ফের ডাকল দারিংবাড়ি ১/ বদলে গিয়েছে কত!

Daringbadi

শ্রয়ণ সেন

‘দার্জলিং অটো স্ট্যান্ড!’

দারিংবাড়ি চৌমাথায় পৌঁছোতেই মনে পড়ে গেল সাত বছর আগের কথা। চৌমাথার এক কোণে একটি অটো স্ট্যান্ড, তার নামই ‘দার্জলিং।’

এ তো একই আধারে দার্জিলিং আর কাশ্মীর। অটো স্ট্যান্ডের সাইনবোর্ডে লেখা দার্জলিং আর লোকের মুখে আদরের ডাকনাম কাশ্মীর –- ওড়িশার কাশ্মীর।

কিন্তু সেই বোর্ডটা কি এখনও আছে? আমাদের ট্র্যাভেলারটা এত দ্রুত চৌমাথা পেরিয়ে গেল যে তার ভেতর থেকে সাইনবোর্ডটা নজরে পড়ল না।

চৌমাথা পেরিয়ে সোজা চলেছি। বাঁ দিকে দারিংবাড়ি থানা। নজর পড়ল থানার সাইনবোর্ডের দিকে। বোর্ডটির নীচে লেখা, ‘দারিংবাড়ি হোটেল অ্যাসোসিয়েশন।’ বেশ চমকপ্রদ লাগল ব্যাপারটা। তখন মাত্র দু’টো হোটেল থাকা দারিংবাড়িতে এখন অনেক হোটেল ও রিসর্ট। ফলে হোটেল অ্যাসোসিয়েশনও তৈরি হয়ে গিয়েছে।

সাত বছর আগের দারিংবাড়ির সঙ্গে এ বারের দারিংবাড়িটার অনেক অমিল। সে বারের ছোট্ট জনপদ দারিংবাড়ি এখন বেশ বড়ো শহর। জাতীয় সড়ক ৫৯ বিশাল চার লেনের হয়েছে। সেই সড়ক ধরেই দারিংবাড়ি আরও দু’কিলোমিটার এগিয়ে এসেছে।

সে বার দারিংবাড়িতে এসেছিলাম নিখোদ ভ্রামণিক হিসেবে। এ বার এই ‘ভ্রামণিক’-এর পাশাপাশি ‘ট্যুর অপারেটর’ বা ভ্রমণ সংগঠকের তকমাটাও জুটেছে। আমার সঙ্গে আরও ১২ জন। বাকি সবারই দারিংবাড়িতে প্রথম বার, শুধুমাত্র আমারই দ্বিতীয় বার।

তবে শহর বড়ো হলেও তার ভৌগোলিক তথা চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের তো কোনো পরিবর্তন হয়নি। আর সেটাই এখানকার আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। এই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের কারণেই দারিংবাড়ি ‘ওড়িশার কাশ্মীর’ হিসেবে খ্যাত।

ট্রেন থেকে চিলকা।

অন্তত দেড় ঘণ্টা দেরি হল দারিংবাড়ি পৌঁছোতে। মূল কারণ অবশ্যই ট্রেন। সকাল ন’টার বদলে মাদ্রাজ মেল ব্রহ্মপুর পৌঁছোলো সকাল সাড়ে দশটায়। তবে এই ট্রেনসফরটাও এক কথায় অসাধারণ ছিল। ট্রেন থেকেই যে ভাবে চিলকার দর্শন পেলাম, তাতে মন রীতিমতো ভালো হয়ে যায়।

ব্রহ্মপুর স্টেশনেই ট্র্যাভেলার নিয়ে দাঁড়িয়েছিল পিন্টু। আমাদের আগামী কয়েক দিনের সারথি। আমার অন্যতম ‘হেল্পিং হ্যান্ড।’

প্রাতরাশ করে শহর ছাড়াতেই সঙ্গী হল ৫৯ নম্বর জাতীয় সড়ক। কিছুটা যেতেই উঁকি দিতে শুরু করল পাহাড়। পাহাড় কিন্তু আমাদের যাত্রাসঙ্গী, সব সময়েই রয়েছে সে। তবে আপাতত কিছুটা যেন খাপছাড়া। খালি পালিয়ে বেড়ানোর ধান্দা।

দারিংবাড়ির পথে।

আবহাওয়ায় বসন্তের ছোঁয়া। শীত তো নেই, বরং একটু যেন গরম গরম। তবে দারিংবাড়িতে সন্ধ্যার পর যে জম্পেশ ঠান্ডা পড়ছে, সেটা আমাদের রাতের আস্তানার মালিকই আগাম জানিয়ে দিয়েছেন।

প্রায় দু’ ঘণ্টায় ৭৩ কিলোমিটার পথ পাড়ি দেওয়ার পর এসে পৌঁছোলাম সুরাদায়। সাত বছর আগে প্রথম বার দেখা হয়েছিল সুরাদার সঙ্গে। কিন্তু এ বার তার সঙ্গে প্রথম পরিচয় হল। যে পাহাড়গুলো এতক্ষণ ধরে পালিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছিল, সেগুলোই এ বার ধরা দিতে লাগল আমাদের কাছে।

মূল রাস্তা ছেড়ে একটি পাহাড়ের ওপরে বেশ কয়েকটা হেয়ারপিন বেন্ড পেরিয়ে উঠে এলাম একদম টংয়ে। এখানে রয়েছে একটা নজরমিনার। সেই নজরমিনারে উঠলে সুরাদার সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়।

সুরাডার সৌন্দর্য।

ঋষিকুল্যা তথা রুষিকুল্যা নদীর ওপরে জলাধারের জন্য বিখ্যাত এই সুরাদা। সেই জলাধারকে ঘিরেই নতুন টুরিস্ট স্পট গড়ে তুলেছে ওড়িশা সরকার। বাহন থেকে নেমে হেঁটে গেলাম নজরমিনারের দিকে। চারতলা নজরমিনারের একদম শেষ তলে উঠে চারিদিকের দৃশ্যে পুরোপুরি মোহিত হয়ে গেলাম।

রুষিকুল্যার ওপরে বাঁধ দেওয়া হয়েছে। তৈরি হয়েছে এক বিশাল হ্রদ। তাকে চারদিক দিয়ে ঘিরে রয়েছে পাহাড়। মনে পড়ে যায় এই রুষিকুল্যার সঙ্গে প্রথম আলাপের সময়টা। 

তার সঙ্গে আলাপ তারাতারিণীতে এবং প্রথম দর্শনেই ভালোবাসা। ব্রহ্মপুর থেকে ৩২ কিলোমিটার উত্তরে তারাতারিণী, কুমারী পাহাড়ের শীর্ষে তারাতারিণী মন্দির। আর পাহাড় বেড় দিয়ে বয়ে গেছে রুষিকুল্যা সাগরের কাছে ধরা দিতে। গোটা পরিবেশটাই ছিল রুষিকুল্যার প্রেমে পড়ার মতো। সেই রুষিকল্যাকে আবার দেখতে পেয়ে ফিরে গেলাম তারাতারিণীর সেই দিনগুলোয়।

বয়ে চলেছে রুষিকুল্যা।

নজরমিনার ছাড়াও এখানে একটি পার্ক গড়ে তোলা হচ্ছে। রয়েছে একটি মন্দিরও। সব মিলিয়ে এটা বোঝাই যাচ্ছে যে বছর খানেকের মধ্যে ওড়িশার একটা জনপ্রিয় পর্যটনকেন্দ্র হয়ে উঠবে সুরাদা।

সময় বয়ে যাচ্ছে। ঘড়ি জানান দিচ্ছে পৌনে দু’টো। এখান থেকে দারিংবাড়ি অন্তত দেড় ঘণ্টা। আজকের গোটা পথের সব থেকে রোমাঞ্চকর অংশটা এ বার শুরু হবে। দেরি না করে তাই ফের পথ চলা শুরু।

সুরাদা ছাড়তেই যেন ক্রমশ ঘিরে ধরতে শুরু করল পাহাড়। যেন বলছে, এ বার তাকে আর এড়িয়ে যাওয়া যাবে না। ওপর দিয়েই যেতে হবে। গজলবাড়ি থেকেই সেই পাহাড়ে ওঠা শুরু। রাস্তা ক্রমশ ঊর্ধ্বমুখী। 

পাহাড়গুলোর গায়ে লেপটে রয়েছে অসংখ্য গাছগাছালি। সে সব গাছের গায়ে ধরেছে নানা রং। লাল-সবুজেরই কত রূপ। বসন্ত যে আসছে!  

একটার পর একটা হেয়ারপিন বেন্ড অতিক্রম করে খালি উঠে চলা। পাহাড়ের গায়ে গাছগুলো চাঁদোয়ার মতো তাদের ডালপালা ছড়িয়ে দিয়েছে। তাই প্রায় পুরো পথটাই ছায়াচ্ছন্ন।

মনে পড়ে গেল, সাত বছর আগে এই পথেই দাবানলের মধ্যে পড়েছিলাম। মধ্য-মার্চের গরমের জেরে আগুন ধরে গিয়েছিল শুকিয়ে যাওয়া গাছগাছালিতে। রাস্তার দু’ ধারেই জঙ্গল দাউ দাউ করে জ্বলছে। আর সেই আগুনকে ভেদ করেই এগিয়ে যাচ্ছিল আমাদের গাড়ি। মাঝেমধ্যে ভয় করছিল, প্রচণ্ড ভয়।

আজ অবশ্য কোনো ভয় নেই। গাছগাছালির শুকিয়ে যাওয়ার সময় এখনও হয়নি। বরং আকাশের পরিস্থিতি জানান দিচ্ছে, কিছুক্ষণের মধ্যেই বৃষ্টি নামতে পারে।

এই ঘাটপথ পৌঁছে দিল দারিংবাড়ি।

ক্রমশ উঠতে উঠতে একটা সময় শেষ হল ঘাটপথ। পাহাড়শীর্ষে চলে এসেছি। এ প্রায় সমতলক্ষেত্র। যে পাহাড়গুলো বন্দি করেছিল আমাদের, তারা আমাদের মুক্তি দিয়ে দূরে দূরে চলে গেল। আবহাওয়াও বেশ কিছুটা বদলে গিয়েছে। শীত শীত লাগছে।

প্রথম চমক পেলাম এখানেই। সমতল পথ দিয়ে সামান্য কিছুটা এগোতেই দারিংবাড়ি শুরু হয়ে গেল। ইতিউতি দোকান, বাজার, রাস্তায় মানুষজন। পরিষ্কার মনে আছে, সে বার এই সব জায়গা ছিল জনমানবশূন্য। এখান থেকে আরও অন্তত ২-৩ কিলোমিটার গেলে তবেই দারিংবাড়ি জনপদটা পাওয়া যেত।

মূল সড়কের ধারেই তৈরি হয়েছে একটার পর একটা হোটেল। দেখা মিলল একটা শপিং মলেরও। ধীরে ধীরে শহুরে জীবনযাত্রার সঙ্গে তা হলে মানিয়ে নিচ্ছেন দারিংবাড়ির মানুষজন।

জাতীয় সড়ক ৫৯ আমাদের চৌমাথায় পৌঁছে দিয়ে উধাও হয়ে গেল বালিগুডার পথে। আমরা এগিয়ে গেলাম গ্রিনবাড়ির দিকে। গ্রিনবাড়ি ছাড়াতেই লাইনপাড়া। সেখানেই রয়েছে আমাদের তিন রাতের আস্তানা।

একটি সুন্দর পুকুর, পেছনে ইউক্যালিপটাসের জঙ্গল, চারিদিকে ইতিউতি উঁচু পাহাড়। সব মিলিয়ে অসাধারণ একটা জায়গায় আমাদের আস্তানাটি। মেঘলা আকাশ আর ঝোড়ো হাওয়াকে সঙ্গে নিয়ে ঢুকে গেলাম রিসর্টের চৌহদ্দিতে।

শীতের মরশুমটা এ বার বৃষ্টি বৃষ্টিতেই কাটছে। সেই বৃষ্টি পিছু ছাড়ল না দারিংবাড়িতেও। রিসর্টে চেক ইন করতেই সে নামল তেড়ে!

মনে পড়ে গেল বৃষ্টির কথা। মিষ্টি একটা মেয়ে। আমাদের দলের শরিক হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু শেষ মুহূর্তে বিশেষ কাজ পড়ে যাওয়ায় আসতে পারল না। ভীষণ মন খারাপ তার। এই বৃষ্টি কি সেই বৃষ্টিরই চোখের জল? (চলবে)

ছবি: প্রতিবেদক

আরও পড়তে পারেন

গোয়া গেলে যে জায়গাগুলো আপনি অবশ্যই দেখবেন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *