কালীপুজো-দীপাবলি: শান্তিপুরে চাঁদুনিবাড়িতে পুজোর সময় গৃহদেবতারাও উপস্থিত থাকেন

chaduni ma, shantipur

শুভদীপ রায় চৌধুরী

বহু দূরদূরান্ত থেকে সাধারণ মানুষ বছরে দু’ বার শান্তিপুরে ছুটে আসে – একবার রাস উৎসবে আর এক বার দীপান্বিতা কালীপুজো‍য়। শান্তিপুরের বহু প্রাচীন কালীপূজার মধ্যে সব থেকে আগে যাঁর নাম উঠে আসে তিনি হলেন মা আগমেশ্বরী। এ ছাড়াও আরও কিছু প্রাচীন কালীপুজো হয় এই শাক্ত-বৈষ্ণব ক্ষেত্রে। তাদের মধ্যে অন্যতম হল চাঁদুনিবাড়ির কালীপুজো। সেই বাড়ির সদস্য সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়ের কাছে শুনেছিলাম তাঁদের পুজোর ইতিহাস ও রীতিনীতির কথা।

শান্তিপুরের কাশীনাথ মুখোপাধ্যায়ের (সার্বভৌম) ভাই গোপীনাথ মুখোপাধ্যায় (সার্বভৌম) তন্ত্রসাধনা করতেন। কাশীনাথ ও গোপীনাথ পণ্ডিত ছিলেন, তাই তাঁরা ‘সার্বভৌম’ উপাধি পান। এই মুখোপাধ্যায় পরিবারের প্রতিষ্ঠিত নারায়ণ জিউ বহু প্রাচীন। কথিত আছে, নারায়ণ জিউয়ের সেবার জন্য একদিন গোপীনাথ সার্বভৌম বাগানে ফুল তুলছিলেন। সেই সময় এক বালিকা তাঁর কাছে এসে প্রসাদ চায়। তিনি সেই বালিকাকে বলেন, পূজার পর তিনি প্রসাদ দেবেন। পূজা শেষ হওয়ার পর তিনি প্রসাদ দিতে এসে সেই বালিকাকে আর খুঁজে পাননি। তার পর এক দিন রাত্রে তিনি মায়ের স্বপ্নাদেশ পান – “তোর বাড়ির অদূরে এক কূর্মপীঠ আছে, সেখানে পঞ্চমুণ্ডির আসনে আমাকে পূজা কর। তুই যে মন্ত্রে আমাকে পূজা করবি, আমি সেই মন্ত্রেই সন্তুষ্ট হব।” সেই স্বপ্নাদেশের কথা গোপীনাথ তাঁর মাকে বলেন। তখন গোপীনাথের মা স্বপ্নাদেশের নির্দেশমতো মায়ের বিগ্রহ তৈরি করে দেন।

মন্দিরে অধিষ্ঠিতা চাঁদুনি মা।

এই মুখোপাধ্যায় বাড়িতে কালীপুজোর আলাদা পুথি আছে। সে-ই পুথি গোপীনাথেরই লেখা। সেই পুথি দেখেই মায়ের পুজো হয়। মুলত এই চাঁদুনিবাড়ির কালীপুজোয় দেবীঘট থাকলেও মূলপূজা দেবীর যন্ত্রেই অনুষ্ঠিত হয়। কালীপুজোর দিন সকালে মুখোপাধ্যায় বাড়ির কুলবধূরা দেবীর ঘটে জল ভরতে যান যে ঘটে দেবীর পূজা হয়।

দুর্গাপুজোর দশমীর দিন এই বাড়ির ছেলেরা চাঁদুনি মায়ের কাঠামো মন্দির থেকে দুর্গাদালানে নিয়ে আসেন। মায়ের সেই কাঠামোয় বাড়ির সব থেকে বয়ঃজ্যেষ্ঠা মাটির প্রলেপ দেন। তার পর মায়ের মূর্তি তৈরি শুরু হয়। এ ভাবেই চাঁদুনি মায়ের বিগ্রহ বাড়ির দুর্গাদালানেই তৈরি হয় এবং পুজোর দিন বাড়ির ছেলেদের কাঁধে করে তিনি মন্দিরে যান। কালীমন্দিরের সামনে এক নহবতখানা তৈরি করা হয়, যেখানে কালীপুজোর অমাবস্যার আগের একাদশীতিথি থেকে সানাই বসানো হয়। সেই সানাই আট প্রহরে আট বার বাজানো হয়।

চাঁদুনি মাকে ডাকের সাজ পরানো হয়। কালীপুজোর আগের দিন জবাকুসুম তেল দিয়ে চাঁদুনি মায়ের কেশসজ্জা করেন বাড়ির ছেলেরা। সব থেকে বড়ো বৈশিষ্ট্য হল চাঁদুনি মাকে মোমের দু’টি মালা পরানো হয়, একটি লাল এবং একটি বেলগোলাপের। সমস্ত রকমের স্বর্ণালংকার এবং রৌপ্যালংকার পরানো হয়। যেমন, সোনার কামরাঙার মটরমালা, সোনার বাজুবন্ধ, পুষ্পহার, সীতাহার ইত্যাদি। মায়ের বুকে সোনার প্রজাপতি থাকে। এ ছাড়াও শাঁখাবাঁধানো, নোয়াবাঁধানো, রতনচুড়, হাতপদ্ম, কোমরবন্ধনী ইত্যাদি বিভিন্ন রকমের গয়না পরানো হয়।

মা-কে ভোগ।

চাঁদুনি মাকে দুর্গাদালান থেকে নিয়ে যাওয়ার সময় ক্ষীরের মিষ্টি খাওয়ানো হয়। মাথায় রুপোর ছাতা ধরে তাঁকে মন্দিরে নিয়ে যাওয়া হয় এবং পঞ্চমুণ্ডির আসনে তাঁকে বসানো হয়। চণ্ডীপাঠ হয়, খাঁড়াপূজাও হয়। চাঁদুনি মায়ের পূজা নিশিরাতে হয় এবং বাড়ির বয়ঃজ্যেষ্ঠ সদস্য মায়ের পূজা করেন। পাঁঠাবলি হয়। এই চাঁদুনিবাড়ির কালীপুজোর পাঁঠাবলিপ্রথা বহু প্রাচীন। অনেক ভক্ত মায়ের কাছে মানত পূরণের জন্য পাঁঠা প্রদান করেন বলিদানের জন্য।

চাঁদুনি মাকে নিরামিষ ভোগ প্রদান করা হয়। ভোগে থাকে আট রকমের ভাজা, পোলাও, সাদাভাত, খিচুড়ি, কলার বড়া, চালতার চাটনি, পায়েস, মিষ্টান্ন ইত্যাদি। ভিয়েন বসিয়ে গজা, পকান্ন তৈরি করা হয় যা দূরদূরান্তে প্রসাদ হিসাবে যায়। চাঁদুনি মায়ের গোটা ফলের নৈবেদ্য হয় এবং বারো মাসের সমস্ত রকমের ফল এবং সবজি মাকে নিবেদন করা হয়।

পরের দিন মাকে কাঁধে করে নিয়ে গিয়ে বিসর্জন দেওয়া হয়। বাড়ির মেয়ে শ্বশুরের গৃহে ফিরে যাচ্ছেন বলে বিসর্জনের মাঝরাস্তায় বাজনা বন্ধ করে শোক পালন করা হয়। কালীপুজোর সময় গৃহদেবতারাও মন্দিরে উপস্থিত থাকেন।

কী ভাবে যাবেন

শিয়ালদহ থেকে ট্রেনে চলুন শান্তিপুর। স্টেশন থেকে বড়ো গোস্বামীবাড়ি চলুন টোটোয় বা রিকশায়, দূরত্ব দেড় কিমি। কলকাতা থেকে শান্তিপুর বাসে বা গাড়িতেও যেতে পারেন। দূরত্ব ৯৪ কিমি।

আরও পড়তে পারেন

মঙ্গলবার থেকে টাইগার হিল বয়কটের ডাক দিল গোর্খা গাড়িচালক সংগঠন

মঙ্গলবার থেকেই উত্তর সিকিমের পারমিট দেওয়া শুরু প্রশাসনের

কেদারনাথ এ বার পৌঁছোনো যাবে রোপওয়েতে, প্রকল্পে সবুজ সংকেত

কেদারনাথের কাছে হেলিকপ্টার ভেঙে ৬ তীর্থযাত্রী ও পাইলটের মৃত্যু

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *