রাজভূমি রাজস্থান ৬/ অজমের শরীফ ঘুরে পুষ্করে

Pushkar Lake

সঞ্জয় হাজরা

চিতোরগড় ভ্রমণ শেষ করে পর দিন সকালেই আমরা বেরিয়ে পড়লাম। আজকের গন্তব্য ২১১ কিলোমিটার দূরের অজমের শহর। সোয়া চার ঘণ্টার পথ।

অজমের জেলায় অবস্থিত অজমের শহর দরগাহ শরীফের জন্য বিখ্যাত হলেও, এখানে ধর্ম, ইতিহাস ও স্থাপত্য, এই তিনের সমন্বয় ঘটেছে। তেমনই সর্ব ধর্ম সমন্বয়ের প্রকৃষ্ট উদাহরণ এই অজমের শরীফ। আনা সাগরের পাড়ে পাহাড়বেষ্টিত এই শহর দেড় হাজার ফুটেরও বেশি উচ্চতায় অবস্থিত।

কী করে এই শহরের নাম অজমের হল? যথারীতি এ ক্ষেত্রেও নানা মুনির নানা মত। খ্রিস্টীয় সাত শতকে অজয় পাল চৌহানের হাতে এই শহরের পত্তন। অনেকের মতে স্রষ্টার নাম থেকেই শহরের নাম। আবার কেউ কেউ বলেন, অজয়মেরু বা অজয় পর্বত থেকেই শহরের নাম অজমের। বিতর্ক থাক। আমরা অজমের পৌঁছেই দরগাহ দর্শনে চলে যাই।

খাজা মইনুদ্দিন চিশতীর দরগাহ।

আগেই বলেছি, অজমের শরীফের এই দরগা হল হিন্দু মুসলিম-সহ সকল ধর্মের মানুষের এক মহামিলন ক্ষেত্র। আজমীর শরীফ দরগাহ, হযরত খাজা মইনুদ্দিন চিশতির দরগাহ যা খাজা বাবার মাজার নামেও পরিচিত। সারা বছরই ভারতের নানা প্রান্ত-সহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে দর্শনার্থীরা এখানে আসেন। এখানে শ্বেতপাথরের সমাধিবেদী, রূপার রেলিং, সোনায় মোড়ানো সিলিং, রূপার পাতে মোড়া বুলুন্দ দরজা আপনাকে আকর্ষিত করবেই।

১২৩৬ সালে সুলতান ইলতুতমিশের হাতে শুরু হয়েছিল এই দরগাহর নির্মাণ এবং তা ষোড়শ শতকে সম্রাট হুমায়ুনের তত্ত্বাবধানে এর বুলুন্দ দরজার কাজ দিয়ে শেষ হয়। আবার সম্রাট আকবর ১৫৬৭ সালে ৩০ মিটার উচুঁ দরগাহের মূল প্রবেশপথের বুলুন্দ দরজাটি তৈরি করিয়েছিলেন। তবে এখানে এসে ১২০ মন ও ৮০ মন চাউলের বিরিয়ানি রান্না করার দুটি হাঁড়ি দেখে নিতে ভুলবেন যেন।

খাজা মইনুদ্দিন চিশতী হলেন ভারতীয় উপমহাদেশে চিশতীয় ধারার সব চেয়ে বিখ্যাত সুফি সাধক। তিনি ১১৪১ সালে পারস্যের সিসটান রাজ্যের চিশতীতে জন্মগ্রহণ করেন। এর পর তিনি তাঁর শিক্ষা এবং ইসলাম ধর্মবিষয়ের ওপরে পাণ্ডিত্যের মাধ্যমে তৎকালীন বিভিন্ন জ্ঞানী, গুণী, পণ্ডিত, দার্শনিক-সহ অসংখ্য সুফি সাধকের সঙ্গ লাভ করে এক বিশাল জ্ঞানের অধিকারী হন। এর পর তিনি আরব থেকে ইরাক, ইরান, আফগানিস্তান হয়ে প্রথমে লাহোর পরে দিল্লি হয়ে আজমিরে বসতি স্থাপন করেন। তিনিই ছিলেন ভারতীয় উপমহাদেশে ইসলাম প্রচারে কিংবদন্তিতুল্য একজন ঐতিহাসিক সুফি ব্যক্তিত্ব। তাঁর রচিত একটি বিখ্যাত বই হল ‘আনিসুল আরওয়াহ’।

আনা সাগর, অজমের।

অজমের দরগাহ দর্শনের পরে ঘুরে দেখুন আনা সাগর হ্রদ (অজমের সরোবর)। এটি মানবসৃষ্ট বিশ্বের সর্ববৃহৎ জলাধার। তৎকালীন দিল্লি এবং রাজস্থানের শাসক পৃথ্বীরাজ চৌহান এটি নির্মাণ করিয়েছিলেন। এর বিস্তৃতি এবং নীল জলরাশি আপনাকে মুগ্ধ করবেই।

এই আনা সাগর ও খাজা মইনুদ্দিন চিশতীকে জড়িয়ে একটি প্রচলিত কাহিনি এখানকার লোকমুখে খুবই শোনা যায়। বলা হয় চিশতী অজমেরে আসার পরে এখানকার হিন্দু জনগণ তাঁকে এবং তাঁর অনুগামীদের হ্রদের জল ব্যবহার করতে বারণ করেন। তিনি তখন হ্রদ থেকে মাত্র এক পেয়ালা জল দিতে তাঁদের অনুরোধ করেন। স্থানীয় মানুষজন এতে সম্মত হয়। অলৌকিক ঘটনা ঘটে পরদিন ভোরে। দেখা যায় হ্রদের সব জল শুকিয়ে গেছে। এতে স্থানীয় জনগণের মধ্যে ব্যাপক চাঞ্চল্য ও ভীতির সৃষ্টি হয়। তাঁরা বুঝতে পারেন হযরত খাজা সাহেব রহ. অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন দরবেশ ও আল্লাহর অলি। তাই তাঁরা খাজা সাহেবের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। তিনি আল্লাহ তালার কাছে দোয়া করেন এবং ওই পেয়ালার জল হ্রদে ফেলে দেওয়ার হুকুম দেন। আল্লাহর অশেষ কৃপায় পরদিন হ্রদ আবার জলে ভর্তি হয়ে যায়। এটা হযরত খাজা সাহেবের কারামত। এর পর থেকে তাঁর শিষ্য ও অনুসারীদের সংখ্যা বাড়তে থাকে। দলে দলে লোক ইসলাম ধর্মও গ্রহণ করতে থাকে।

সূর্যাস্ত দেখার উদ্দেশ্যে মেরুদেশে।

সে যা-ই হোক না কেন, আনা সাগর ঘুরে এর পরে আমরা চলে এলাম ১৮ কিলোমিটার দূরে পুষ্করে। পুষ্করেই আমাদের রাত্রিবাস। ঠিকানা যথারীতি রাজস্থান পর্যটনের ‘হোটেল সরোবর’। হোটেলে আমাদের লাগেজ ফেলেই বেরিয়ে পড়লাম উটের গাড়িতে চড়ে মরুদেশের সূর্যাস্ত দেখতে। এখানকার মরুভূমিতে সূর্যাস্ত আপনাকে এক অলীক অনুভূতি দেবে। সঙ্গে থাকবে স্থানীয় অধিবাসীদের লোকগান ও লোকনৃত্য। পাশাপাশি আছে আমলকী এবং গোলাপ ফুলের বাগান। সে দিনের মতো বিশ্রাম।

স্থানীয় অধিবাসীদের লোকগান।

পরের দিন সকালেই বেরিয়ে পড়লাম হোটেল থেকে হাঁটাপথের দূরত্বে বিশ্বের একমাত্র ব্রহ্মা মন্দির দর্শন করতে। আর এর পাশেই রয়েছে সেই বিখ্যাত সরোবর পুষ্কর, যার নামানুসারেই এই জায়গার নাম পুষ্কর। রামায়ণ, মহাভারত, পদ্মপুরাণ প্রভৃতি প্রাচীন গ্রন্থেও পুষ্করের উল্লেখ আছে। মহাভারত অনুসারে পুষ্কর ভারতের প্রাচীনতম তীর্থস্থানগুলির অন্যতম। হিন্দু ধর্মমতে প্রধান তিন দেবতা হলেন ব্রহ্মা, বিষ্ণু এবং মহেশ্বর বা শিব। ব্রহ্মা জগতে সমস্ত কিছু সৃষ্টি করেন। তিনি সকল প্রাণী এবং সকল বস্তুর স্রষ্টা তথা পরম পিতামহ। তার পরে আছেন বিষ্ণু, যিনি সৃষ্টির পালনকর্তা ও রক্ষক। তিনি মানুষের সকল জীবনের সমস্যা এবং সেগুলোর কী করে মোকাবিলা করা যায়, সেটা শিখিয়ে দেন। সর্বশেষে আছেন শিব অথবা মহেশ্বর, যিনি প্রলয় ঘটিয়ে সৃষ্টির নাশ করেন।

ব্রহ্মা এই মহাবিশ্ব সৃষ্টি করে পৃথিবী সৃষ্টি করলেন এবং তার পর সৃষ্টি করলেন ‘মনু’কে। মনু হলেন এই পৃথিবীর প্রথম প্রোটোটাইপ মানুষ যার নাম স্বয়ম্ভূ, ব্রহ্মার আধ্যাত্মিক পুত্র। এ হেন এক পরম দেবতা আমাদের সৃষ্টিকর্তা অথচ মজার কথা হল তাঁকে উৎসর্গ করা মন্দির এই ভূভারতে খুব বেশি দেখা যায় না। প্রধানত ব্রহ্মাই মূল বিগ্রহ, এমন মন্দিরের সংখ্যা হাতে গোনা যায়। তবে অনেক মন্দিরেই ব্রহ্মা স্থান পেয়েছেন আলাদা করে, যেখানে প্রধান আরাধ্য দেবতা অন্য কেউ।

পুষ্করের ব্রহ্মামন্দির।

ব্রহ্মার মন্দির নেই কেন? এর কারণ দেখানো হয়েছে পুরাণে। পুরাণের তথ্য অনুযায়ী ব্রহ্মার প্রথম পত্নী সাবিত্রীর দেওয়া অভিশাপের জন্যেই তিনি পৃথিবীতে আলাদা ভাবে পূজিত হন না। ঘটনাটি হল, স্বয়ং ব্রহ্মা যখন জগৎ সৃষ্টি করার পরে যখন যজ্ঞ করতে বসেছিলেন তখন মাতা সাবিত্রী সেখানে উপস্থিত ছিলেন না। এ দিকে সময় অতিবাহিত হয়ে যাচ্ছে। প্রথম পত্নী নেই, কিন্তু তাঁর দ্বিতীয় পত্নী কাছেই রয়েছেন। তাই তাঁকে পাশে বসিয়েই যজ্ঞ শুরু করে দিয়েছিলেন ব্রহ্মা। এর পরে মাতা সাবিত্রী এসে দেখলেন যে তাঁর অনুপস্থিতিতে তাঁর স্বামী ওপর স্ত্রীকে নিয়ে পুজোয় বসেছেন। তখন তিনি কুপিত হয়ে স্বয়ং ব্রহ্মাকে বলেন, “হে প্রভু, আপনিই এই জগতের সৃষ্টিকর্তা, নিয়ম-বিধাতা। আর আপনিই কিনা নিয়ম ভঙ্গ করলেন। আমার উপস্থিতি সত্ত্বেও আপনি ওপর স্ত্রীকে আমার জায়গা দিলেন। তাই আমি আপনাকে শাপ দিচ্ছি এই ধরিত্রীতে আপনি কখনোই একক ভাবে পূজিত হবেন না”।

ভারতে প্রধানত ছটি ব্রহ্মামন্দির আছে। তার মধ্যে সব থেকে বিখ্যাত এবং প্রাচীন মন্দিরটি হল পুষ্কর লেকের পাড়ের ব্রহ্মামন্দিরটি।

লেকের পাড়ে আমরা।

ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর অর্থাৎ ত্রিদেবের যজ্ঞস্থল পুষ্কর সরোবর। পুরাণ মতে, পরশুরাম এই তীর্থের প্রতিষ্ঠাতা। ব্রহ্মা হাতে পদ্ম নিয়ে যজ্ঞের স্থান নির্বাচনের জন্য বেরিয়েছিলেন। তাঁর হাতের পদ্মটি যেখানে পড়েছিল সেখানে বসেই তিনি তপস্যা শুরু করেন। সেই থেকে জায়গাটির নাম হয় পুষ্কর। প্রত্যেক বছর কার্তিক পূর্ণিমায় (নভেম্বর মাসে) ১০ দিন ধরে মেলা ও পুণ্যস্নান চলে এখানে। তখন সারা ভারত থেকে আসা পুণ্যার্থীদের ভিড়ে ভরে যায় পুরো অঞ্চলটি।

শেষ হল আমাদের পুষ্কর ভ্রমণ। এ বার আমরা রওনা দিলাম আমাদের পরবর্তী গন্তব্য রাজস্থানের রাজধানী তথা প্রাচীনতম শহর জয়পুরের উদ্দেশে। তবে সেই গল্প শুনব আমরা আগামী পর্বে। (চলবে)

ছবি: লেখক

আরও পড়তে পারেন

রাজভূমি রাজস্থান ১/ মরুভূমির প্রবেশদ্বার জোধপুরে

রাজভূমি রাজস্থান ২/ সোনার কেল্লার জয়সলমিরে

রাজভূমি রাজস্থান ৩/ দিলওয়ারা মন্দির, নক্কি লেকের মাউন্ট আবুতে

রাজভূমি রাজস্থান ৪/ কুম্ভলগড় ঘুরে উদয়পুরে

রাজভূমি রাজস্থান ৫/ মীরাবাঈ-পদ্মিনীর চিতোরগড়ে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *