সঞ্জয় হাজরা
জয়সলমির থেকে বেশ ভোরেই বেরোলাম। তখনও আলো ফুটতে বেশ কিছুটা দেরি আছে। আমাদের আজকের গন্তব্য মাউন্ট আবু। জয়সলমির থেকে মাউন্ট আবু ৪৩০ কিলোমিটার। কিন্তু সেই রাস্তায় কাজ চলছে, জাতীয় সড়ক হচ্ছে। সময় লাগবে অনেক। তাই আমরা যাব কিছুটা ঘুরে, প্রায় জোধপুরকে ছুঁয়ে। পাড়ি দিতে হবে ৫৪৫ কিলোমিটার, সময় লাগবে প্রায় সাড়ে দশ ঘণ্টার মতো। তবুও আগের রাস্তার তুলনায় কম। তাই এই পথই বেছে নেওয়া হয়েছে। তা ছাড়া পালির কাছে বুলেটবাবাকে দর্শনও করা হয়ে যাবে।
বেলা ১২টা নাগাদ পৌঁছে গেলাম বুলেটবাবার মন্দিরে। না, এখানে কোনো দেবতা নেই, তার জায়গায় আছে একটি ৩৫০ সিসি-র রয়্যাল এনফিল্ড বুলেট (মোটর সাইকেল)। অবাক লাগছে তাই না? আর পিছনের ইতিহাসটা বলা যাক।
পালি শহর থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে ঠিক এই জায়গাতেই ১৯৮৮ সালের ২৩ ডিসেম্বরের শীতের রাতে বাড়ি ফেরার সময় ওম সিং রাঠোর নামে ২৩ বছরের তরতাজা এক যুবক তার এই সাধের বাইক নিয়ে একটি গাছের সঙ্গে ধাক্কা মেরে প্রাণ হারায়। দুর্ঘটনাগ্রস্ত এই বাইকটিকে তার পরে থানায় নিয়ে যাওয়া হলে সেটি আবার পর দিন থানা থেকে ওই একই জায়গায় চলে আসে। পরে সেটিকে থানায় এনে চেন দিয়ে বেঁধে রাখা হয় এবং জ্বালানি ট্যাঙ্কও খালি করে দেওয়া হয়। তার পরের দিন সকালে দেখা যায় সেই বাইক আবার সেই দুর্ঘটনার জায়গায় ফিরে এসেছে। একাধিক বার এই ঘটনা ঘটে।
পুলিশ কর্তৃপক্ষ বাইকটিকে তার পরিবারের হাতে তুলে দিলে পরিবার সেটিকে ৪০০ কিলোমিটার দূরে গুজরাতের এক ব্যক্তিকে বিক্রি করে দেয়। কিন্তু সেই বাইক আবার অলৌকিক ভাবে সেই জায়গায় চলে আসে। এর পরই গ্রামের মানুষেরা ওই গাছটির পাশে বাইকটিকে (RNJ 7773) রেখে সেখানে একটি মন্দির বানিয়ে দেয়। যা আজ ‘বাবা ওম বন্না মন্দির’ বা ‘বুলেট বাবা মন্দির’ নামে খ্যাত। রাজপুত যুবকদের সম্মান দেখাতে ‘বন্না’ বলা হয়ে থাকে।
প্রচলিত বিশ্বাস অনুযায়ী এখনও রাতে ওই জায়গায় সাক্ষাৎ দুর্ঘটনার হাত থেকে অনেক আরোহীকে উনি দুর্ঘটনার হাত থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছেন। ফলে পথচলতি মানুষ এবং গাড়ি ওখানে দাঁড়িয়ে একবার ওঁর উদ্দেশে উদ্দেশ্যে প্রণাম জানিয়ে আবার গন্তব্যের দিকে রওনা দেন। আমরাও তার ব্যতিক্রমী হলাম না। বুলেট বাবাকে প্রণাম জানিয়ে এগিয়ে চললাম মাউন্ট আবুর উদ্দেশে।

আবু রোড স্টেশন পেরিয়ে যেতেই শুরু হল ঘাটপথ। পথ ক্রমশ উঠে চলল পর্বত শিখরে। বিকেল ৪টে নাগাদ পৌঁছে গেলাম ৪ হাজার ফুট উচ্চতায় অবস্থিত উত্তর-পশ্চিম ভারতের একমাত্র শৈলশহর মাউন্ট আবুতে। এখানে আমাদের দু’ দিনের আবাস রাজস্থান পর্যটনের হোটেল শিখর।
প্রাচীনকাল থেকেই মাউন্ট আবু ‘অর্বুদাঞ্চল’ হিসাবে পরিচিত ছিল। শুরুতে এটি হিন্দুদের শাসনে থাকলেও পরে মুঘলদের হাতে যায়। আরও পরে মুঘলদের হাত থেকে নিয়ে ব্রিটিশরা এটিকে পর্যটনস্থল হিসাবে আরও উন্নত করে গড়ে তোলে এবং তার পর এটি তৎকালীন রাজপুতানা রাজ্যের গ্রীষ্মকালীন রাজধানী হিসাবে গড়ে ওঠে। উত্তর-পশ্চিম ভারতের মানুষজন গ্রীষ্মকালের প্রখর তাপ থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য ছুটে যান মাউন্ট আবুতে। পর্যটকদের কাছেও মাউন্ট আবু খুব জনপ্রিয়।
মাউন্ট আবুর প্রাকৃতিক দৃশ্য, মন্দিরসমূহ, উদ্ভিদ ও জীববৈচিত্র্য বরাবরই পর্যটকদের আকর্ষণ করে। এই অঞ্চলটিকে ১৯৬০ সালে বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য হিসাবে ঘোষণা করা হয়। এই ইকো-ট্যুরিজম ক্ষেত্রটি পরিবেশ-সচেতন পর্যটকদের কাছে খুবই জনপ্রিয় গন্তব্যস্থল হয়ে ওঠে। আরাবল্লি পর্বতমালায় পাথুরে উপত্যকা মাউন্ট আবু ২২ কিমি দীর্ঘ এবং ৯ কিমি বিস্তৃত। অভয়ারণ্যটির সংকীর্ণতার দরুণ জীবজন্তু দেখতে পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। এলাকাটি ভেষজ ঔষধি গাছপালা-সহ বিভিন্ন উদ্ভিদ ও প্রাণিকুলে সমৃদ্ধ। ভাগ্য ভালো থাকলে আপনি এখানে দেখতে পারেন ছোটো ভারতীয় খট্টাশ, নেকড়ে, হায়না, শৃগাল, ভারতীয় শিয়াল, শজারু, কাঁটাযু্ক্ত শজারু, ধূসর জংলি পাখি, বন্য শূকর, সম্বর হরিণ, লেঙ্গুর এবং আরও অনেক বন্যপ্রাণী।

পরের দিন আমরা বেরিয়ে পড়লাম মাউন্ট আবু দর্শনে। এখানকার মূল আকর্ষণ হল দিলওয়ারা মন্দির। একাদশ ও পঞ্চদশ শতকের মধ্যবর্তী সময়ে এই মন্দির নির্মিত হয়। শ্বেত মর্মরের এই জৈনমন্দির বিশ্বের সব চেয়ে সুন্দর সূক্ষ কারুকার্যময় মন্দির হিসাবে পরিচিতি। দিলওয়ারা মন্দির আসলে পাঁচ জন জৈন সন্ত বা তীর্থঙ্করের উদ্দেশে নিবেদিত। এঁরা হলেন আদিনাথ, নেমিনাথ, মহাবীর, ঋষভদেব ও পার্শ্বনাথ। পাঁচ তীর্থঙ্করের উদ্দেশে নিবেদিত পাঁচটি পৃথক মন্দিরের সমাহার দিলওয়ারা মন্দির। মন্দিরের ভিতরে তীর্থঙ্করদের মূর্তি রয়েছে। মন্দিরগুলির স্তম্ভ ও উপরের ছাদ-সহ ঝোলানো ঝাড়, সবই সূক্ষ্ম ভাবে শ্বেত মার্বেল পাথরের সুনিপুণ কাজের ঐতিহ্য বহন করে। পাঁচটি মন্দিরে পাঁচ সন্তের অবয়ব রয়েছে।
গুজরাতের প্রথম সোলাঙ্কি রাজা ভীমদেবের মন্ত্রী বিমল শাহ ১০৩১ খ্রিস্টাব্দে শ্রীআদিনাথ মন্দির বা বিমল বসাহি নির্মাণ করান। দিলওয়ারায় এটিই প্রাচীনতম মন্দির এবং এটি প্রথম তীর্থঙ্কর আদিনাথের উদ্দেশে নিবেদিত। শ্রীঋষভদেব মন্দিরটি পিত্তলহার/পিতলহারি মন্দির নামেও পরিচিত। কারণ এই মন্দিরের ভেতরের মূর্তিগুলির অধিকাংশই পিতল দিয়ে তৈরি। পাঁচটি ধাতুর সংমিশ্রণে তৈরি তীর্থঙ্কর ঋষভদেবের বিশাল মূর্তিটি এই মন্দিরে স্থাপন করা রয়েছে। সেই সময়ের শিল্পীদের হাতের কাজ দেখতে দেখতে আপনি যে অন্য জগতে হারিয়ে যাবেন সে কথা হলপ করে বলতে পারি। আর এখানে পাবেন এক এক অপার্থিব শান্তির অনুভূতি। অথচ মন্দিরটির বাইরে থেকে দেখলে দেখবেন শুধু কিছু টিলার মতো গম্বুজ। কারণ তখন শত্রুর আক্রমণের হাত থেকে মন্দির বাঁচাতে এই রকম নির্মাণকৌশল অবলম্বন করা হয়েছিল যাতে বাইরে থেকে দেখলে বোঝা না যায় যে ভিতরে কী অমূল্য স্থাপত্যশিল্পের নিদর্শন আছে।
জৈনদের জন্যে এই মন্দির সকাল ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত খোলা থাকলেও অন্যান্য ধর্মের দর্শনার্থীদের জন্যে বেলা ১২টা থেকে বিকাল ৪টে পর্যন্ত খোলা থাকে।

দিলওয়ারা মন্দির থেকে বেরিয়ে এসে এ বার চলুন যাওয়া যাক নক্কি লেকে। স্থানীয় কিংবদন্তি অনুযায়ী, নখ দিয়ে মাটি খনন করে এই লেক তৈরি করা হয়েছিল। তাই এই লেকের নাম নক্কি লেক। লেকটির বিন্যাস আপনাকে মুগ্ধ করবেই। সঙ্গে আছে লেকের জলে বোটিং-এর সুবিধা। তবে লেকের পাড়ে বসে নানাবিধ রকমারি আইসক্রিম খেতে যেন ভুলবেন না।
লেক ভ্রমণ শেষ করে চলুন সানসেট পয়েন্টে। নাম থেকেই বোঝা যায় যে, সানসেট পয়েন্ট হল এমন একটি জায়গা যা পর্যটকদের সূর্যাস্তের এক সম্মোহিত দৃশ্য উপলব্ধি করায়। এটি মাউন্ট আবুর সব চেয়ে জনপ্রিয় স্থান। প্রিয় মানুষের পাশে থেকে সূর্যাস্তের আবির-রাঙা রঙে নিজেদের রাঙিয়ে নিতে নিতে গোধূলির আলো ফিকে হওয়ার সাথেই উপলব্ধি করবেন টাইগার হিলে দাঁড়িয়ে মেঘেদের ভেসে আসার দৃশ্য।
এই সুখানুভুতি নিয়েই আজকের মতো বিদায় নিলাম। আগামী পর্বে থাকব উদয়পুরের গল্প নিয়ে। (চলবে)
ছবি: লেখক
আরও পড়তে পারেন
রাজভূমি রাজস্থান ১/ মরুভূমির প্রবেশদ্বার জোধপুরে