মন্দিরনগরী মল্লভূমে ইতিহাসের হাতছানি

মুকুট তপাদার

মল্লভূম বা বিষ্ণুপুরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বহু মন্দির। অলিগলি ছেয়ে আছে অতীতের বেশ কিছু প্রাচীন ভাঙা মন্দিরে। সেই ঐতিহাসিক বিষ্ণুপুরের কিছু ঝলক এই মন্দিরগুলোর মধ্যে আজও লুকিয়ে রয়েছে।

আমাদের বাংলায় শিল্পের যে বিশাল ভাণ্ডার আছে, সে সব শিল্পের বেশ কিছু নিদর্শন আজ মাটিতে ধ্বংসের মুখে দাড়িয়ে। বাংলার টেরাকোটা শিল্প এ রকমই এক নিদর্শন। ‘টেরা’ শব্দের অর্থ ‘মাটি’ এবং ‘কোটা’র অর্থ হচ্ছে পোড়ানো। এটি একটি লাতিন শব্দ।

মন্দিরের দেওয়ালে টেরাকোটায় পুরাণের কাহিনি, যুদ্ধ, নৌকাবিহার, জীবজন্তুর দৃশ্য, ঔপনিবেশিক সমাজচিত্র প্রভৃতি নানা রকম বিষয় স্থান পেয়েছে। চালা, রত্ন, দালান এবং দেউল, এই চার ভাগে বাংলার টেরাকোটা মন্দিরকে আলাদা করা যায়। 

বিষ্ণুপুর বলতেই আমাদের মনে আসে মল্লরাজ বীর হাম্বিরের রাসমঞ্চ, শ্যামরায় মন্দির, জোড়বাংলা মন্দির, মদনমোহনের মন্দির ইত্যাদি। তবে এর বাইরেও আছে বহু সৌধ ও মন্দির, যাদের দেওয়ালে কোনো প্রতিষ্ঠাফলক চোখে পড়ে না। এগুলো বর্তমানে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে।

মহাপ্রভু জিউ-এর ভগ্ন মন্দির

শ্রীশ্রীমহাপ্রভু জিউ-এর মন্দিরটি বিষ্ণুপুরের বহু প্রাচীন এক মন্দির। আনুমানিক ষোড়শ শতকে মহারাজ গোপাল সিংহ মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেন। মন্দিরটি জোড়বাংলা রীতিতে নির্মিত। টেরাকোটার কাজ খুব একটা অবশিষ্ট নেই। কিছু ফুলকারি নকশার কাজ মন্দিরের দেওয়ালে দেখা যায়। এটি রাজবাটী বা রাজদরবারের কাছেই পথের এক ধারে রয়েছে।

মল্লরাজারা এক কালে বৈষ্ণবধর্মে দীক্ষিত হন। এর পর থেকেই শুরু হয় এক নতুন অধ্যায়। বিষ্ণুপুরে একাধিক বিষ্ণুমন্দির গড়ে ওঠে। এক এক জন রাজা পর পর মন্দির প্রতিষ্ঠা করে যান। শ্রীচৈতন্যদেবের শিষ্য শ্রীনিবাস আচার্য ষোড়শ শতাব্দীতে বীর হাম্বিরকে বৈষ্ণবধর্মে দীক্ষিত করেন। শ্রীনিবাস এর পর বিষ্ণুপুরে রয়ে যান। বর্তমানে মহাপ্রভু জিউ-এর মন্দিরে কোনো বিগ্রহ নেই। চার পাশে জীর্ণতার ছাপ খুব স্পষ্ট।

যুগলকিশোর কৃষ্ণবলরামের মন্দির।

যুগোলকিশোর কৃষ্ণবলরামের মন্দিরদু’টি বিষ্ণুপুরের আর এক প্রাচীন মন্দির। বিখ্যাত মৃন্ময়ী মন্দির যাওয়ার পথে রাস্তার বাম দিকে এই যুগোলকিশোর মন্দিরদু’টি পড়ে। এই দুই মন্দির দেখতে ওড়িশার দেউল রীতির ন্যায়।

আনুমানিক অষ্টাদশ শতাব্দীতে মন্দিরগুলো নির্মিত হয়। মন্দিরের গায়ে আজও বেশ কিছু টেরাকোটার কাজ রয়েছে। তবে এই নিদর্শনের গায়ে আজ আগাছার জঙ্গল। মন্দিরের পাশে রাস্তা লতাপাতায় ঢেকেছে। সংরক্ষণের অভাব চোখে পড়ে।

বিষ্ণুপুরের লালবাঈ মহল আজ শুধুই বিস্মৃতির অতলে। এই জায়গাটি নতুন মহল নামেও পরিচিত। মহলটি ধ্বংসাবশেষে পরিণত। ওড়িশার পাঠান সর্দার রহিম খাঁর ধনরত্ন লুঠ করে বেগম লালবাঈকেও মল্লরাজ দ্বিতীয় রঘুনাথ সিংহ বিষ্ণুপুরে নিয়ে আসেন। এর পর লালবাঈ রাজার প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়েন। এই মহলটি রাজা নির্মাণ করে দেন। এখন যাকে লালবাঁধ দিঘি বলা হয়, সেখানে লালবাঈকে ওই জলে ডুবিয়ে মেরে ফেলেন দ্বিতীয় রঘুনাথ সিংহের রানি। তার থেকেই নাম হয় লালবাঁধ।

রাজবাটীর একটি অংশের বর্তমান চেহারা।

লালবাঁধের কাছে এক নির্জন স্থানে রয়েছে আর এক সুদৃশ্য প্রাচীন ভাঙা মন্দির। মন্দিরের শিখর লতাপাতায় প্রায় ঢেকে গিয়েছে। স্থানীয় লোকেরা এটিকে বিষ্ণুমন্দির বলেন। কিন্তু সঠিক কেউ নাম জানেন না। এই স্থানে এটি বহুকাল ধরেই আছে।

এই মন্দিরে কোনো মূর্তি নেই। অনেকে অনুমান করেন এটি ছিল একটি দোলমঞ্চ। কোনো এক কালে ভক্তবৃন্দের উপস্থিতিতে এই দোলমঞ্চ অপূর্ব রূপ ধারণ করত। কালের প্রভাবে মন্দিরটি ধ্বংস হতে বসেছে। ঐতিহ্যের শেষ নিদর্শন হয়ে কোনো মতে টিকে রয়েছে।

এমনই একটি পঞ্চরত্ন শৈলীর মন্দির বিষ্ণুপুরে রাস্তার এক পাশে দাঁড়িয়ে আছে। এটি বিষ্ণুপুরের বিখ্যাত মদনমোহন মন্দির যাওয়ার পথে পড়ে। মন্দিরের শিখর আগাছায় ভরে গিয়েছে। দুই-তিনটি শিখর বাদে বাকি গুলো আজ আর নেই।

মদনমোহন মন্দির যাওয়ার পথে এক প্রাচীন মন্দির।

এই মন্দিরেও কোনো মূর্তি নেই। শুধু সামনের দেওয়াল ও মন্দিরের প্রবেশপথটি ছাড়া ওপরের দিকে এতই লতাপাতায় প্রায় ঢেকে গিয়েছে যে তার বিস্তৃত বিবরণ দেওয়া প্রায় অসম্ভব। মন্দিরের চূড়া রেখদেউল রীতির।

এই মন্দিরগুলো দর্শন করতে করতে মন্দিরনগরীর ঐতিহ্যের কথা ভেবে কিছুক্ষণের জন্যও মন্দিরপ্রেমীদের মন-প্রাণ আনন্দে ভরে ওঠে। কিন্তু পরক্ষণেই বিষাদ এসে মনটা গ্রাস করে। মন্দিরনগরীর এই সুনিপুণ শিল্পসুষমা যে লুপ্ত হতে চলেছে। মন্দিরনগরীর এই ঐতিহ্যকে অক্ষুণ্ণ রাখতে সকলের এগিয়ে আসা উচিত।

(ছবি: লেখক, প্রথম ছবি লাল বাঁধের কাছে দোলমঞ্চের)

আরও পড়তে পারেন

শান্তিপুরের রাস উৎসবকে পর্যটন মানচিত্রে তুলে আনার নির্দেশ দিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়

বেঙ্গল সাফারি পার্কে নতুন আকর্ষণ, বছর শেষের আগেই সিংহ সাফারি

বাঁকুড়ায় নতুন ট্রেক রুটের সন্ধানে অভিযান চালালেন ১৬ জন অভিযাত্রী

১২ নভেম্বর থেকে দ্বিতীয় ঘুম উইন্টার ফেস্টিভ্যাল, এ বার রাতেও চলবে টয়ট্রেন

অপরূপ লুঙচক, যেখানে নিস্তব্ধতা তার নিজের সংজ্ঞা লেখে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *