রাজভূমি রাজস্থান ৪/ কুম্ভলগড় ঘুরে উদয়পুরে

সঞ্জয় হাজরা

মাউন্ট আবু থেকে উদয়পুর ১৬৩ কিমি। কিন্তু আমরা যাব ঘুরপথে, কুম্ভলগড় হয়ে। এই পথে দূরত্ব ২৫০ কিলোমিটারের মতো। তাই মাউন্ট আবু থেকে সকাল সকালই বেরিয়ে পড়লাম।

আমাদের প্রথম গন্তব্য কুম্ভলগড় দুর্গ। চলে এলাম ১৬৮ কিলোমিটার পথ। শেষের দিকের পথ বেশ পাহাড়ি। আরাবল্লি পর্বতের বন্ধুর ঢালে এক স্থান নির্বাচন করে ভূপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১১০০ মিটার উপরে এক দুর্ভেদ্য দুর্গ গড়ে তোলেন মেওয়ারের রানা কুম্ভ। নির্মাণকাজ শুরু করেন ১৪৪৩ খ্রিস্টাব্দে। ১৫ বছরের অক্লান্ত প্রচেষ্টায় নির্মাণ সম্পুর্ণ হয়। ইতিহাস বলে, এই দুর্গ দুর্ভেদ্য ও অজেয়। তাই একে ‘অজেয়দুর্গ’ বলেও ডাকা হয়।

বলা হয়, কুম্ভলগড় দুর্গের প্রাচীর দৈর্ঘ্যে বিশ্বের সপ্তম আশ্চর্যের অন্যতম ৬৪০০ কিলোমিটার দীর্ঘ চিনের প্রাচীরের পরেই। এই পাঁচিলের ব্যাপ্তি প্রায় ৩৬ কিলোমিটার। আরও কিছু মাপকাঠিতে কুম্ভলগড় দুর্গ দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে রয়েছে। রাজস্থানের দ্বিতীয় প্রাচীন দুর্গ কুম্ভলগড়, প্রাচীনতম অবশ্যই চিতোর দুর্গ। গুরুত্বের দিক দিয়েও চিতোর দুর্গের পরেই কুম্ভলগড়ের স্থান। তবুও রাজস্থানের অন্যান্য দ্রষ্টব্য নিয়ে ঢক্কানিনাদের আড়ালে কিছুটা যেন ব্রাত্যই থেকে যায় কুম্ভলগড়।

সিটি প্যালেস, উদয়পুর।

মজার কথা হল, কুম্ভলগড়ে বিশ্বের দ্বিতীয় দীর্ঘ পাঁচিলটি এতটাই দুর্ভেদ্য ও সৃজনশীল কৃষ্টি দিয়ে তৈরি যে এটি আপনাকে আকৃষ্ট করবেই। যেমন ধরুন, এই পাঁচিলের উপর দিয়ে পাশাপাশি ৮টি ঘোড়া এক সঙ্গে যেতে পারত। এর থেকেই বোঝা যায় যে এই পাঁচিল কতটা চওড়া ছিল। এই পাঁচিলের জন্যই মুঘলরা বার বার এটিকে আক্রমণ করেও দখল করতে পারেনি।

বীর রাজপুত যোদ্ধা মহারানা প্রতাপের জন্ম হয়েছিল এই কুম্ভলগড় দুর্গেই। এই দুর্গকে মহান করে গেছেন ইতিহাসখ্যাত ধাত্রী পান্না। প্রভুপুত্রের জীবন বাঁচাতে নিজের পুত্রকে তুলে দিয়েছিলেন ঘাতকের হাতে।

যতটা সম্ভব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলাম কুম্ভলগড় দুর্গ। সাত দরজা দিয়ে প্রবেশ করে পৌঁছোতে হয় পাহাড়চুড়োয় অবস্থিত প্রাসাদে। দেখে নেওয়া যায় বাদল মহল, দরবার হল তথা মেঘ দরবার, প্রতাপের জন্মস্থল ইত্যাদি। এক সময়ে ৩৬৫টি মন্দির ছিল এই দুর্গে। এখন বেশির ভাগই ধ্বংস। তবে দুর্গের নীচে বিধ্বস্ত জৈন মন্দিরটি দেখে নেওয়া যায়। ভালো করে দুর্গটি ঘুরে দেখতে বেশ কয়েক ঘণ্টা সময় লাগবে।

কুম্ভলগড়ে বেশ খানিকক্ষণ সময় কাটিয়ে ফের রওনা হলাম উদয়পুরের উদ্দেশে। ৮২ কিলোমিটার পথ। ঘণ্টা দেড়-দুয়ের মধ্যে পৌঁছে গেলাম উদয়পুর শহরে। এখানে আমাদের ঠাঁই যথারীতি রাজস্থান পর্যটনের হোটেলে। একটা নাতিউচ্চ টিলায় অবস্থিত হোটেল কাজরী।

সিটি প্যালেসের ভিতরে।

আরাবল্লি পর্বতশ্রেণির সবুজ পাহাড়ি ঢালে অবস্থিত অপরূপ এবং মনোমুগ্ধকর শহর উদয়পুর। এর গোড়াপত্তন ঘটে ১৫৫৯ খ্রিস্টাব্দে। মুঘল সম্রাট আকবরের মেওয়ার রাজ্য আক্রমণের পরিকল্পনা জানতে পেরে তৎকালীন মেওয়ারের রানা দ্বিতীয় উদয় সিং চিতোরগড় থেকে ১২০ কিলোমিটার পশ্চিমে আরাবল্লি পর্বতশ্রেণির মাঝে পিছোলা লেকের পাড়ে এই উদয়পুরে তার রাজধানী নিয়ে আসেন। আর তখন থেকেই সূচনা হয় ঐতিহাসিক এই উদয়পুর রাজ্যের। ভারতবর্ষের রাজপরিবারগুলোর মধ্যে সব থেকে ধনী রাজপরিবার হল এই মেওয়ার রাজপরিবার। এই রাজবংশের সদস্যরা ভারতের অন্যতম বিলাসবহুল হোটেল গোষ্ঠী এইচআরএইট গ্রুপের মালিক।

পরের দিন আমাদের উদয়পুর ভ্রমণ শুরু হল। উদয়পুরে দেখার মতো অনেক জায়গা আছে। তবে প্রথম গন্তব্য অবশ্যই পিছোলা লেকের পুব পাড়ে অবস্থিত ‘উদয়পুর সিটি প্যালেস’। এখানে প্রবেশের জন্যে ভারতীয়দের জনপ্রতি ৩০০ টাকার টিকিট লাগে। গ্রানাইট পাথরে গড়া এই প্রাসাদ। মহারানা উদয় সিং এই দুর্গ গড়ে রাজধানী উদয়পুরের গোড়াপত্তন করেন। তার পর ৩০০ বছর ধরে বিভিন্ন মহারানার হাতে দুর্গের পরিধি-বিস্তৃতি বেড়েছে, যুক্ত হয়েছে মহলের পর মহল। বর্তমানে ১১টি মহল রয়েছে এই প্রাসাদে।

মূল ফটক দিয়ে ঢোকার পরেই যে কোনো পর্যটক অনুভব করতে পারবেন সিটি প্যালেসে বিশালত্ব ও বৈভব। এই বৈভব আপনাকে মনে করিয়ে দেবে তৎকালীন রাজাদের জীবনযাপনের মানকে। এখানকার রাজপরিবারের সদস্যরা এখনও এই প্রাসাদে বসবাস করেন।

জগ মন্দির প্যালেস।

ত্রিপোলিয়া গেট দিয়ে ঢুকে প্রথম প্রাসাদ-চত্বর। ত্রিপোলিয়ার পিছনে গণেশ দেউড়ি। পথ চলে গিয়েছে দক্ষিণে রাজ-অঙ্গন তথা রয়্যাল কোর্টইয়ার্ডে। প্রাসাদের শিশমহল, কৃষ্ণা ভিলা, ভীম ভিলা, দিলখুশমহল, মানকমহল, রঙিন কাচের মোতিমহল, অমরবিলাস – প্রতিটি মহলই কারুকার্যে অনুপম। এই প্রাসাদের কাচের কাজ থেকে শুরু করে পাথরের কাজ কিংবা দেয়ালে ঝুলতে থাকা শত শত বছরের পুরোনো পেন্টিং এবং পুরোনো দিনের নানা রকম জিনিসপত্রের সংগ্রহশালা মুগ্ধ করে রাখবে যে কোনো পর্যটককে।

বিশাল বড়ো এই প্রাচীন প্রাসাদটি খুঁটিয়ে দেখতে বেশ খানিকটা সময় লেগে যাবে। প্রাসাদের ওপর থেকে দেখতে পাবেন জলমহলের অপরূপ দৃশ্য। প্রতি দিন সন্ধ্যায় সিটি প্যালেসের অভ্যন্তরে ‘লিগ্যাসি অফ অনার’ নামে আলো আর শব্দের এক বিশেষ শো অনুষ্ঠিত হয়। মেওয়ার রাজপরিবারের অনেক ইতিহাস ঐতিহ্যের স্মৃতি এই শোয়ে দেখানো হয়। শোনানো হয় অনেক কাহিনি। এই সিটি প্যালেস কমপ্লেক্সের মধ্যেই রয়েছে ‘পালকি খানা’ নামের এক বিখ্যাত রেস্তোরাঁ।

সিটি প্যালেস থেকে বেরিয়ে দেখে নিন পিছোলা লেকের কাছে গংগৌর ঘাটে ‘বাগোর কি হাভেলি’। এখান থেকে লেকের দৃশ্য অপরূপ সুন্দর লাগবে। পিছোলা লেকের মাঝে আছে ‘জগ মন্দির প্যালেস’, যা এখন এক বিলাসবহুল হোটেল।

সহেলিয়োঁ কি বাড়ি।

চলুন এ বার যাওয়া যাক ‘সহেলিয়োঁ কি বাড়ি’ – হাতি পোল থেকে ২ কিমি উত্তর দিকে ফতেহ সাগরের পুবে বাঁধের নীচে এক অভিনব বাগিচা। ২০ টাকার টিকিট কেটে ঢুকে পড়ুন এই বাগিচায়। ১৮ শতকে দিল্লির মুঘল শাসক ৪৮ জন সেবাদাসী-সহ এই সুন্দর বাগিচা উপহার দেন তৎকালীন মহারানাকে। এখানকার স্থাপত্য, ফোয়ারা এবং বাগানের দৃশ্য আপনাকে আকৃষ্ট করবেই।

এর পরে চলুন সামান্য দূরে। আপনার জন্যে অপেক্ষা করছে ‘ফতেহ সাগর’ তার টলমলে নীল জলরাশি নিয়ে। লেকে মধ্যে বোটিং-এর ব্যবস্থাও রয়েছে। ওখান থেকেই চলুন লেকের পাশে ‘মোতি মাগরি’ পাহাড়ে। এখানে তৈরি হয়েছে রানা প্রতাপের স্মারক। তাঁর প্রিয় ঘোড়া চেতকের পিঠে চড়া প্রতাপের ব্রোঞ্জ মূর্তি।  

ফতেহ সাগর।

এ ছাড়াও আপনারা ঘুরে আসতে পারেন মাত্র ৫ কিলোমিটার দূরে মনসুন প্যালেস তথা ‘সজ্জনগড় প্রাসাদ’। পাহাড়ের ওপরে অবস্থিত এই প্রাসাদ থেকে বর্ষার অপরূপ দৃশ্য দেখতে তখনকার রাজা মহারাজারা চলে আসতেন তাদের এই মনসুন প্রাসাদে। যদিও সময়ের অভাবে আমাদের এখানে আর যাওয়া হয়ে ওঠেনি। আমরা আমাদের উদয়পুর ভ্রমণ ফতেহ সাগরে শেষ করে চলে এসেছিলাম আমাদের রাত্রি-আবাস হোটেল কাজরীতে। আগামী পর্বে আমাদের ভ্রমণ থাকবে চিতোরের ডালি নিয়ে। (চলবে)

ছবি: লেখক

আরও পড়তে পারেন

রাজভূমি রাজস্থান ১/ মরুভূমির প্রবেশদ্বার জোধপুরে

রাজভূমি রাজস্থান ২/ সোনার কেল্লার জয়সলমিরে

রাজভূমি রাজস্থান ৩/ দিলওয়ারা মন্দির, নক্কি লেকের মাউন্ট আবুতে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *