ফুট, মায়ের সেই নয়নভোলানো জ্যোতি যেন গোটা বঙ্গের ভক্তবৃন্দকে মোহিত করে।
‘পাটখিলান’ অনুষ্ঠানের পরই শুরু হয়ে যায় মায়ের মৃন্ময়ীরূপ তৈরি করা। কালীপুজোর দিন মায়ের রঙ হয় এবং রাত্রে হয় চক্ষুদানপর্ব। দীপান্বিতা কালীপুজোর সমস্ত নিময় মেনেই নিষ্ঠার সঙ্গে পুজো হয় মায়ের। তন্ত্রমতে পুজো হয় মা আগমেশ্বরীর। রাত্রি ৯টার সময় বাড়ির সদস্যরা মাকে গয়না পরান, নব সাজে সজ্জিত করেন। তার পর সারা দিন উপবাসে থাকা মৃৎশিল্পী শুদ্ধ বস্ত্র পরে মায়ের চক্ষুদান করেন। এর পর বড়ো গোস্বামী পরিবারের সম্পাদক মাকে সিঁদুর দান করেন। গন্ধদান, আতরদান করে মায়ের পুজো শুরু হয়। মোটামুটি রাত্রি ১১টা থেকে সাড়ে ১১টার মধ্যে মায়ের পুজো শুরু হয়, শেষ হতে হতে প্রায় ভোর হয়ে যায়।
এই কালীপুজোর অন্যতম বৈশিষ্ট্য এই পুজায় সুরা ব্যবহার করা হয় না। তার পরিবর্তে কাঁসার পাত্রে নারকেল জল ব্যবহৃত হয়। আগমেশ্বরী কালীপুজোয় বলিপ্রথা নেই। যাঁরা প্রতিমা তৈরি করেন তাঁরা তা বংশপরম্পরায় করে আসছেন। দূরদূরান্ত থেকে কয়েক হাজার মানুষ এই সময়ে ভিড় করেন এখানে। প্রত্যেকে এখান থেকেই ভোগ নিয়ে যান। আগমেশ্বরীপুজোর ভোগ রান্নার কাজটিও দেখার মতো। বিপুল পরিমাণ মানুষের জন্য ভোগ রান্না করা হয়। তার আয়োজনও হয় বিপুল। প্রায় ৩০ কেজি গোবিন্দভোগ চাল, ১ মণ কাজু, ৩৫ কেজি কিসমিস, প্রায় ১ কুইন্টাল ঘি দিয়ে তৈরি হয় এখানকার ভোগের পোলাও।
মায়ের পুজোর পরের দিন বিসর্জন। আগে মা আগমেশ্বরী কাঁধে করে যেতেন। এখন সেই প্রথা বন্ধ। এখন মা ট্রলারেই যান। এক সময় প্রচুর মশাল জ্বালিয়ে বিসর্জনের শোভাযাত্রা হত। প্রচুর মশাল সহকারে সেই সুদৃশ্য শোভাযাত্রা মানুষের কাছে ছিল এক অন্যতম আকর্ষণ। তবে বর্তমানে তা বন্ধ। কয়েক বছর আগে প্রশাসনের অনুরোধক্রমে তা বন্ধ রাখা হয়েছে। বর্তমানে প্রতিকী হিসাবে দু’টি মশাল জ্বালানো হয় শোভাযাত্রা শুরুর আগে। বিসর্জনপর্ব সমাধা হয় শান্তিপুরের মতিগঞ্জের ঘাটে।
কী ভাবে যাবেন
শিয়ালদহ থেকে ট্রেনে চলুন শান্তিপুর। স্টেশন থেকে বড়ো গোস্বামীবাড়ি চলুন টোটোয় বা রিকশায়, দূরত্ব দেড় কিমি। কলকাতা থেকে শান্তিপুর বাসে বা গাড়িতেও যেতে পারেন। দূরত্ব ৯৪ কিমি।
আরও পড়তে পারেন
শীতকালীন পর্যটনকে বিস্তার করতে বিশেষ উদ্যোগ কাশ্মীরের, হেলিকপ্টার পরিষেবা চালু করার ভাবনা
বিশ্বের সব থেকে পরিবেশবান্ধব শহরের শিরোপা পেল হায়দরাবাদ
কালীপুজো-দীপাবলি: মা-ই-ত কালীর পুজোয় মেতে উঠছে সোনামুখী
কালীপুজো-দীপাবলি: চলুন সেখানে যেখানে মায়ের দু’টি পায়ের ছাপ পূজিত হয় জঙ্গলিকালী হিসাবে