রাজভূমি রাজস্থান ৮/ ভ্রমণের শেষ পর্বে রনথম্ভোর-ঝালানায়

Jungle safari at Ranthambhore

সঞ্জয় হাজরা

পরদিন সকালেই বেরিয়ে পড়লাম। আজ আমাদের মূল গন্তব্য রনথম্ভোর জাতীয় উদ্যান। এবং জাতীয় উদ্যানে সাফারি করে আজই জয়পুরে ফিরে আসার কথা।

জয়পুর শহর থেকে ১২৫ কিলোমিটার চলে এসেছি। ছাড়িয়ে এসেছি টঙ্ক শহরও। রনথম্ভোরের পথে এগিয়ে গিয়েছি আরও ২২ কিলোমিটার। পৌঁছে গেলাম গুমাঁপুরা গ্রামে। ইদানীং রাজস্থানের পর্যটন মানচিত্রে এই গ্রামটিও উল্লেখযোগ্য জায়গা করে নিয়েছে এক অসাধারণ স্থাপত্যকাজের জন্য।

হাতি ভাটা।

এই স্থাপত্যের নাম ‘হাতি ভাটা’। নামেই বোধহয় বোঝা যাচ্ছে কী স্থাপত্যের জন্য বিখ্যাত এই গ্রাম? একটি পাথর কেটে তৈরি করা হয়েছে হাতি। অনিন্দ্যসুন্দর হাতের কাজ। স্থানীয় স্থপতি রামনাথ স্লতকে দিয়ে এই অনন্য কীর্তিটি নির্মাণ করান জয়পুরের রাজা সওয়াই রাম সিং। এই স্থাপত্যকর্মে খোদাই করা আছে নল-দময়ন্তীর কাহিনি।

এই ‘হাতি ভাটা’র গ্রাম নিয়ে একটি অন্য কাহিনিও প্রচারিত রয়েছে। মহাভারতের পাণ্ডবরা তাঁদের রাজ্য হারিয়ে যখন ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন তখন এই গ্রামে বসেই তাঁদের রাত্রিকালীন আহার করতেন। তবে সে যা-ই হোক না কেন, ১৯৫৮ সালে ভারত সরকার জাতীয় সংরক্ষণ আইনের মাধ্যমে এই স্থাপত্যকলাকে জাতীয় পুরাতত্ত্ব শিল্পকলা হিসাবে স্বীকৃতি প্রদান করেছেন। এ সব দেখে আবার এগিয়ে চলা জাতীয় উদ্যানের উদ্দেশে।

রনথম্ভোরের অন্দরে।

রাজস্থান বলতেই মনে পড়ে কেল্লা, বালি, পাথর আর মরুভূমির কথা। কিন্তু জঙ্গল, বন্যপ্রাণ ও পক্ষীকুলের সম্ভার নিয়ে আরেকটা সবুজ অংশও রয়েছে এই বৈচিত্র্যময় রাজ্যে। ‘রেগিস্তান’-এর ছবির আড়ালে পূর্ব রাজস্থানে রয়েছে তিনটি অনন্য অভয়ারণ্য – সরিস্কা, রনথম্ভোর ও ভরতপুর। এক এক জন রাজস্থানকে দেখে এক এক রকম ভাবে। এতই বৈচিত্র্যে ভরা রাজস্থান।

‘হাতি ভাটা’ থেকে আরও ৬৫ কিলোমিটার উজিয়ে চলে এলাম রনথম্ভোরে। বাঘ দেখার জন্য বিখ্যাত রনথম্ভোরের জঙ্গল। দক্ষিণ-পূর্ব রাজস্থানে সওয়াই মাধোপুর জেলায় বিন্ধ্য ও আরাবল্লি পাহাড়ে ঘেরা ৩৯২ বর্গ কিমি এলাকা জুড়ে রনথম্ভোর জাতীয় উদ্যান। উত্তর ভারতের বৃহত্তম জাতীয় উদ্যানগুলির মধ্যে একটি এই রনথম্ভোর। জয়পুর থেকে ১৯০ কিমি ও কোটা থেকে ১১০ কিমি দূরত্বে সওয়াই মাধোপুর শহর। সওয়াই মাধোপুর স্টেশন থেকে ১৪ কিমি দূরে জাতীয় উদ্যানের প্রবেশদ্বার।

মন ভরে গেল, রনথম্ভোর।

অতীতে জয়পুরের মহারাজাদের প্রিয় শিকারভূমি ছিল এই রনথম্ভোর। ১৯৮০ সালে জাতীয় উদ্যানের স্বীকৃতি পায়। পাহাড়ে ঘেরা উঁচু-নিচু ঢেউ খেলানো রুক্ষ জমিতে শুষ্ক পর্ণমোচী অরণ্য। বন দফতরের ক্যান্টারে চড়ে জঙ্গল সাফারি। জঙ্গলে দেখা মেলে সম্বর, নীলগাই, চিতল হরিণ, লেঙুর, বুনো শুয়োর ও অজস্র ময়ূর। এ ছাড়াও এ জঙ্গলে আছে লেপার্ড, শ্লথ ভল্লুক, হায়েনা আর বিভিন্ন প্রজাতির পাখি ও সরীসৃপ। আর বনের রাজা বাঘ এ জঙ্গলের মূখ্য আকর্ষণ। বর্তমানে ৬০-৬৫টি বাঘ আছে রনথম্ভোরে।

জঙ্গলের ভিতরে রয়েছে তিনটি বিশাল লেক, যার মধ্যে পদম তালাও সব চেয়ে উল্লেখযোগ্য। তালাওয়ের কিনারে লাল বেলেপাথরে তৈরি যোগী মহল। অতীতের রাজমহল ও হান্টিং লজটি আজ একটি হেরিটেজ হোটেল। লেকের কাছেই আছে এক সুপ্রাচীন বট বৃক্ষ। শোনা যায় এটি দেশের দ্বিতীয় প্রাচীনতম বট গাছ। এ ছাড়া জঙ্গলের মাঝে এক টিলার উপর ৭০০ মিটার উচ্চতায় আছে ১০ম শতকের এক বিশাল কেল্লা – রনথম্ভোর ফোর্ট।

ঝালানা লেপার্ড ফরেস্টে।

বাঘের দর্শন পেতে দেশ-বিদেশ থেকে ছুটে আসে অসংখ্য পর্যটক ও ফোটোগ্রাফার রনথম্ভোরে। এমনকি ভারতীয় রেলের সব চেয়ে বিলাস বহুল রেল ‘প্যালেস অন হুইলস্‌’-এর সফরসূচিতেও অন্তর্ভুক্ত এই রনথম্ভোর। অতিরিক্ত ভিড় সামাল দিতে সমগ্র জঙ্গলকে পাঁচটি সার্কিটে ভাগ করে জঙ্গল সাফারির ব্যবস্থা করা হয় রনথম্ভোরে। প্রতিটি সার্কিটে একটি নির্দিষ্ট সংখ্যক গাড়ি ও ট্যুরিস্টের প্রবেশের অনুমতি মেলে। এক একটি সার্কিটে বাঘ দেখার সম্ভবনা আবার এক এক রকম।

সরিস্কার জঙ্গলের মতো অত মুক্ত ভাবে জন্তু জানোয়ার রনথম্ভোরে দেখা যায় না। তবে এখানে জঙ্গল অনেক নিবিড়, অনেক গা ছমছমে। রুক্ষ, পাথুরে জমিতে শুষ্ক গাছপালা ও ঝোপঝাড়ের আড়ালে লুকিয়ে থাকে বন্যপ্রাণীরা। মনে হয় এই বুঝি আড়াল থেকে উঁকি মারছে কোনো ডোরাকাটা। এমনকি পার্কের গেটের বাইরে পাহাড় ঘেরা উঁচু-নিচু প্রস্তরময়, ঝোপঝাড়ে ঢাকা অনেকটা প্রান্তর, যেটা পেরিয়ে পার্কের দিকে যেতে হয়, সে প্রান্তরটিও কেমন যেন গা ছমছমে। সেই প্রান্তরেই কয়েকটি হোটেল-রিসর্ট গড়ে উঠেছে। সেখানেও নাকি মাঝে মধ্যে চলে আসে লেপার্ড, কদাচিৎ কোনো বাঘ।

ডেজার্ট ফক্স, ঝালানার জঙ্গলে।

এক সঙ্গে সকলে মিলে ক্যান্টারে চড়ে রনথম্ভোরের গা ছমছমে জঙ্গলে সাফারি এক দারুণ অভিজ্ঞতা। ভাগ্যে থাকলে যদি বাঘের দর্শন মেলে তো কথাই নেই। তবে বাঘের দর্শন যদি নাও মেলে তবুও এই জঙ্গল সাফারির অভিজ্ঞতা আপনাকে এক অন্য রকম ভ্রমণের স্বাদ দেবে এ কথা হলপ করে বলা যায়। সাফারিতে দেখা পেলাম চিতল হরিণ, সম্বর, বার হেডেড গুস, ময়ূর, নীল গাই, বুনো শুয়োর, লাপ উইং, কুমির, স্পটেড আউল, ডেজার্ট ফক্স ইত্যাদি। বাঘের দেখা মেলেনি। সাফারি সেরে আবার ফিরে এলাম জয়পুরে আমাদের নির্দিষ্ট আস্তানায়।

পর দিন সকালে ‘ডাল বাটি চুর্মা’র মতো রাজস্থানের বিশেষ কিছু স্থানীয় খাবারের স্বাদ নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম আরেক জাতীয় উদ্যান ঝালানার উদ্দেশে। জয়পুর থেকে মাত্র ১৫ কিলোমিটার দুরে অবস্থিত ঝালানা লেপার্ড অভয়ারণ্য। সওয়াই জয় সিং অম্বর থেকে জয়পুরে রাজধানী স্থানান্তরিত করার আগে জয়পুর অঞ্চল ঝালানা নামেই পরিচিত ছিল।

কুটুরে পেঁচা, ঝালানা।

আরাবল্লি পর্বতে ঘেরা মাত্র ২০ বর্গ কিলোমিটার এলাকা নিয়ে এই অনন্য সুন্দর বনাঞ্চল গড়ে উঠেছে। এই বনাঞ্চলের মুখ্য আকর্ষণ হল লেপার্ড। এ ছাড়া এখানে নীল গাই, চিতল হরিণ, সম্বর হরিণ, ডেজার্ট ফক্স-সহ নানা জন্তু জানোয়ারের দেখা মেলে। একই সঙ্গে দেখা মেলে ইউরেশিয়ান পেঁচা-সহ নানা প্রজাতির শিকারী ও সাধারণ পাখী।

যাঁরা রণথম্ভোরে গিয়ে বাঘের দেখা পাবেন না, তাঁরা অবশ্যই এখানে চলে আসবেন। কারণ ঝালানা আপনাকে নিরাশ করবে না। এখানে লেপার্ডের দেখা পাবেনই। নিরাশ করেনি আমাদেরও। সেই বন্যপ্রকৃতি দর্শনের সুখস্মৃতি ক্যামেরা ও মন-ক্যামেরায় বন্দি করে ফিরে এলাম হোটেলে।

পর দিন সকালেই ঘরপানে ছুটে চললাম। ট্রেনে চেপে বসলাম কলকাতার উদ্দেশে। শেষ হল আমাদের রাজস্থান ভ্রমণ পর্ব। (শেষ)

ছবি: লেখক

আরও পড়তে পারেন

রাজভূমি রাজস্থান ১/ মরুভূমির প্রবেশদ্বার জোধপুরে

রাজভূমি রাজস্থান ২/ সোনার কেল্লার জয়সলমিরে

রাজভূমি রাজস্থান ৩/ দিলওয়ারা মন্দির, নক্কি লেকের মাউন্ট আবুতে

রাজভূমি রাজস্থান ৪/ কুম্ভলগড় ঘুরে উদয়পুরে

রাজভূমি রাজস্থান ৫/ মীরাবাঈ-পদ্মিনীর চিতোরগড়ে

রাজভূমি রাজস্থান ৬/ অজমের শরীফ ঘুরে পুষ্করে

রাজভূমি রাজস্থান ৭/ গোলাপি শহর জয়পুরে 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *