‘ভ্যাকেশন’ নয়, নব্য স্বাভাবিকতার নতুন ধারা ‘ওয়ার্কেশন’

ভ্রমণঅনলাইন ডেস্ক: এখন অনেককেই দেখা যাচ্ছে, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের, ল্যাপটপ নিয়ে বেড়াতে যাচ্ছেন। খোঁজ নিয়ে দেখুন, তাঁরা বাইরে যাচ্ছেন বটে, তবে বেড়াতে নয়, কাজ করতে। যদিও যাচ্ছেন বেড়ানোরই জায়গায়।

ব্যাপারটা ঠিক বোধহয় বোধগম্য হল না। আসলে ‘ভ্যাকেশন’-এ নয়, তাঁরা যাচ্ছেন ‘ওয়ার্কেশন’-এ। তাঁরা ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’ই করছেন, তবে নিজের বাড়িতে থেকে নয়, ছূটি কাটানোর কোনো জায়গা থেকে। কোভিড আবহে নব্য স্বাভাবিকতায় এটাই এখন দস্তুর হয়ে উঠছে ক্রমশ।

প্রায় এক বছর হতে চলল কোভিড পরিস্থিতি চলছে। চার দেওয়ালের মধ্যে ঘরবন্দি থেকে চালিয়ে যেতে হচ্ছে ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’ (ডবলিউএফএইচ)। হতাশা, একঘেয়েমি যে অনেককেই গ্রাস করছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বাড়ছে মানসিক চাপ। আর অদূর ভবিষ্যতে এই ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’ কালচার ওঠারও কোনো সম্ভাবনা নেই।

কেপিএমজি-র ২০২০ ‘কোভিড ১৯ হিউম্যান রিসোর্সেস’ রিপোর্টে বলা হয়েছে, ভারতের ৬৮ শতাংশ সংস্থা ‘ডবলিউএফএইচ’ নীতিকে নিজেদের কর্মনীতির মধ্যে ঢুকিয়ে নিয়েছে। উইলিস টাওয়ার্স ইন্ডিয়ার সমীক্ষা অনুযায়ী ৫৫ শতাংশ কোম্পানি এখন ‘ডবলিউএফএইচ’ নীতি চালিয়ে যাবে। আর একটি সংস্থা নাইট ফ্র্যাঙ্ক বলেছে, ৭০ শতাংশেরও বেশি ভারতীয় কোম্পানি অন্তত আগামী ছ’ মাস ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’ চালিয়ে যাবে।

এই পরিস্থিতিতে মানসিক চাপ কাটিয়ে কাজ করার অন্যতম পন্থা হল মাঝেমাঝে ‘ওয়ার্কেশন’-এ যাওয়া। ‘ওয়ার্কেশন’-এ যেতে পারলে হতাশা দূর হবে, একঘেয়েমিটাও কাটবে।

তাই অনেকেই বেরিয়ে পড়ছেন ‘ওয়ার্কেশন’-এ। সামনে উদার আদিগন্ত সবুজ ধানখেত, কিংবা তুষারমণ্ডিত হিমালয় অথবা নীল সমুদ্রের উচ্ছ্বসিত তরঙ্গমালা – আর চোখ ল্যাপটপে কিংবা খাতায়-কলমে।

২০২০-এর ভ্রমণ প্রবণতা নিয়ে ইক্সিগো ট্রাভেল (Ixigo Travel) যে রিপোর্ট দিয়েছে, তা থেকে দেখা যাচ্ছে, মে-জুন মাসে অভ্যন্তরীণ উড়ান চালু হওয়ার পর থেকে ভ্রমণকারীদের ভ্রমণস্থানের বাছাইয়ে একটা পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে। যে সব ভারতীয় কোম্পানি ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’ নীতি ঘোষণা করেছে, তাদের ৩০ শতাংশ কর্মী জানিয়েছেন, তাঁরা দূর প্রান্তের কোনো এক অবকাশ যাপনের কেন্দ্র থেকে কাজ করছেন।

গুরুগ্রাম-ভিত্তিক ইক্সিগো ট্রাভেলের কো-ফাউন্ডার এবং সিইও অলক বাজপাই জানিয়েছেন, “গোয়া, জয়পুর, উদয়পুর, শিমলা এবং উত্তরাখণ্ডের বিভিন্ন জায়গার জন্য খোঁজখবর প্রতি মাসে ২৭ শতাংশ করে বাড়ছে। বেশির ভাগ ভ্রমণকারীই সে সব জায়গায় থাকার জন্য ভাড়া বাড়ি, সার্ভিস অ্যাপার্টমেন্ট বা ভিলা পছন্দ করছেন। তার পরে চাইছেন রিসর্ট বা ইকো-ফ্রেন্ডলি কটেজ। হোটেলের ভাড়াতেও এখন আকর্ষণীয় ছাড় পাওয়া যাচ্ছে। তা ছাড়া বুকিং বাতিল করা সংক্রান্ত নীতিও এখন অনেক নমনীয়। এই সব বিষয়ও ভ্রমণকারীদের আকৃষ্ট করছে।”

সামাজিক উদ্যোগে যুক্ত দিল্লির শৈলজা সুদ দাসগুপ্ত গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নয়নে স্থানীয় গ্রামীণ সম্প্রদায়ের সঙ্গে একযোগে কাজ করেন। তিনি বললেন, “‘ওয়ার্কেশন’-এর জন্য হোমস্টের চাহিদা বেশ বাড়ছে, বিশেষ করে হিমাচল আর উত্তরাখণ্ডে। কারণ এখানে থাকলে খরচ অনেক বাঁচে এবং কেউ যদি মাসখানেক থাকেন তা হলে তাঁকে ৪০-৫০% ছাড় দেওয়া হচ্ছে।”

শৈলজা সুদ দাসগুপ্ত থাকেন উত্তরাখণ্ডের মুক্তেশ্বরে। তিনি আরও বললেন, “হোমস্টে তো কোনো একজনের বাড়ি, তাই নিরাপত্তা বা সুরক্ষা নিয়ে কোনো চিন্তা নেই। খাবারদাবার নিয়েও কোনো চিন্তা নেই। রোজ বাড়িতে তৈরি টাটকা অরগ্যানিক খাবার পাওয়া যাচ্ছে। যাঁদের হোমস্টে তাঁরা স্বাস্থ্যবিধি নিয়েও যথেষ্ট সচেতন। ১৫ দিন থেকে ১ মাসের জন্য বুকিং পাওয়া যাচ্ছে। তাই দূষণ-মুক্ত পরিবেশে কাজ করে একটা তৃপ্তিও পাওয়া যাচ্ছে। তার উপর রয়েছে সপ্তাহান্তে নতুন কোনো জায়গা আবিষ্কার। এর ফলে ব্যক্তিমানুষের শুধু উৎপাদনশীলতাই বাড়ছে না, শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যও খুব চাঙ্গা থাকছে।”

ইতিমধ্যে কোভিড পরিস্থিতিতে ভেঙে পড়া পর্যটনভিত্তিক অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার জন্য উত্তরাখণ্ড সরকার ‘ওয়ার্ক ফ্রম মাউন্টেনস্‌’ পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে।

উত্তরাখণ্ড পর্যটন দফতরের সচিব দিলীপ জাওয়ালকর জানান, ছুটি কাটানোর সব থেকে আধুনিক ধারণা হল ওয়ার্কেশন। কোভিড অতিমারিতে ‘ওয়ার্ক ফ্রম হম’-এর বিকল্প ব্যবস্থা করছে উত্তরাখণ্ড সরকার। টুরিস্ট স্পটে এসেও যাতে অফিসের কাজ করা যায়, সে জন্যই এই উদ্যোগ।

জাওয়ালকর বলেন, “ওয়ার্কেশন হল শরীর, মন আর আত্মার চিকিৎসা। ব্যাপারটি একেবারে আধুনিক, অনন্য। ওয়ার্কেশনে থাকতে হবে দ্রুত ইন্টারনেট সংযোগ, অবিরাম বিদ্যুৎ সরবরাহ, আরামদায়ক থাকা, প্রাথমিক চিকিৎসার সুবিধা, স্বাস্থ্যকর খাবারদাবার। অফিসকর্মীরা যাতে ফোন ধরতে পারেন, বাচ্চারা যাতে অনলাইন ক্লাস করতে পারে তার সুব্যবস্থা থাকা চাই। এর সব কিছুই করছে উত্তরাখণ্ড।”   

জিম করবেট উদ্যান, ল্যান্সডাউন, মুসৌরি, কৌশানি, দেহরাদুন, নৈনিতাল, আলমোড়ার মতো জায়গার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করার মধ্যেই কাজ করতে পারবেন পর্যটকরা, এমনই জানাচ্ছে পর্যটন দফতর। এই সব জায়গার বিভিন্ন হোমস্টে, হোটেল ও রিসর্টে কম খরচেই ওয়ার্ককেশন-এর সুবিধা পাওয়া যাবে বলে জানিয়েছেন জাওয়ালকর।

টমাস কুকের মতো কোম্পানিও বিভিন্ন খরচে ওয়ার্কেশন-এর প্যাকেজ দিচ্ছে। এই প্যাকেজের শুরু ২২৯৯ টাকা থেকে। টমাস কুকের তরফে রাজীব কালে বলেন, ওয়ার্ক ফ্রম হোমই হল এখন নব্য স্বাভাবিকতা। অভ্যন্তরীণ বিমান পরিবহন শুরু হতেই এবং ভ্রমণের উপরে নিষেধাজ্ঞা অনেকটা শিথিল হওয়ার পর থেকেই ওয়ার্কেশন ভ্রমণ অনেক বেড়ে গিয়েছে।

আরও পড়ুন: ২০২১-এর আগে যে সব গন্তব্য পর্যটকদের কাছে অধরাই থাকছে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *