রাজভূমি রাজস্থান ৭/ গোলাপি শহর জয়পুরে 

হাওয়ামহল থেকে সিটি প্যালেস ও যন্তর মন্তর।

সঞ্জয় হাজরা

পুষ্কর লেকের ধারে ব্রহ্মামন্দির দর্শন করে সক্কালেই রওনা হয়ে গেলাম আমাদের পরবর্তী গন্তব্য জয়পুরের উদ্দেশে। দূরত্ব ১৪৫ কিলোমিটার। অজমের শরীফকে ডান দিকে রেখে আমরা এগিয়ে চললাম। পথ সুন্দর, মসৃণ। মরুদেশ রাজস্থানকে পিছনে ফেলে আমরা ক্রমশ এগিয়ে চলেছি সবুজ রাজস্থানের দিকে। পথে পড়ল কিষানগড় – কিষানগড় দুর্গ, গোন্ডুলাও লেক, ফুলমহল প্রাসাদ, খোড়া গণেশ মন্দিরের জন্য বিখ্যাত। এ হেন কিষানগড় দেখা আমাদের পরবর্তী কোনো ভ্রমণের জন্য তোলা রইল। সুপ্রশস্ত রাজপথ দিয়ে জয়পুর পৌঁছেতে আমাদের প্রায় পৌনে তিন ঘণ্টা লাগল। পৌঁছে গেলাম আমাদের এখানকার ঠিকানা রাজস্থান পর্যটনের হোটেল গঙ্গৌরে।

রাজস্থানের রাজধানী জয়পুর ‘পিঙ্ক সিটি’ তথা ‘গোলাপি শহর’ হিসাবে খ্যাত। আন্তর্জাতিক পর্যটন মানচিত্রে রাজস্থান খুবই জনপ্রিয় গন্তব্য। আর এই রেগিস্থান রাজস্থান ভ্রমণ অপূর্ণ থেকে যায় যদি কারও ভ্রমণসূচি থেকে জয়পুর শহর বাদ থাকে। তাই দেশ-বিদেশের বহু পর্যটক বছরভর ছুটে আসে রাজস্থানের এই ‘পিঙ্ক সিটি’ তথা ‘গোলাপি শহর’ দেখতে।

জয়পুরে সাতটি প্রবেশ ফটকের একটি।

কিন্তু জয়পুর শহর ‘পিঙ্ক সিটি’ হল কেন? ১৮৭৬-এর জানুয়ারিতে ‘প্রিন্স অব ওয়েলস’ অ্যালবার্ট (যিনি পরে রাজা সপ্তম এডোয়ার্ড হিসাবে পরিচিত হন) এসেছিলেন জয়পুর সফরে। তাঁর প্রতি আতিথেয়তার নিদর্শনস্বরূপ শহর গোলাপি রঙে রঞ্জিত করা হয়।  সেই থেকেই চালু হয় বিধান – শহরের ঘরবাড়ি দোকানপাট সবই গোলাপি রঙে রাঙাতে হবে। আমাদের সারথির মুখে শুনলাম, এর যদি কেউ ব্যতিক্রম করে অন্য কোনো রঙ ব্যবহার করে তা হলে প্রশাসনের তরফে তাকে মোটা টাকার জরিমানা করা হয়।

রাজস্থানি সংস্কৃতিতে গোলাপি রঙের এক অনন্য ব্যাঞ্জনা আছে। আতিথেয়তা বোঝাতে এই রঙ ব্যবহার করা হয়। তাই অ্যালবার্টকে স্বাগত জানাতে গোলাপি রঙে রাঙানো হয়েছিল শহর। এই রঙের জন্যই সূর্যাস্তের সময় জয়পুর এক মায়াবী রূপ ধরে পর্যটকদের অভিভূত করে। আর প্রায় সমস্ত বাড়িঘর, জানলায় জাফরির কাজ জয়পুরকে অন্য শহরের থেকে আলাদা করে রাখে।   

আমাদের রাত্রিবাসের ঠিকানায় লাগেজ রেখে বেরিয়ে পড়লাম জয়পুর দর্শনে।

জলমহল।

কী করে পত্তন হল জয়পুরের? একটু ইতিহাসের পাতায় চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক। দ্বিতীয় জয় সিংহ কাছাওয়া মাত্র ১৩ বছর বয়সে অম্বর তথা আমেরের সিংহাসনে বসেন। তারও আগে মাত্র সাড়ে ৭ বছর বয়সে জয় সিংহ রাজদর্শনে দিল্লি গিয়েছিলেন। দিল্লির সিংহাসনে তখন সম্রাট আওরঙ্গজেব। মোলাকাত হল সম্রাটের সঙ্গে। বালক জয় সিংহের বুদ্ধিমত্তায় খুশি হয়ে সম্রাট তাঁকে ‘সওয়াই’ খেতাব দিলেন। ‘সওয়াই’ অর্থে সওয়া, অর্থাৎ একের থেকে আরও চার ভাগের এক ভাগ বেশি।

সেই সওয়াই জয় সিংহই তাঁর শাসনাকালে পাহাড়ি অঞ্চল অম্বর থেকে রাজধানী স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত নিলেন। জনসংখ্যা ক্রমশই বেড়ে চলেছে। পানীয় জলেরও অভাব। রাজধানী এমন জায়গায় হওয়া চাই যেখানে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার ঠাঁই হবে, থাকবে পর্যাপ্ত পানীয় জল। জায়গা বাছা হল অম্বর থেকে ১২ কিমি দূরে। ১৭২৭ সালে জয়পুর শহরের গোড়াপত্তন হল। রাজার নির্দেশে বিদ্যাধর ভট্টাচার্য নামে বাংলার এক কৃতী স্থপতি এই শহরের নকশা তৈরি করেন।

হাওয়ামহল।

আসুন, এ বার আমরা একটু জেনে নিই কে ছিলেন এই বিদ্যাধর ভট্টাচার্য। বিদ্যাধর ভট্টাচার্য বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের নৈহাটিতে এক ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি গণিত, জ্যোতিষ, বাস্তুশাস্ত্র, পূর্তবিদ্যা এবং রাজনীতিতে পারদর্শী ছিলেন। তিনি প্রথমে জয়পুরের মহারাজের আমন্ত্রণে আমের শহরে কনিষ্ঠ নিরীক্ষক হিসেবে কাজ শুরু করেছিলেন। পরবর্তী কালে মহারাজা সওয়াই জয় সিংহ তাঁকে মন্ত্রীপদে নিযুক্ত করেছিলেন। মহারাজা জয় সিংহ জয়পুর শহর নির্মাণের জন্য বিদ্যাধর ভট্টাচার্যকে অনুরোধ করেন। বিদ্যাধর প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্য, জ্যোতির্বিজ্ঞান, টলেমি ও ইউক্লিডের বইগুলি পড়ে নানা ছক নিয়ে মহারাজার সঙ্গে আলোচনা করে ১৭২৬ সালে কৌশলগত পরিকল্পনার সঙ্গে শহরটির নির্মাণকাজ শুরু করেন। প্রধান প্রাসাদ এবং রাস্তাঘাট সম্পূর্ণ করতে চার বছর সময় লেগেছিল।

রাজা জয় সিংহের নামানুসারেই শহরের নাম হয় জয়পুর। ভারতীয় শিল্পকলার শিল্পশাস্ত্রের নীতি অনুসরণ করে এই জয়পুর শহর নির্মিত হয়েছিল। জয়পুর শহর হল ভারতের প্রথম পরিকল্পিত শহর। বিদ্যাধর ভট্টাচার্য শহরের মডেল তৈরি করার জন্য শিল্পশাস্ত্র ও বাস্তুশাস্ত্রের নীতিমালা প্রণয়ন করেন। শহরের নিরাপত্তার জন্য দৃঢ় স্থাপত্যের সাতটি দরজা নির্মিত হয়, নির্মিত হয় বিশাল দুর্গপ্রাচীরও। বিদ্যাধর ভট্টাচার্য ১৭৫১ সালে মাত্র ৫৮ বছর বয়সে মারা যান। এই বিদ্যাধর ভট্টাচার্যের স্মৃতির উদ্দেশে তৎকালীন মহারাজা রাম সিংহ জয়পুর শহর থেকে ৮ কিলোমিটার দূরে একটি বাগান নির্মাণ করিয়েছিলেন, যা ‘বিদ্যাধরজি কি বাগ’ হিসাবে পরিচিত।

হাওয়ামহলে প্রবেশ ফটক।

কেল্লার শহর জয়পুর। তাই দর্শন শুরু করা যাক মূল শহর থেকে কিছুটা দূরে আমের কেল্লা বা অম্বর ফোর্ট দিয়ে। জয়পুরে স্থানান্তরের আগে কাছাওয়া রাজপুতদের রাজধানী ছিল অম্বর। শহরের উত্তর-পূর্বে আরাবল্লি পর্বতের ঢালে সিপিয়া রঙের প্রাসাদ তথা দুর্গ। রাজপুত স্থাপত্যের এক অপূর্ব নিদর্শন অম্বর প্রাসাদ। প্রচলিত ইতিহাস মতে, মুঘল সম্রাট আকবরের সেনাপতি মান সিংহের হাতে শুরু হয় এর নির্মাণ। সময়টা ছিল ১৫৯২ সালে। কিন্তু এই প্রাসাদ সম্পূর্ণতা পায় শতাধিক বছর পরে রাজা সওয়াই জয় সিংহের হাতে। অতীতের জৌলুস আজও অমলিন। প্রাসাদের দেওয়ালে মোজাইকে, আয়নার অলংকরণে মুঘল শৈলীর ছাপ স্পষ্ট।

৫টি গেট পেরিয়ে মান সিংহের রাজমহল। এ ছাড়াও এখানে দেখার জন্য রয়েছে দেওয়ানি আম, মান সিংহের প্রাসাদ, জয় মন্দির তথা দেওয়ানি খাস, জেনানামহল, শিশমহল, যশ মন্দির, সোহাগ মন্দির, সুখ মন্দির, সুখ নিবাস ইত্যাদি। এবং সর্বোপরি যশোরেশ্বরী মন্দির। ১৬০৪ সালে মান সিংহ বারো ভুঁইয়াদের অন্যতম যশোরের রাজা প্রতাপাদিত্যকে হারিয়ে বাংলা জয় করেন। এবং যশোরের অধিষ্ঠাত্রী দেবী মাতা যশোরেশ্বরীকে নিয়ে এসে অম্বরে প্রতিষ্ঠা করেন। বাংলা থেকে পুরোহিতও নিয়ে যাওয়া হয়। শ্বেতপাথরের অষ্টভুজা দেবীমূর্তি মন ভরিয়ে দেয়।

জয়পুর শহরে মানসাগর সরোবরের মাঝে রাজাদের গ্রীষ্মাবাস জলমহল। এখন এটি হোটেল। এই জলমহলের সামনে দিয়েই পথ উঠেছে জয়গড় কেল্লা যাওয়ার। মূলত রাজ্যের প্রতিরক্ষা মজবুত করতে ১৭২৬ সালে এই কেল্লা তৈরি হয়। এশিয়ার বৃহত্তম কামান দেখতে হলে চলে আসতে হবে এই জয়গড়ে। এই ফোর্টে জল সংরক্ষণেরও ব্যবস্থা রয়েছে। কাছেই নাহারগড় কেল্লা। ‘নাহার’ শব্দের অর্থ বাঘ। সওয়াই মাধো সিংহের মহিষীদের জন্য তৈরি হয়েছিল নাহারগড়ের প্রাসাদ।   

হাওয়ামহলের ভিতরে।

‘হার্ট অব দ্য সিটি’ অর্থাৎ শহরের কেন্দ্রস্থল বলতে যাকে বোঝায়, জয়পুর শহরের সেই অঞ্চলে রয়েছে হাওয়ামহল, সিটি প্যালেস আর যন্তর মন্তর। কলকাতা বলতেই চোখের সামনে যেমন হাওড়া ব্রিজের ছবিটা ভাসে, তেমনই জয়পুর বলতেই ভাসে হাওয়ামহলের ছবি।

হাওয়ামহলই হল এখানকার এক নম্বর দর্শনীয় স্থান। রাজপরিবারের পর্দানশীন মহিলারা যাতে বাইরের শহর দেখতে পারেন, দৈনন্দিন জীবন উপভোগ করতে পারেন, মহলে বসে বাইরের উৎসব পর্যবেক্ষণ করতে পারেন তার জন্যই মহারাজা সওয়াই প্রতাপ সিংহ এই হাওয়ামহল তৈরি করান। এই মহলে বেলেপাথরের জালি পর্দার জানলায় বসে রাজপথের দৃশ্য উপভোগ করতেন রাজমহিষীরা। এ ধরনের ৯৫৩টি ছোটো ছোটো জানালা এই হাওয়া মহলে আজও অক্ষত অবস্থায় দেখতে পাবেন। এই প্রাসাদের অর্ধ অষ্টভুজাকার ঝোলানো গবাক্ষ, জালি ও জাফরির কাজ, ছাদ, গম্বুজ – সব কিছুতেই রয়েছে বৈচিত্র্য।

সিটি প্যালেসের ভিতরে।

হাওয়ামহলের কাছেই সিটি প্যালেস। রীতিমতো এক ছোটো শহর এই নগর প্রাসাদ। রাজস্থানি ও মুঘল স্থাপত্যে তৈরি এই প্রাসাদ মূলত সওয়াই জয় সিংহের হাতে গড়া। স্যার স্যামুয়েল সুইন্টন জ্যাকবের পাশাপাশি বিদ্যাধর ভট্টাচার্যও জয়পুরের সিটি প্যালেসের স্থপতি হিসেবে গণ্য হয়েছিলেন। পরে এই সিটি প্যালেসে নতুন নতুন মহলের সংযোজন ঘটেছে পরবর্তী মহারাজদের হাতে।

মুবারক মহল, রয়্যাল গেস্টহাউস, শিলেখানা, দেওয়ানি খাস, দেওয়ানি আম, চন্দ্রমহল ইত্যাদি দর্শনীয় স্থান রয়েছে এই সিটি প্যালেসে। আর রয়েছে গোবিন্দজির মন্দির। আওরঙ্গজেবের ধ্বংসলীলা থেকে বাঁচাতে সওয়াই জয় সিংহ বৃন্দাবন থেকে গোবিন্দজিকে এনে এখানে প্রতিষ্ঠা করেন। উল্লেখ্য, বাঙালি পুরোহিতরা বংশ পরম্পরায় গোবিন্দজির পুজো করে আসছেন।

কাছেই যন্তর মন্তর। জ্যোতির্বিজ্ঞানে খুব আগ্রহ ছিল সওয়াই জয় সিংহের। তাঁর হাতে তৈরি ৫টি যন্তর মন্তর তথা মানমন্দির রয়েছে ভারতে। একটি হল এই জয়পুরে। বাকি চারটি দিল্লি, বারাণসী, উজ্জয়িনী এবং মথুরায়।             

যন্তর মন্তর।

সিটি প্যালেস, যন্তর মন্তর ও হাওয়া মহল দেখে স্থানীয় চকে নানান রকমারি দ্রব্যের কেনাকাটা সেরে হোটেলে ফিরে চললাম সে দিনের মতো। কারণ আগামী কাল খুব সকালেই রওনা দিতে হবে প্রায় ১৯০ কিলোমিটার দূরে রণথম্ভোর জাতীয় উদ্যানের পথে। জয়পুরে আরও অনেক কিছুই বাকি রইল দেখার। সে সব তোলা রইল ভবিষ্যতের জন্য। (চলবে)

ছবি: লেখক

আরও পড়তে পারেন

রাজভূমি রাজস্থান ১/ মরুভূমির প্রবেশদ্বার জোধপুরে

রাজভূমি রাজস্থান ২/ সোনার কেল্লার জয়সলমিরে

রাজভূমি রাজস্থান ৩/ দিলওয়ারা মন্দির, নক্কি লেকের মাউন্ট আবুতে

রাজভূমি রাজস্থান ৪/ কুম্ভলগড় ঘুরে উদয়পুরে

রাজভূমি রাজস্থান ৫/ মীরাবাঈ-পদ্মিনীর চিতোরগড়ে

রাজভূমি রাজস্থান ৬/ অজমের শরীফ ঘুরে পুষ্করে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *