ফের ডাকল দারিংবাড়ি ৩/ দুলুরির তীরে মজলাম পিকনিকে

শ্রয়ণ সেন

প্রবল শীতের মধ্যেও লেপকম্বলের মায়া কাটাতে বেশি সময় লাগল না। ঘরের পরদা সরাতেই দেখলাম ঘন কুয়াশা আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রেখেছে দারিংবাড়িকে। 

হাঁটা লাগালাম সানরাইজ পয়েন্টের দিকে। না, কোনো ঘোষিত সানরাইজ পয়েন্ট এখানে নেই, কিন্তু দারিংবাড়ির ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্যের জন্য একাধিক জায়গা থেকেই অসাধারণ সানরাইজ দেখা যায়।

তেমনই একটা জায়াগার কথা পিন্টুজিই বলে দিয়েছিলেন কাল রাতে। রিসর্টের ঠিক সামনাসামানি যে রাস্তাটা একটু ওপরে উঠে যাচ্ছে, সেখান দিয়ে হাঁটলে ছোট্ট একটা হিলটপ পাওয়া যায়। ওই পাহাড়ের ওপর থেকেই নাকি দুর্দান্ত সূর্যোদয় দেখা যায়।

তবে আজ তো আবহাওয়ার কিছুটা মন খারাপ। সূর্যোদয় নির্ঘাত হয়ে গেছে। কুয়াশার চাদর ভেদ করে বেরিয়ে আসতে পারছে না সে। তবে সকালের হাঁটাটা বেশ ভালো হল। পিন্টুজির কথামতোই ওই পাহাড়ের চূড়ায় গেলাম।

কুয়াশার চাদর সরতেই রোদের দেখা মিলল। আচমকাই পরিষ্কার হতে শুরু করেছে আকাশ। দূরের পাহাড়গুলো বেরিয়ে পড়ছে ধীরে ধীরে। বুঝতেই পারছি আশেপাশের সব এলাকার মধ্যে সব থেকে উঁচু জায়গায় রয়েছি আমরা।

হিল ভিউ পার্ক থেকে।

একটু দূরেই পাহাড়ের কোলে বেশ কয়েকটা সুসজ্জিত কটেজ নজরে এল। ওগুলো ওড়িশা সরকারের ইকো-ট্যুরিজম বিভাগের নেচার ক্যাম্পের কটেজ। ভালো জায়গাতেই কটেজগুলো।

ও বলতে ভুলেই গেছি। এই দারিংবাড়িতে ছিল ওড়িশা সরকারের পর্যটনের পান্থশালা। ২০০৩ সালের ২৪ জানুয়ারি এই পান্থশালার উদ্বোধন করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী নবীন পট্টনায়েক।

শেষ পর্যন্ত দু’ বছর চলে তা বন্ধ হয়ে যায়। অজুহাত, মাওবাদী কার্যকলাপ। সে বারও অবশ্য ‘মাওবাদী অজুহাত’-এর কোনো প্রমাণ পাইনি। আর এখন তো দারিংবাড়ি আরও উন্নত। অসংখ্য হোটেল, রিসর্ট। তবুও সেই পান্থশালাকে পুনরায় চালু করার কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। যদিও সরকারের অন্য দফতর রমরম করে চালু করে দিয়েছে নেচার ক্যাম্প।

যা-ই হোক, প্রাতরাশের আয়োজনটা প্রকাশ সাহুবাবু বেশ ভালোই করেছিলেন। তার ঢেকুর তুলতে তুলতেই বেজে গেল সাড়ে ৯টা। পিন্টুজির ব্যবস্থাপনায় আজ আমরা পিকনিক করব দারিংবাড়ির বিখ্যাত পাইন ফরেস্টে। তবে তার আগে অল্প কিছু ঘোরাঘুরিও আছে।

নেচার পার্কে।

খুব আরামে দারিংবাড়িকে চিনব বলেই তিন রাতের সফরে এসেছি এখানে। নইলে দু’ রাত থাকলেও সব দর্শনীয় স্থান ভালো করে দেখে নেওয়া যায়।

আজ আমাদের প্রথম গন্তব্য হিল ভিউ পার্ক। রিসর্ট থেকে বেরিয়ে লাল মোরামের আঁকাবাঁকা পথ অতিক্রম করতে থাকে আমাদের ট্র্যাভেলার। সে বার এই পার্কে আমরা এসেছিলাম হেঁটে, আর পড়ন্ত বিকেলে। এ বার অবশ্য যাচ্ছি একদম সকালে।

১০ টাকা দক্ষিণা দিয়ে পার্কে প্রবেশ। পাহাড়ের মাথায় সুন্দর করে সাজানো পার্ক। নানা রকম মরশুমি ফুলগাছের বাহার। দম ছাড়ার জন্য অঢেল বসার জায়গা। রয়েছে একটি নজরমিনারও। হিল ভিউ পার্ক থেকে আরও মজে গেলাম দারিংবাড়ির প্রেমে।

কাছে দূরে পাহাড়ের শ্রেণি। নজরমিনারের এক দিকে তাকালে দূরে একটা বিশাল মাঠ, অন্য দিকে তাকালে ঠিক গায়েই একটা বিশাল পাহাড় আর তার সঙ্গে লেপ্টে থাকা পাইনের জঙ্গল। সব মিলিয়ে একটা অসাধারণ জায়গা।

কফিবাগানে হাঁটাহাঁটি।

এর পাশাপাশি রয়েছে শিশুদের বিনোদনের নানা রকম পসরা। যা দেখে বড়োরাও রীতিমতো শিশু হয়ে যায়।

হিল ভিউ পার্কের ঠিক উলটো দিকে নেচার পার্ক। নতুন তৈরি হয়েছে। আগের বার দেখিনি। এখানে প্রবেশ দক্ষিণা ১৫ টাকা। জঙ্গলের মধ্যে সুন্দর করে সাজিয়ে তোলা হয়েছে এই পার্ককে। এখানকার কোটিয়া সম্প্রদায়ের মানুষদের জীবনযাপনের গল্প ফুটিয়ে তোলা হয়েছে নানা রকম ভাবে।

ভেষজ ওষধির এক সুন্দর বাগান, আর বাগানের কেন্দ্রে আযুর্বেদাচার্য চরকের সুদর্শন মূর্তি। দারিংবাড়ির আশেপাশে প্রচুর ভেষজ উদ্ভিদ পাওয়া যায়। সেই সব ঔষধি গাছেরও গুণাবলি দেখানো হয়েছে এই পার্কে। ঘণ্টাখানেক সময় কাটানোর পক্ষে এই পার্কটা বেশ আদর্শ।

দারিংবাড়ি আর বাংলার বহরমপুরের মধ্যে মিল কোথায়? এই প্রশ্ন কাউকে করা হলে সে নির্ঘাত ভিরমি খাবে। কিন্তু মিল একটা আছে। সেটা হল ‘ছানাপোড়া।’

দারিংবাড়িরও বিখ্যাত মিষ্টি এই ছানাপোড়া। কফি বাগান ঘোরার পর কিছুটা জিরিয়ে নেওয়ার জন্য একটা চায়ের দোকানে বসতেই চোখ পড়ল এই ছানাপোড়া। লোভ সামলানো গেল না। কিছুক্ষণের মধ্যেই সবার হাতে ছানাপোড়া। আহ! কী অপূর্ব স্বাদ তার। 

কফিগাছ।

দারিংবাড়ির এই মশলা ও কফির বাগানটি বেশ সুন্দর। সুদীর্ঘ পাইন গাছ বেয়ে ওঠে থোকা থোকা কালো মরিচের ভারে নুয়ে পড়া লতা — মাটিতে ঘন সবুজ কফিগাছের মেলা। সুন্দর একটা পরিবেশ। কফিবাগানের মধ্যে দিয়ে হাঁটতে দারুণ লাগছিল।

ছানাপোড়ার স্বাদ নিতে নিতে প্রায় ভুলতেই বসেছিলাম যে পাইন জঙ্গলে পিকনিকের পসরা সাজিয়ে বসে রয়েছেন পিন্টুজি। কিছুক্ষণ আগে ফোন করে জানিয়েও দিয়েছেন যে রান্না শুরু হয়ে গিয়েছে। আজ মেনুতে পাঁঠার মাংস।

কফিবাগান থেকে কিছুটা এগোতেই, বাঁ দিকে এই পাইনের জঙ্গল। জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে গেল আমাদের বাস। পৌঁছে গেলাম নানা আকারের পাথরের উপর দিয়ে নেচেকুঁদে ভেসে চলা দুলুরি নদীর ধারে।

এখানেই কিছুক্ষণ পর জমবে আমাদের পিকনিকের আসর। সাহুবাবু জানালেন, মোটামুটি সব রান্নাই রেডি। শুধু চাটনিটা এখনও বাকি। হাতে কিছুটা সময় যখন আছে, তার সদ্ব্যবহার করা গেল। প্রথমে গেলাম দুলুরির কোলে। 

পাইনের বনে বনভোজন।

তবে এই নদীর কোলে পৌঁছোতে গিয়ে চূড়ান্ত সাবধানতা অবলম্বন করতে হয়। কারণ নানা রকম পাথরের ওপর দিয়ে যেতে গিয়ে পা হড়কে যাওয়ার আশংকা যথেষ্টই।

দারিংবাড়ি এলে পাইন জঙ্গলে ভ্রামণিকরা আসেন। কিন্তু আমরা যেটা করলাম, সেটা আজ পর্যন্ত কেউ করেছেন কি না জানি না। সারথি পিন্টু এবং রিসর্ট মালিক পিন্টুজির দেখানো পথ অনুসরণ করে একটা পাহাড়ের চূড়ায় ট্রেক করে উঠে গেলাম। জঙ্গুলে পথ ভেদ করে দুই পিন্টুই আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে এলেন এই ওপরটায়। অসাধারণ একটা অনুভূতি। দারিংবাড়ির পুরো উপত্যকাটাকেই এখান থেকে মনোরম লাগছে। পাহাড় দিয়ে চারিদিক ঘিরে রাখা হয়েছে।

বেশ সময় কাটাচ্ছিলাম এই পাহাড়চূড়ায়। কিন্তু নীচে থেকে সাহুজির ডাকে ফেরার তোড়জোড় শুরু করতে হল। রান্না রেডি। এ বার খাওয়াদাওয়ার পালা।

শালপাতার থালা, শালপাতার বাটিতে, পাইনগাছের সারির ঠিক নীচেই জমে উঠল আমাদের পিকনিক। অনেক দিন পর পাঁঠার মাংস খেয়ে খুব তৃপ্তি পেলাম। সেই সঙ্গে ভাত, ডাল, বেগুনভাজা, চাটনি, পাঁপড় – অসাধারণ মেনু।  

দারিংবাড়ির উচ্চতা সমুদ্রতল থেকে হাজার তিনেক ফুট। এত্তো কম উচ্চতায় কী ভাবে পাইন গাছের এই ঘন জঙ্গল তৈরি হয়, সেটাই ভীষণ ভাবিয়ে তোলে। জোরালো হাওয়া যখন আসে, তখন সমবেত গলায় গান ধরে এই পাইনগাছগুলো। সেই গানগুলো শুনতে দারুণ লাগছে।

খাওয়াদাওয়ার পাট মিটিয়ে মাটিতে সতরঞ্জি পেতে ঘণ্টাখানেকের বিশ্রাম। তার পর ফের পথ চলা শুরু। গ্রিনবাড়িতে আমাদের রিসর্টের পাশ দিয়ে আরও এগিয়ে গেলাম কিলোমিটার দুয়েক। পৌঁছে গেলাম ‘সায়লেন্ট ভ্যালি’তে।

এই হল দারিংবাড়ির সানসেট পয়েন্ট, ‘সায়লেন্ট ভ্যালি’। সাত বছর আগে এখানেই ছিল মোরামের রাস্তা। এখন পাকা পিচের। তবে ‘সায়লেন্ট’ ব্যাপারটা এখন আর নেই।

সূর্য গেল অস্তাচলে।

সে বার সূর্যাস্তের সময় আমরা তিনটে প্রাণী আর সারথি দিব্য ছাড়া আর কেউ ছিল না। এক অদ্ভুত নীরবতা বিরাজ করছিল। কিন্তু এ বার আমরা পৌঁছোনোর পর পরেই ক্রমশ ভিড় বাড়তে শুরু করল, পর্যটকদের ভিড়।

তবে পরিবেশটা অসম্ভব সুন্দর। রাস্তাটা ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে ক্রমাগত নেমে গিয়েছে নীচে। আমরা অনেকটা ওপর থেকে সামনের উপত্যকায় রাস্তার বিলীন হয়ে যাওয়া প্রত্যক্ষ করছি।

সূর্য পাহাড়ের আড়ালে ডুব দেওয়ার জন্য প্রস্তুত। পশ্চিম আকাশে চলছে নানা রঙের কেরামতি। ক্রমশ কমে আসছে দিনের আলো। তার পর এক সময়ে ডুব। ঝুপ করে সন্ধে নামতেই ঠান্ডাটা যেন চেপে বসল।

এক কুয়াশামাখা ভোর দিয়ে দিন শুরু করেছিলাম। পরিষ্কার আকাশে মনোরম সূর্যাস্ত দিয়ে দিন শেষ করলাম। (চলবে)

ছবি: লেখক

আরও পড়তে পারেন

ফের ডাকল দারিংবাড়ি ১/ বদলে গিয়েছে কত!

ফের ডাকল দারিংবাড়ি ২/ তুষারপাতের ভ্রান্ত বিশ্বাস দূর করলাম

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *