রাজভূমি রাজস্থান ১/ মরুভূমির প্রবেশদ্বার জোধপুরে

সঞ্জয় হাজরা

অন্ধকার তখনও কাটেনি। পশ্চিমের সূর্য উঠতে বেশ দেরি করে। ঘড়ির কাঁটায় সকাল প্রায় ছ’টা। পৌঁছে গেলাম জোধপুরে। ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ভারতের এক ঐতিহাসিক রাজ্য রাজস্থানের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর তথা থর মরুভূমির প্রবেশদ্বার জোধপুর। শেষ হল প্রায় ৩০ ঘণ্টার ট্রেনসফর।

কলকাতা থেকে সড়কপথে ১৯৫০ কিলোমিটার এবং জয়পুর থেকে ৩৫০ কিলোমিটার  দূরের জোধপুরে থাকার অনেক জায়গা। স্টেশনের কাছাকাছি ছোটো-বড়ো-মাঝারি মানের প্রচুর হোটেল-রিসর্ট রয়েছে। তবে আমরা ঠাঁই নিলাম রাজস্থান পর্যটন দফতর তথা আরটিডিসি-র হোটেল ঘুমর-এ। আগাম সংরক্ষণ করা ছিল এখানে।   

কিছুটা গুছিয়ে নিয়েই নির্ধারিত গাড়িতে চড়ে বেরিয়ে পড়লাম জোধপুর শহর ঘুরতে। আমাদের প্রথম গন্তব্য মেহরনগড় দুর্গ। আসুন দুর্গে যাওয়ার পথে এক ঝলক ঝালিয়ে নিই জোধপুর শহরের ইতিহাস। এই শহরের পত্তন হয়েছিল ১৪৫৯ সালে। রাজপুত রাঠোরদের রাজধানী ছিল পার্শ্ববর্তী মান্ডোর শহর। সেই মান্ডোর থেকে রাজ্যপাট তুলে রাঠোর বংশের রাজা রাও জোধা নতুন শহর প্রতিষ্ঠা করেন। আর তাঁর নামানুসারেই শহরের নাম হয় জোধপুর। পরবর্তী সময়ে এটি মাড়োয়ার রাজ্যের রাজধানী হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল।

মেহরনগড় দুর্গ।

সমভূমি, বালিভূমি ও খাড়া পাহাড়ের সহাবস্থানে গঠিত এই জোধপুর শহর বিখ্যাত তার সমৃদ্ধ ইতিহাসের জন্য। এই শহর ‘ব্লু সিটি’ এবং ‘সান সিটি’ হিসাবে পরিচিত সকলের কাছে। এক সময় বর্ণভেদ প্রথার কারণে মেহরনগড় দুর্গের চারপাশের বাড়িগুলিকে নীল রঙ করা হয়েছিল। সেখান থেকেই কালক্রমে এই শহর ‘ব্লু সিটি’ বা ‘নীল শহর’ নামে পরিচিতি পেল। নীল রঙের ঘরবাড়ির জন্যই ‘ব্লু সিটি’ নামের উৎপত্তি।

জোধপুর শহরের বিশেষত্ব তার গোলকধাঁধার মতো গলিপথ আর ভাস্কর্যমণ্ডিত বাড়িঘর-মন্দির। মনে মনে শহরের ইতিহাস ঝালাতে ঝালাতে চলে এলাম ৪ কিলোমিটার দূরের মেহরনগড় দুর্গে। ৪১০ ফুট উচ্চতার গোদাগিরি টিলায় অবস্থিত মেহরনগড় দুর্গ জোধপুর শহরের সব চেয়ে আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র। জোধপুর শহরের ঠিক মাঝখানে অবস্থিত এই প্রাচীন দুর্গটি রাও জোধা ১৪৫৯-এই নির্মাণ করিয়েছিলেন। এটি বর্তমানে ভারতের অন্যতম প্রাচীন বৃহত্তম দুর্গ হিসেবে পরিচিত।

শোনা যায়, নীল শহরের মানুষদের রক্ষা করার জন্য রাও জোধা প্রায় ৫ কিলোমিটার দীর্ঘ পাঁচিল দিয়ে ঘিরে ভূমি থেকে ৪১০ ফুট উঁচু খাড়াই পাহাড়ের ওপরে অত্যন্ত সুরক্ষিত ভাবে এই দুর্গটি নির্মাণ করিয়েছিলেন। বলা হয়, চিনের প্রাচীরের পরেই এই দুর্গের প্রাচীরটি বিশ্বে দ্বিতীয় দীর্ঘতম প্রাচীর হিসেবে পরিচিত। এই দুর্গের দিকে তাকালেই বোঝা যায় মুঘলরা তাদের দীর্ঘ শাসনে, এমনকি ইংরেজরাও কেন রাজপুতদের তৈরি এই দুর্গ বশে আনতে পারেনি।

উমেদ ভবন প্যালেস।

দূর্গে প্রবেশের মোট ৭টি গেট বা পোল রয়েছে। যথা, জয় পোল, ফতেহ পোল, গোপাল পোল, দোধ কাংরা পোল, আমরুতি পোল, লোহা পোল এবং সুরজ পোল। এর মধ্যে জয় পোল তৈরি করেছিলেন জয়পুরের মহারাজা মান সিং ১৮০৬ সালে, জোধপুরের বিরুদ্ধে জয়পুর ও বিকানেরের সম্মিলিত বাহিনীর যুদ্ধজয়ের স্মারক হিসাবে। আর ফতেহ পোল তৈরি করেন অজিত সিং ১৭০৭ সালে, মুঘলদের যুদ্ধে হারানোর পর। তবে এখন দূর্গে প্রবেশের জন্য কেবল একটি গেটই ব্যবহার করা হয়। বর্তমানে এখানে প্রবেশের জন্যে জনপ্রতি ২০০ টাকা (স্টিল ক্যামেরা-সহ) দর্শনী দিয়ে টিকিট সংগ্রহ করতে হয়।

মেহরনগড় দুর্গটি ১২ তলা উঁচু। টানা ৭-৮ তলা পর্যন্ত লিফটের সাহায্যে উঠে যেতে হয়। নীচের ৭-৮ তলায় মূলত সৈন্যদের থাকার কামরা, অস্ত্রাগার, খাবার, জলের মজুদঘর ইত্যাদি আছে। এই ৭-৮ তলা দর্শনার্থীদের জন্য খোলা নয়। ৮ তলার পর থেকে বাকি ৪ তলা সবার জন্য খোলা থাকে। এটাই রাজাদের থাকার জায়গা। এখানে আছে মতিমহল, ফুলমহল, শিসমহল, সালিসখানা, দৌলতখানা বা আর্ট গ্যালারি। প্রাচীন জোধপুরের লোকদের বলা হতো মাড়ওয়ার। তাদের ব্যবহৃত অস্ত্র, তলোয়ার, শিলড, বন্দুক, আসবাবপত্র, বাদ্যযন্ত্র, তৈলচিত্র, রানিদের পালকি, হাতিতে বসার জন্য কাঠের জায়গা ইত্যাদি সব সংরক্ষিত আছে বিশাল মিউজিয়ামে। এই মিউজিয়ামটিকে রাজস্থানের সব চেয়ে বড়ো সংগ্রহশালা বলা হয়ে থাকে।

ফোর্টের উপর থেকে নীচে দেখা যায় ব্লু সিটির অপরূপ দৃশ্য। ভালো করে এই দুর্গটি দেখতে প্রায় ৩ থেকে ৪ ঘণ্টা সময় লাগে। দুর্গের নীচে ১৮৯৯ সালে তৈরি হয় দ্বিতীয় যশোবন্ত সিংয়ের শ্বেতপাথরের স্মারকসৌধ যা যশোবন্ত থাডা নামেই পরিচিত। এটি আসলে রাজাদের সমাধিক্ষেত্র।

বৈভবের প্রদর্শনী। উমেদ ভবন প্রাসাদে গাড়ির সম্ভার।

আমাদের পরবর্তী গন্তব্য ছিল জোধপুরের আরও এক আকর্ষণ, উমেদ ভবন প্যালেস। শহরের এক প্রান্তে ছাত্তার হিলে ইতালীয় শৈলিতে তৈরি এই প্রাসাদ বিশ্বের সব চেয়ে বড়ো আধুনিক রাজপ্রাসাদ যেখানে রাজারা আজও বাস করেন। এটিই একমাত্র প্রাসাদ যা বিংশ শতাব্দীতে নির্মিত হয়েছিল, বিশ্বের বাকি প্রাসাদ গুলি এর থেকে অনেক প্রাচীন। বর্তমানে এর একটি অংশ বর্তমান মহারাজা গজ সিংয়ের পরিবারের আবাসস্থল হিসাবে ব্যবহৃত হয় এবং অবশিষ্টাংশে ‘তাজ হোটেল গোষ্ঠীর’ একটি পাঁচ তারা হোটেল রয়েছে।

সমতল থেকে পাহাড়ের গা বেয়ে উঠে এলাম প্যালেসের নির্দিষ্ট পার্কিং লটে। জনপ্রতি ১০০ টাকার টিকিট কেটে প্রবেশ করলাম এই রাজকীয় প্রাসাদের অঙ্গনে। আমাদের দেশে রাজতন্ত্রের অবসান হলেও এখনও এমন কিছু পরিবার আছে, যাদের রীতিনীতি রূপকথার রাজপরিবারের মতোই। খাতায়কলমে ক্ষমতা চলে গেলেও তাদের জীবনযাত্রা রাজকীয়। সেই ধারার অন্যতম উদাহরণ জোধপুরের এই রাজপরিবার।

১৯২৯ সালে এই প্রাসাদ নির্মাণ শুরু করেছিলেন বর্তমান রাজা দ্বিতীয় গজ সিংহের ঠাকুরদা উমেদ সিংহ। তাঁর নাম অনুসারেই প্রাসাদের নাম উমেদ ভবন। ১৯৪৩ সালে এর নির্মাণকাজ শেষ হয়। তৎকালীন সময়ে এর নির্মাণখরচ হয়েছিল প্রায় এক কোটি টাকার মতো। ২৬ একর জমির ওপর ৩৪৭টি কক্ষবিশিষ্ট এই প্যালেসের মধ্যে রয়েছে রাজদরবার, বিশাল ভোজনকক্ষ, বলনাচের ঘর, পাঠাগার, একাধিক সুইমিং পুল, স্পা, বিলিয়ার্ড খেলার ঘর, টেনিস ও স্কোয়াশ খেলার কোর্ট ইত্যাদি। এ ছাড়াও বিলাসিতার সব ধরনের আয়োজন রয়েছে এখানে। এখানে শুধুমাত্র কিছুটা নির্দিষ্ট অংশেই পর্যটকদের প্রবেশাধিকার রয়েছে। অবশ্য তাতেই আপনি রাজসিক জীবনযাপনের ছাপ স্পষ্ট অনুভব করতে পারবেন।

মান্ডোর গার্ডেনে।

আজকের মানে আধুনিক যুগের রাজারা তো আর হাতি বা ঘোড়ায় চড়েন না, তাঁরা গাড়ি চড়তেই পছন্দ করেন বেশি। তাই এই আধুনিক রাজপরিবারের সদস্যদের ব্যবহৃত গাড়ির সংগ্রহ দেখতে পাবেন ওঁদের গাড়ির সংগ্রহশালায়। যাঁরা গাড়ি পছন্দ করেন তাঁরা এই জায়গাটি দেখে নিতে কখনোই ভুলবেন না।

তবে আরও একটা জিনিসের কথা বলি, যার সঙ্গে রাজপরিবারের কোনো সম্পর্ক নেই। প্রাসাদ দেখে বেরিয়ে এসেই কুলফি খাওয়ার স্বাদ থেকে নিজেকে বঞ্চিত করবেন না। বিনিময়মূল্য মাত্র ৪০ টাকা, স্বাদে অতুলনীয়। উমেদ ভবন প্যালেস থেকে বেরিয়ে এসেই আপনার নজর পড়বে নীচে আধুনিক ভাবে গড়ে ওঠা জোধপুর শহর।

এর পর একে একে ঘুরে নিলাম ঘণ্টাঘর তথা ক্লক টাওয়ার, সরকারি সংগ্রহশালা, মহামন্দির, মান্ডোর গার্ডেন এবং বালসমন্দ লেক। হাইকোর্ট রোডে উমেদ পাবলিক গার্ডেনে রয়েছে সরকারি সংগ্রহশালা। এখানে প্রদর্শিত বিভিন্ন সামগ্রীর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল স্থানীয় শিল্পকলা। প্রাচীরে ঘেরা কারুকার্যময় ৮৪ স্তম্ভে ভর করে তৈরি হওয়া শিবমন্দিরটি মহামন্দির নামে খ্যাত। মান্ডোরের পথে পড়ল বালসমন্দ লেক।

মান্ডোর গার্ডেনে।

পৌঁছে গেলাম বালসমন্দ লেক থেকে আরও কিছুটা উত্তরে মান্ডোর গার্ডেনে। ৬ থেকে ১৪ শতক পর্যন্ত পরিহার রাজপুতদের রাজধানী ছিল মান্ডোর। ১৩৮১-তে রাঠোর রাও চৌহান পরিহারদের হটিয়ে মান্ডোরেই রাজধানী গড়েন। দুর্গ আজ আর নেই। তবে তার ধ্বংসাবশেষ রয়েছে। সুসজ্জিত উদ্যানে রয়েছে মন্দিরের ধাঁচে লাল বেলেপাথরে তৈরি ভাস্কর্যময় ছত্তিশ। রয়েছে মন্দির, মিউজিয়াম এবং ১৮ শতকে তৈরি বহু দেবমূর্তি শোভিত ‘হল অব হিরোজ’।

ফিরে এলাম হোটেলে। সাঙ্গ হল জোধপুর ভ্রমণ। পরের গন্তব্য সোনালি শহর জৈসলমের। থাকছে আগামী পর্বে

ছবি: লেখক

আরও পড়তে পারেন

গোয়া গেলে যে জায়গাগুলো আপনি অবশ্যই দেখবেন

ফের ডাকল দারিংবাড়ি ১/ বদলে গিয়েছে কত!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *