ভ্রমণ অনলাইনডেস্ক: ১৮৯০ সালে স্বামী অখণ্ডানন্দকে সঙ্গে নিয়ে কুমায়ুনের পথে পথে বেরিয়ে পড়েন স্বামী বিবেকানন্দ। উদ্দেশ্য ছিল জ্ঞানের খোঁজ (in search of enlightment)। সাত বছর পর আবার কুমায়ুন হিমালয়ে ফিরে আসেন স্বামীজি।
আজ, স্বামীজির জন্মদিনে সেই পথকে চলুন আমরাও অনুসরণ করি। আমাদের যাত্রা শুরু হোক কাঠগোদাম থেকে। কারণ হাওড়া বা দিল্লি থেকে ট্রেনে সরাসরি পৌঁছোনো যায় কাঠগোদাম।
নৈনিতাল
কাঠগোদাম থেকে ৩৬ কিলোমিটার দূরে কুমায়ুনের সব থেকে বড়ো শহরে নৈনিতাল। আমাদের যাত্রা শুরু হোক এখান থেকেই। ১৮৯০ সালে এই নৈনিতাল থেকেই অখণ্ডানন্দের সঙ্গে আলমোড়ার উদ্দেশে হাঁটা শুরু করেন স্বামী বিবেকানন্দ। নৈনিতালের কাছেই অবস্থিত ভীমতাল। কাঠগোদাম থেকে মায়াবতী যাওয়ার সময় এই ভীমতালের সৌন্দর্যে মোহিত হয়ে গিয়েছিলেন স্বামীজি।
কাকরিঘাট
নৈনিতাল থেকে ৪২ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। অনেকেই মনে করেন যে এখানেই প্রথম বার চিরন্তন সত্য (Eternal Truth) অনুভব করেছিলেন স্বামীজি। কোশী নদীর ধারে অবস্থিত কাকরিঘাটে রয়েছে শিবের ছোট্ট একটা মন্দির, কারাটেশ্বর মহাদেব মন্দির। কাকরিঘাটের ২০ কিলোমিটার দূরে তমসন হাউজে ১৮৯৮ সালে স্বামীজি রাত্রিবাস করেছিলেন বলে জানা যায়।
সহায়দেবী মন্দির
কাকরিঘাট থেকে মাত্র ১৫ কিলোমিটার এবং কুমায়ুনের আরও এক বড়ো শহর আলমোড়া থেকে ৪০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত শীতলাখেত। এই শীতলাখেত থেকে ঘণ্টাখানেকের খুব সহজ ট্রেক করে পৌঁছে যাওয়া যায় সহায়দেবী মন্দির। এই ট্রেকপথ থেকেই দর্শন পাবেন ত্রিশূল, পঞ্চচুল্লী, নন্দাদেবী, চৌখাম্বাদের। এই একই পথ অনুসরণ করেছিলেন স্বামীজিও, ১৮৯৭ সালে। এই মন্দিরের কাছেও একটি গুহা খুঁজে নিয়ে ধ্যান করেছিলেন তিনি।
দেওয়ালদার হাউজ
শীতলাখেত থেকে ৮০ কিলোমিটার এবং আলমোড়া থেকে ৫৭ কিলোমিটার দূরে বাগেশ্বর জেলায় অবস্থিত দেওয়ালদার। ১৮৯৭ সালে এই গ্রামে এসেছিলেন স্বামীজি। এই গ্রামে দেওয়ালদার হাউজ নামক একটি বাড়িতে অবস্থান করেছিলেন তিনি এবং এখানেই টানা ৪৭ দিন ধ্যান করেছিলেন তিনি।
আলমোড়া
দেওয়ালদার থেকে বিবেকানন্দের পথ অনুসরণ করে আমাদের পরের গন্তব্য হবে আলমোড়া। অদ্বৈত আশ্রম থেকে ১২৭ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। জানা যায়, ১৮৯০ সালে স্বামী অখণ্ডানন্দকে সঙ্গে নিয়ে শুধুমাত্র নিজেদের পোশাক আর ভিক্ষার বাটি নিয়ে নৈনিতাল থেকে কাকরিঘাট হয়ে আলমোড়া চলে এসেছিলেন স্বামীজি। আলমোড়ায় রামকৃষ্ণের নামাঙ্কিত আশ্রম গড়ে তোলার স্বপ্ন ছিল স্বামীজির। তাঁর মৃত্যুর ১২ বছর পর, ১৯১৬ সালে আলমোড়ায় স্থাপিত হয়ে রামকৃষ্ণ কুটির।
আলমোড়াতেই রয়েছে শ্রী রঘুনাথ মন্দির। ১৮৯৭ সালে দ্বিতীয় বার আলমোড়ায় এসেছিলেন স্বামীজি। সে বার এই রঘুনাথ মন্দিরেই তাঁকে অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন স্থানীয় গ্রামবাসীরা।
আলমোড়ার আরও এক দর্শনীয় স্থান ‘শ্রী লালা বদরী শাহের বাড়ি। বর্তমানে রামকৃষ্ণ কুটির যেখানে অবস্থিত, সেখান থেকে মাত্র দু’ কিলোমিটার দূরে এই বাড়িটি। ১৮৯০ এবং ১৮৯৭, দু’ বারই এই বাড়িতে রাত্রিবাস করেছিলেন স্বামীজি। বিকেল ৩টের পর সাধারণ ভ্রামণিকদের এই বাড়িতে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয়।
এই আলমোড়াতেই রয়েছে বিবেকানন্দ বিশ্রামাবাস। ১৮৯০ সালে ভ্রমণের সময় অত্যধিক পরিশ্রম এবং খিদের কারণে এই পাথরে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন স্বামীজি। তখনই তাঁকে দেখতে পেয়ে শশা খাইয়ে স্বামীজিকে সুস্থ করে তোলেন জুলফিকার আলি নামক এক মুসলিম মানুষ। সেই ঘটনার স্মরণে, ওই পাথরে একটা ছোট্ট বিশ্রামাবাস তৈরি করা হয়েছে। কৃষিবিজ্ঞানী তথা স্বামী বিবেকানন্দের ভাবাদর্শে অনুপ্রাণিত বশী সেন এই বিশ্রামাবাসটি তৈরি করে দেন।
কাসারদেবী মন্দির
আলমোড়া শহর থেকে ৯ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত কাসার দেবী মন্দির। দ্বিতীয় শতকে তৈরি এই মন্দির। পাইন এবং দেবদারু গাছের মধ্যে অবস্থিত এই মন্দির দেখে স্বামীজি অনুপ্রাণিত হন। ১৮৯০-তে ভ্রমণকালে এই কাসারদেবী মন্দিরের কাছে একটি গুহায় বসে ধ্যান করেছিলেন স্বামীজি।
পাতালদেবী মন্দির
আলমোড়া শহর থেকে ৭ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত পাতালদেবী মন্দির। নিশ্চিত করে কিছু বলা না গেলেও অনেকেই মনে করেন যে এই মন্দিরের কাছে একটি ঘরে কয়েক দিন থেকেছিলেন স্বামীজি।
গভর্নমেন্ট ইন্টার কলেজ, আলমোড়া
১৮৯৭ সালে এই কলেজে বৈদিক শিক্ষার ওপরে হিন্দিতে বক্তৃতা দিয়েছিলেন স্বামীজি। তাঁর দক্ষ বক্তৃতার মধ্যে দিয়ে সবার মন জয় করে নিয়েছিলেন স্বামীজি।
মায়াবতী আশ্রম
স্বামীজির পথ অনুসরণ করলে আমাদের পরের গন্তব্য হবে মায়াবতী আশ্রম তথা অদ্বৈত আশ্রম। আলমোড়া থেকে ১২৭ কিলোমিটার দূর।
উল্লেখ্য, আল্পস পর্বতমালায় ভ্রমণের সময় স্বামী বিবেকানন্দের মনে ভারতে অনুরূপ একটি স্থানে বেদ-চর্চার কেন্দ্র স্থাপনের ইচ্ছা জাগে। স্বামীজির সেই ইচ্ছারই বাস্তবিক রূপ দেন তাঁর দুই শিষ্য ক্যাপ্টেন জেমস হেনরি সেভিয়ার ও তার স্ত্রী শার্লট সেভিয়ার। ১৮৯৯ সালে স্বামীজি নিজে এই আশ্রমের উদ্বোধন করেন। স্বামীজি অদ্বৈত আশ্রমের যে ঘরে রাত্রিবাস করেছিলেন, বর্তমানে সেটিকে গ্রন্থাগারের রূপ দেওয়া হয়েছে।
লোহাঘাট
আলমোড়া থেকে ১১৭ কিলোমিটার এবং মায়াবতী থেকে মাত্র ১০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত চম্পাবত জেলার এক ছোট্ট সাজানো শহর লোহাঘাট। এখানকার ডাক বাংলোতে কয়েক দিন ছিলেন স্বামীজি। বর্তমানে ওই জায়গাটিতে একটি শিলালিপি রয়েছে।
শ্যামলাতাল
লোহাঘাট থেকে সমতলের শহর টনকপুরের পথে যাত্রা করলে দু’ ঘণ্টায় আমরা পৌঁছে যাব শ্যামলাতাল। এখানে স্বামীজি নিজে এসেছিলেন কি না, তার নিশ্চিত করে কোনো তথ্য আমরা পাই না। কিন্তু শ্যামলাতাল হ্রদের এক প্রান্তে যে বিবেকানন্দ আশ্রম রয়েছে তার সূচনা হয় ১৯১৫ সালে। রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের ষষ্ঠ অধ্যক্ষ স্বামী বিরজানন্দের হাত ধরে পথ চলে শুরু করে এই আশ্রম।