ফের ডাকল দারিংবাড়ি ৪/ চিনলাম অন্য ভাবে

Nature's Paradise, Daringbadi

শ্রয়ণ সেন

বড়ো গ্রুপে এলে টাইম ম্যানেজমেন্টটা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে যায়। আর গ্রুপ সদস্যদের মধ্যে কেউ কেউ থাকেন, যাঁরা শত চেষ্টা করেও কোনো অসুবিধার কারণে সময় নেমে চলতে পারেন না।

এখানেও ঠিক সেটাই হল। তাই সাড়ে ন’টায় বেরোব বলে যখন বেরোতে বেরোতে সাড়ে ১০টা হয়ে যায়, তখন ভ্রমণ সংগঠকের মেজাজ কিছুটা গরম হবেই। আমিও ব্যতিক্রম নই।

সেই গরম মেজাজ নিয়েই রওনা হলাম মন্দাসুরুর দিকে। তবে এটাও ঠিক যে গত বার যে দারিংবাড়িকে মাত্র দেড় দিন সময় দিয়েছিলাম, এ বার সেই দারিংবাড়িকেই দিচ্ছি আড়াই দিন সময়। অর্থাৎ খুব আরামেই ঘোরার পরিকল্পনা। তাড়াহুড়োর কিছু নেই।

যা-ই হোক, চললাম মন্দাসুরু। ওড়িশা বন দফতরের ইকো ট্যুরিজম সেন্টার।

তবে এ বার রাস্তা অন্য। আগের বারের মতো আর ৫৯ জাতীয় সড়ক ধরে যাব না। এখন নতুন একটা রাস্তা হয়েছে। এ পথের সৌন্দর্য নাকি আরও সুন্দর।

পথের ধারে।

দারিংবাড়ি চৌমাথা পেরিয়ে ব্রহ্মপুরের দিকে কিছুটা গিয়ে বাঁ দিক দিক নিল পিন্টু। দূরে সরে গেল দারিংবাড়ি শহর। শুরু হল ঘাট-রাস্তা। সাময়িক সেই ঘাট রাস্তা শেষ হতেই একটা উপত্যকা। স্পিড তুলে এগিয়ে যাচ্ছে আমাদের ট্র্যাভেলার।

পলাশ এবং শিমূল গাছগুলোয় ধীরে ধীরে ফুল আসতে শুরু হয়ে গিয়েছে। বসন্ত প্রায় এসে গেছে যে। বোঝাই যায়, মার্চে এখানে পলাশের আগুন লাগবে। তখন কিন্তু দারিংবাড়ির এক অন্য সৌন্দর্য।

বেশ কিছুটা পথ চলার পর এল বাবাডাঙা। আমরা পথ বদল করে ‘দক্ষিণপন্থী।’ ‘প্রধানমন্ত্রী গ্রাম সড়ক যোজনা’য় তৈরি রাস্তাটা আসছে সিমানবাড়ি থেকে। অর্থাৎ সে বার যে পথে মন্দাসুরু এসেছিলাম, সেই পথকে অবশেষে পেলাম।

এই পথ যেন আদিবাসী মানুষের ঘর-গেরস্থালির উঠোন। এখানেই শুকোতে দেওয়া আছে পোশাকআশাক, এখানেই শুকোচ্ছে শস্য। পথের পাশেই বসেছে তাসের আসর, চলছে ক্যারাম খেলা।

গুমানিয়া পেরিয়ে একটু পথ যেতেই পৌঁছে যাই মন্দাসুরু ইকো ট্যুরিজম সেন্টারের গেটে, ঘণ্টা দেড়েকের মধ্যে। দারিংবাড়ি থেকে ৩২ কিমি।

মন্দাসুরুর গিরিখাত।

মেন গেট দিয়ে ভিতর ঢুকতেই ডান দিকে টিকিটঘর। সৃজিত বনের মাঝ দিয়ে কংক্রিটের বাঁধানো পায়ে চলা পথ ক্রমশ উঠে গিয়ে দু’ ভাগ হয়েছে। দু’টি পথ শেষ হয়েছে দু’টি নজরমিনারে। নজরমিনার দু’টির অবস্থান দু’টি টিলায়। পাহাড়-প্রকৃতির আসল ছবি তো ধরা দেবে এই নজরমিনার থেকে।

কন্ধমাল জেলার পাহাড়-জঙ্গলের রূপ যে ফ্যালনা নয়, তা প্রমাণ হয় এই মন্দাসুরুতে। এক বিপুল গিরিখাত, অভেদ্য জঙ্গল। সমুদ্রতল থেকে আমরা কতখানি ওপরে রয়েছি, সেটা এই মন্দাসুরুর নজরমিনারেই বোঝা যাচ্ছে।

এ বার নীচের নজরমিনারে এলাম। আর মনে হল আমরা যেন আরও কাছে এলাম বনপ্রকৃতির। সেই গিরিখাতটা যেন হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যায়।

ফিরে চললাম মন্দাসুরু থেকে। চলে এলাম সিমানবাড়ি। তার পর সঙ্গী জাতীয় সড়ক। বাঁ দিকে গেলেই দারিংবাড়ি। কিন্তু এখনই সেই পথে নয়। আমরা ঘুরলাম বালিগুডার দিকে।

কিলোমিটার ছয়েক গিয়ে সড়ক ছেড়ে ডানহাতি মোরাম রাস্তা ধরলাম। পাহাড়ের কোল ঘেঁসে। আধ কিলোমিটার যাওয়ার পর পৌঁছোলাম খুব সুন্দর একটা জায়গায়। তার নাম ‘নেচার্স প্যারাডাইস।’ বর্তমানে, ‘লাভার্স পয়েন্ট’ হিসবেও বেশ খ্যাতি হয়েছে তার।

বয়ে যায় ডুডুবাটা।

মিষ্টি নামের পাহাড়ি নদী, ডুডুবাটা। বড়ো বড়ো বোল্ডারের উপর দিয়ে নেচেকুঁদে চলেছে। গ্রুপ পুরো ছন্নছাড়া হয়ে গেল এখানে। যে যেমন ভাবে পারছে সৌন্দর্য উপভোগ করছে।

একটা বোল্ডারে বসে বেশ কিছুক্ষণ তার ক্রিয়াকলাপ অবলোকন করলাম। তার শীতল জলে পা ছোঁয়ালাম। ফোটোসেশন চলল বেশ খানিকক্ষণ। যে যেমন ভাবে পারছে ছবি তুলছে। আবার একপ্রস্ত শিশু হয়ে যাওয়ার পালা।

ফেরার পথে এমুদের সঙ্গে সাক্ষাৎপর্ব। তবে এমুদের বর্তমান অবস্থা হতাশ করল। সাত বছর আগেও এরা ছিল। বেশ রাজসিক হালেই তখন থাকত তারা।

কিন্তু এ বার দেখলাম অপুষ্টির ছোঁয়া ওদের মধ্যে। কেমন যেন রোগা হয়ে গিয়েছে। গাও বেশ নোংরা। সব মিলিয়ে ব্যাপারটা দেখে খুব একটা ভালো লাগল না।

ভোর এবং সকালের দিকে যতই কড়া শীত থাক, দুপুরের দিকে রোদটা ভীষণ আরামের। রিসর্টে ফিরে সেই রোদে বসেই দুপুরের খাওয়াদাওয়া সারলাম। আজকের মেনু ছিল ভাত-ডাল-মাছের কালিয়া। যথারীতি অসম্ভব সুন্দর খাওয়াদাওয়া।

দুপুরে খানিক বিশ্রাম নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। এ বারের উদ্দেশ্য একটাই, উদ্দেশ্যহীন ভাবে হেঁটে যাওয়া। দারিংবাড়িকে অন্য রকম ভাবে চিনব বলে বেরিয়ে পড়লাম। দলে এখন চার জন। বাকিরা সবাই কটেজে বিশ্রাম নিচ্ছেন।

উদ্দেশ্যহীন হাঁটাহাঁটি।

মেন রোড ধরে দারিংবাড়ির চৌমাথার দিকে এগোতে থাকলাম। এখানকার ভূপ্রকৃতি এমনই যে হাঁটতে কোনো কষ্ট নেই। কারণ রাস্তা তো প্রায় পুরোপুরিই সমতল। চৌমাথার কাছাকাছি পৌঁছে বাঁ দিকে লাল মোরামের পথ দেখতে পেয়ে ঢুকে পড়লাম। কোথায় যাচ্ছি জানি না, শুধু দেখছি সাধারণ গ্রাম্য জীবনযাপন।

হ্যাঁ, দারিংবাড়িতে শহুরে ছোঁয়া এসে লাগলেও ভেতরে ভেতরে সেই গ্রামটাই রয়ে গিয়েছে। আদিবাসী মানুষের সহজসরল জীবনযাপন। আমাদের চার জনকে দেখে অবাক চাহনি তাদের। এই পথে হয়তো এই প্রথম কোনো পর্যটকের পা পড়ল।

উন্নয়নমূলক কাজকর্মের প্রতিশ্রুতি দিয়ে তার পর তা পালন না করার উদাহরণও চোখে পড়ল। এই সব অঞ্চলের ছেলেমেয়েরা খেলাধুলোয় খুব দক্ষ। ভারতের পুরুষ হকি দলের প্রাক্তন অধিনায়ক দিলীপ তির্কেও এখানকার ছেলে। এখন তিনি রাজনৈতিক নেতা হয়েছেন, রাজ্যসভার সাংসদ।

এখানে হকি অ্যাকাডেমি তৈরি করার কথা বলেছিলেন তির্কে। তার জন্য জমিও দেখা হয়ে গিয়েছিল। বহু বছর আগে শিলান্যাসও করা হয়েছিল তির্কের নামে। কিন্তু সেই পাথর এখন ধুলোয় ভরতি। হকি অ্যাকাডেমির কাজ এতটুকুও যে এগোয়নি।

ওই রাঙা মাটির পথ।

যাই হোক, এগিয়ে চললাম। 

“আরে! এ তো চেনা রাস্তা!”

একটা পিচ রাস্তা দেখে চমকে গেলাম। খেয়ালই করিনি, কখন এই মেঠো পথ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে এসে গিয়েছি জাতীয় সড়ক ৫৯-এ। অর্থাৎ দারিংবাড়ি চৌমাথা থেকে যে রাস্তা বালিগুড়ার দিকে যাচ্ছে। আসলে এই উপত্যকাটা এমনই, যে দিক দিয়ে খুশি অন্য দিকে চলে যাওয়া যায় খুব সহজেই।

মেন রাস্তায় উঠে কিছুটা হাঁটতে হাঁটতে চলে এলাম হিল ভিউ পার্কের একদম কাছে। সূর্য তখন পড়ন্ত। পশ্চিমের পাহাড়টা বেশ উঁচু, তারই পিছনে লুকিয়ে গেল সূর্য। তাই এই হিল ভিউ পার্কের কাছাকাছি সন্ধ্যা হব হব হলেও দারিংবাড়ির অন্যত্র এখনও কিন্তু আলো রয়েছে। কোথাও কোথাও এক চিলতে রোদও। এক অদ্ভুত দৃশ্য।

ডান দিকে বিশাল মাঠে ফুটবল খেলায় মেতেছে ছেলেপুলেরা। পেছনে পাহাড়ের শ্রেণি। সূর্যের শেষ রশ্মিতে রাঙা হয়ে উঠেছে সেই পাহাড়।

না, দাবানল নয়। অস্তরবির আলো।

মূল সড়ক ছেড়ে হিল ভিউ পার্কের দিকে কিছুটা হাঁটলাম। তার পর নেমে গেলাম আরও এক লাল মোরামের রাস্তায়। এ পথ চেনা। গত কাল এটা দিয়েই আমাদের রিসর্ট থেকে হিল ভিউ পার্কে এসেছিলাম।

পশ্চিম আকাশে বাহারি রঙের মেলা। লাল, হলুদ, কমলা, গেরুয়া মিলিয়ে এক অসাধারণ পরিবেশ। অন্ধাকারাচ্ছন্ন পরিবেশ, ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক বাড়ছে ক্রমশ। তারই মধ্যে দিয়ে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি চারটি প্রাণী।

জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে পশ্চিম আকাশের সেই রঙকে দেখে মনে হচ্ছে জঙ্গলেই যেন আগুন লেগেছে। এই দৃশ্য চোখে দেখলে বিশ্বাস করা যায় না।

আচমকা ঘুরঘুট্টে অন্ধকার গ্রাস করল আমাদের। মোবাইলের টর্চ জ্বালিয়ে এগিয়ে গেলাম রিসর্টের দিকে। (চলবে)

ছবি: লেখক

আরও পড়তে পারেন

ফের ডাকল দারিংবাড়ি ১/ বদলে গিয়েছে কত!

ফের ডাকল দারিংবাড়ি ২/ তুষারপাতের ভ্রান্ত বিশ্বাস দূর করলাম

ফের ডাকল দারিংবাড়ি ৩/ দুলুরির তীরে মজলাম পিকনিকে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *