শান্তিপুরের রাস উৎসবের কেন্দ্রে থাকেন বড়ো গোস্বামীবাড়ির শ্রীশ্রীরাধারমণ জিউ

শুভদীপ রায় চৌধুরী

উৎসবের মরশুম শুরু হয়েছিল দুর্গাপুজোয়, শেষ হতে চলেছে রাসযাত্রায়। শান্তিপুর এবং নবদ্বীপ সেজে উঠছে রাসযাত্রার আলোয়। শান্তিপুরের রাসযাত্রা দেখতে দূরদূরান্ত থেকে অগণিত ভক্তরা আসেন, উপভোগ করেন ভগবানের লীলা। শান্তিপুরের এই রাস উৎসব বঙ্গদেশের সাংস্কৃতিক দিককে আরও উজ্জ্বল করে। এখানকার বড়ো গোস্বামীদের শ্রীশ্রীরাধারমণ জিউই শান্তিপুরে রাস উৎসবের কেন্দ্রবিন্দু। এ ছাড়াও অবশ্য শান্তিপুরের বিভিন্ন জায়গায় আরও বিগ্রহ রয়েছে, সেখানে ধুমধাম করে এই উৎসব পালিত হয়।

কথা হচ্ছিল বড়ো গোস্বামীবাড়ির সদস্য সুদীপ্ত গোস্বামীর সঙ্গে। তাঁর কাছ থেকেই জানা গেল, তাঁদের পরিবারের রাস উৎসবের ইতিহাস।   

শ্রীঅদ্বৈতচার্যের পৌত্র মথুরেশ গোস্বামীর বড়ো পুত্র রাঘবেন্দ্রের সময় থেকে এই বড়ো গোস্বামীবাড়ির সৃষ্টি। কথিত আছে, ঈশ্বর দর্শনের উদ্দেশ্যে ভারত ভ্রমণে বেরিয়ে শ্রীঅদ্বৈতাচার্য নেপালের গণ্ডকী নদী থেকে একটি নারায়ণশিলা পান। সেই শিলা তিনি শান্তিপুরে নিজের বাড়িতে এনে পূজা করা শুরু করেন। আচার্যদেবের সেই নারায়ণশিলা আজও নিত্য পূজিত হন বড়ো গোস্বামীবাড়িতে।

এই বাড়ির প্রধান দেবতা কষ্টিপাথরের শ্রীশ্রীরাধারমণ জিউ। এই মূর্তি আগে পুরীতে রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নের আমলে ‘দোলগোবিন্দ’ নামে পূজিত হতেন। পরবর্তী কালে বারো ভুঁইয়াদের অন্যতম বসন্ত রায় তাঁকে যশোরে নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু ১৫৯২ খ্রিস্টাব্দে মানসিংহ বাংলা আক্রমণ করলে মূর্তির পবিত্রতা বিনষ্ট হওয়ার আশঙ্কায় বসন্ত রায়ের পরিবার এই কৃষ্ণমূর্তি তুলে দেন তাঁদের গুরুদেব অদ্বৈত-পৌত্র মথুরেশ গোস্বামীর হাতে। মথুরেশ গোস্বামী সেই মূর্তি নিয়ে এসে শান্তিপুরে নিজের বাড়িতে প্রতিষ্ঠা করেন শ্রীশ্রীরাধারমণ জিউ নামে। সেই থেকে শ্রীশ্রীরাধারমণ পূজিত হচ্ছেন বড়ো গোস্বামীবাড়িতে।

পরবর্তী কালে রাধারমণ বিগ্রহের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন শ্রীমতী। এ ছাড়াও বাড়িতে রয়েছেন সুপ্রাচীন মদনমোহন-শ্রীমতী, শ্রীশ্রীরাধাবল্লভ-শ্রীমতী, শ্রীশ্রীগোপালরায়-শ্রীমতী ও শ্রীশ্রীবিশ্বমোহন-শ্রীমতী বিগ্রহ। রয়েছেন জগন্নাথ-বলরাম-সুভদ্রা এবং রামচন্দ্রের দারুমূর্তি। এ ছাড়া বড়ো গোস্বামীবাড়িতে রয়েছে শান্তিপুরের একমাত্র ষড়ভুজ মহাপ্রভুমূর্তি, শ্রীঅদ্বৈতাচার্য, সীতাদেবী ও পুত্র অচ্যুতানন্দের দারুমূর্তি ও কষ্টিপাথরের শিবমূর্তি।

শ্রীশ্রীরাধারমণজিউ-এর পাশে শ্রীরাধিকা।

শ্রীশ্রীরাধারমণকে নিয়ে বেশ আনন্দে কাটছিল। এমন সময় হঠাৎ ছন্দপতন হল, বড়ো গোস্বামীবাড়ির মন্দির থেকে অপহৃত হলেন শ্রীশ্রীরাধারমণ বিগ্রহ। তখন তাঁদের বাড়ির সদস্যরা ঠিক করলেন, শ্রীধাম বৃন্দাবনে গোপীরা ‘কাত্যায়নীব্রত’ করে যেমন লীলাপুরুষোত্তমকে পেয়েছিলেন, ঠিক তেমনই তাঁরাও কাত্যায়নী পুজো করবেন শ্রীশ্রীরাধারমণকে পাওয়ার জন্য। শারদীয়া দুর্গাপুজোর সময় শ্রীশ্রীকাত্যায়নীমাতার পুজো শুরু হল। মায়ের কাছে হত্যে দিয়ে থাকার পরে তৃতীয় দিনে স্বপ্নাদেশ হল – দিগনগরে একটি জলাশয়ে তাঁদের ইষ্টদেবকে ফেলে রাখা হয়েছে। সেই জলাশয় থেকে রাধারমণকে উদ্ধার করে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা হল।

শান্তিপুরবাসীকে দর্শন দিয়ে ধন্য করার জন্য যুগল বিগ্রহকে বরকন্যারূপে নানা অলংকারে সজ্জিত করে সারা শান্তিপুর শোভাযাত্রা করে ঘোরানো হয়। সেই থেকে রাস উৎসবের সময় রাধারমণের পাশে রাধারানিকে প্রতিষ্ঠা করা হয় এবং শোভাযাত্রা বের হয়। সেই শোভাযাত্রাই হল বিখ্যাত ভাঙারাস উৎসব।

রাধারমণ ও শ্রীরাধিকার বরকন্যাবেশের শোভাযাত্রার পেছনে বরযাত্রী হয়ে চলেন শান্তিপুরের সকল পূজিত যুগল বিগ্রহ। এই অনুষ্ঠানটি সম্পূর্ণ সংগঠিত করেন খাঁ চৌধুরী বাড়ি (খাঁ চৌধুরীরা হলেন বড়ো গোস্বামীবাড়ির শিষ্য)। ভাঙারাসের পরের দিন বড়ো গোস্বামীবাড়ির সব যুগল বিগ্রহকে নানা অলংকারে সাজিয়ে অনুষ্ঠিত হয় ‘কুঞ্জভঙ্গ’ বা ‘ঠাকুরনাচ’। এই অনুষ্ঠানটি খুবই মনোরম এবং অনুষ্ঠান শেষে সকল বিগ্রহকে অভিষেক করে মন্দিরে প্রবেশ করানো হয়।

এ ছাড়া এই বড়ো গোস্বামীবাড়িতে শ্রীশ্রীরাধারমণ জিউ-এর জামাইষষ্ঠী পালিত হয়। এ ছাড়া শ্রীশ্রীঅদ্বৈতাচার্য্যের প্রথম পুত্র অচ্যুতানন্দের জন্মতিথি পালিত হয়। ঝুলনযাত্রা অনুষ্ঠানে শ্রীশ্রীরাধারমণ জিউ ও অন্যান্য যুগল বিগ্রহ সুসজ্জিত করে ঝুলনে তোলা হয়। বৈশাখ মাসের বৈশাখী পূর্ণিমায় শ্রীশ্রীরাধারমণের ফুলদোল ও বনভোজন অনুষ্ঠান সাড়ম্বরে পালিত হয়।

প্রতি বছর বড়ো গোস্বামীবাড়ির রাসমঞ্চের সামনের বিরাট মাঠটিতে দর্শনার্থীদের বিশ্রামের ব্যবস্থা করা হয় বলে জানালেন সুদীপ্তবাবু।

কী ভাবে যাবেন

শিয়ালদহ থেকে ট্রেনে চলুন শান্তিপুর। স্টেশন থেকে বড়ো গোস্বামীবাড়ি চলুন টোটোয় বা রিকশায়, দূরত্ব দেড় কিমি। কলকাতা থেকে শান্তিপুর বাসে বা গাড়িতেও যেতে পারেন। দূরত্ব ৯৪ কিমি।

আরও পড়তে পারেন

গোপীনাথ জিউ-এর রাস উৎসবে মেতে উঠেছে শোভাবাজার রাজবাড়ি

চলুন ঘুরে আসি রাজস্থান ৩: বিকানের-জৈসলমের-বাড়মের-জোধপুর

চলুন ঘুরে আসি রাজস্থান ২: জয়পুর-ফতেপুর-বিকানের-অজমের

চলুন ঘুরে আসি রাজস্থান ১: আগ্রা-ভরতপুর-দৌসা-জয়পুর-সরিস্কা-অলওয়র

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *