শুভদীপ রায় চৌধুরী
দেখতে দেখতে জগদ্ধাত্রীপুজোও এসে গেল। চলুন যাওয়া যাক নদিয়ার শান্তিপুরে। দেখে আসা যাক সেখানকার ব্রহ্মচারী পরিবারের জগদ্ধাত্রীপুজো।
শান্তিপুরে ব্রহ্মচারী পরিবারের জগদ্ধাত্রীপুজো অতি প্রাচীন নয়। এর বয়স সোয়া শ’ বছরের কিছু বেশি। কিন্তু আদতে এই পুজোর সূত্রপাত শান্তিপুরে নয়, অন্যত্র। এর গোড়াপত্তনের ইতিহাস জানতে হলে পিছিয়ে যেতে হবে প্রায় সাড়ে ৫০০ বছর।
ব্রহ্মচারী বংশের আদিপুরুষ চামু ব্রহ্মচারী বাস করতেন অধুনা বাংলাদেশের রাজশাহী বিভাগের নাটোরে। সময়টা ছিল ১৪৮৫ খ্রিস্টাব্দ। ব্রহ্মচারীদের আদি পদবি বাগচী। সৎ-মা এবং নিজের মায়ের দ্বন্দ্বের কারণে পৈতের সময় তিন দিনের রাত্রিবাস শেষ করার আগেই চামু দণ্ডীঘর থেকে আগেই বেরিয়ে আসেন সন্ন্যাস গ্রহণের জন্য। তাই এর পর থেকে পরিবারের সদস্যরা বাগচীর পরিবর্তে ব্রহ্মচারী পদবি লিখতে শুরু করেন। চামু ব্রহ্মচারী অবশ্য আবার পরিবারে ফিরে এসেছিলেন, তবে তাঁদের পদবি বাগচীতে ফিরে যায়নি।
সেই সময় বাংলায় চলছিল হুসেন শাহের আমল। তাঁর আমলে ১৪৮৮ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ ব্রহ্মচারী পরিবার অধুনা দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার অন্তর্গত সুভাষগ্রাম ও মল্লিকপুরের মাঝে মালঞ্চ গ্রামের জমিদারি পান। তার বছর তিনেক পর মালঞ্চ গ্রামে ব্রহ্মচারী বংশে দুর্গাপুজো শুরু হয়। সেই বছরই শুরু হয় জগদ্ধাত্রীপুজো।
এই ঘটনার শ’ চারেক বছর পরে ১৮৮০-৮৫ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ চামু ব্রহ্মচারীর উত্তরপুরুষ রামগোপাল ব্রহ্মচারী মালঞ্চ থেকে বেরিয়ে আসেন ও শান্তিপুরে চলে যান। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ব্রহ্মচারী পরিবারের পাটের ব্যাবসা ছিল। পরিবারে ব্যক্তিগত সংঘাতের কারণে রামগোপালের পাটের গুদামে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। রামগোপাল ব্রহ্মচারী নিঃসম্বল হন।
রামগোপালের মাতুলালয় ছিল শান্তিপুরের মৈত্র পরিবার। মৈত্র পরিবারের রজনীকান্ত মৈত্রের সঙ্গে রামগোপাল ব্রহ্মচারী ব্যাবসার কারণে সংযোগ স্থাপন করেন এবং শান্তিপুরে চলে আসেন। তিনি শান্তিপুরে নিজের বাড়ি ও আটচালা নির্মাণ করেন। নির্মাণের পর তিনি দেবীর স্বপ্নাদেশ পান – কালীপুজোর পরেই আয়োজন করতে হবে জগদ্ধাত্রীপুজোর। হাতে সময় খুব কম, কিন্তু দেবীই সব ব্যবস্থা করে দেন।
স্বপ্নাদেশ পাওয়ার পরদিন রামগোপাল গঙ্গাস্নানে গিয়ে ৭ বছরের এক বালিকাকে দেখেন ও তাঁকেই অনুসরণ করে গিয়ে এক কুম্ভকারের বাড়িতে পৌঁছে যান। সেই কুম্ভকারের কাছেই জগদ্ধাত্রী মূর্তি নির্মাণের ব্যবস্থা হয়। এ ভাবেই মালঞ্চ থেকে সরে এসে শান্তিপুরে জগদ্ধাত্রীপুজো শুরু হয় ১৮৯৪-৯৫ সাল নাগাদ।

পরবর্তী কালে রামগোপাল ব্রহ্মচারীর প্রথম ও দ্বিতীয় পুত্র এই পুজোর হাল ধরেন। রামগোপালের দ্বিতীয় পুত্র ভুতনাথ ব্রহ্মচারীর সময় জগদ্ধাত্রীপুজোর জাঁকজমক বাড়ে এবং সেই সময় অর্থাৎ ১৯০৫-০৭ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ ভুতনাথ ২৫ হাজার টাকা দিয়ে মায়ের গহনা তৈরি করেন এবং পাশাপাশি পারিবারিক সম্পত্তির পরিমাণও বাড়ান। রামগোপাল ব্রহ্মচারীর নির্মিত আটচালার সংস্কার করে ভুতনাথ ব্রহ্মচারী দেবীদালান নির্মাণ করেন, তার সামনে নাটমন্দির।
ব্রহ্মচারী বংশে জগদ্ধাত্রীর রঙ উদিত সূর্যের মতো লাল। এই পরিবারে একদিনেই পুজো হয় অর্থাৎ নবমী তিথিতে ত্রিকালীন পূজা। দেবীর চালচিত্রে রয়েছে হস্তশিল্পের ছোঁয়া। দেবী সিংহবাহিনী এবং রাজসিংহরূপ লক্ষ করা যায়। জগদ্ধাত্রীকে স্বর্ণালংকারে সাজানো হয়। এই পরিবারে দেবী স্বয়ং বৈষ্ণবী হলেও তাঁর পুজো হয় তন্ত্রমতে। দেবীকে সম্পূর্ণ নিরামিষ ভোগ নিবেদন করা হয়। একমাত্র শক্তিমন্ত্রে দীক্ষিত বাড়ির মহিলারাই ভোগ রান্না করতে পারেন।
এই পরিবারের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হল সম্পূর্ণ গঙ্গাজলে ভোগ রান্না হয় এবং সৈন্ধবনুন ব্যবহৃত হয়। ভোগে থাকে ঘিভাত, খিচুড়ি, ভাজা, তরকারি, পায়েস, চাটনি ইত্যাদি। ভোগঘর থেকে দেবীর কাছে ভোগ নিয়ে যাওয়ার সময় অন্দরমহলের সমস্ত দরজা বন্ধ করে দেওয়া হয়। এই পরিবারে এখনও নরনারায়ণ সেবার ব্যবস্থা করা হয়। পুজোয় আখ, চালকুমড়ো এবং কলা বলি হয়। পূজার সময় ১০৮ দীপ প্রজ্জ্বলিত হয়।
পূজার আগের দিন চণ্ডীপাঠ হয় এবং সন্ধ্যায় দেবীর অধিবাস হয় এবং অধিবাস শেষে বাড়ির মহিলারা ঢাকিদেরও বরণ করেন যাকে ‘তালঠান্ডা’ বলা হয়। এই রীতি কেবলমাত্র নদিয়া জেলাতেই লক্ষ করা যায়।
দশমীর দিন সকাল থেকেই বাড়ির ছেলেরা রীতি অনুযায়ী আতশবাজি তৈরি করেন নিজের হাতে। দশমীর দিন পরিবারে ইলিশ মাছ খাওয়া হয়। ওই দিন কনকাঞ্জলি প্রথার মাধ্যমে দেবীকে বিদায় জানানো হয়। এখনও কাঁধে করে দেবীকে নিরঞ্জনের পথে নিয়ে যাওয়া হয়। দেবীকে বিসর্জনের সময় বাড়ির ছেলেদের তৈরি আতশবাজি পোড়ানো হয়। বিসর্জন শেষে বাড়ির দালানে জোড়া সত্যনারায়ণ পূজা হয় এবং পূজা শেষে শান্তিজল প্রদানের মাধ্যমে পূজার পরিসমাপ্তি ঘটে ব্রহ্মচারী বংশের।
এই ব্রহ্মচারী বংশের গৃহদেবী মা শীতলারও পূজা হয় দশমীর দিনে এবং নগরের দেবী মা সিদ্ধেশ্বরীরও পূজা হয় নৈবেদ্য সহযোগে।
কী ভাবে যাবেন
শিয়ালদহ থেকে ট্রেনে চলুন শান্তিপুর। স্টেশন থেকে ব্রহ্মচারীবাড়ি চলুন টোটোয় বা রিকশায়। কলকাতা থেকে শান্তিপুর বাসে বা গাড়িতেও যেতে পারেন। দূরত্ব ৯৪ কিমি।
আরও পড়তে পারেন
চলুন ঘুরে আসি রাজস্থান ২: জয়পুর-ফতেপুর-বিকানের-অজমের
চলুন ঘুরে আসি রাজস্থান ১: আগ্রা-ভরতপুর-দৌসা-জয়পুর-সরিস্কা-অলওয়র
হৈমন্তীপার্বণ: শঙ্খ নয়, হাওড়ার ভট্টাচার্যবাড়ির জগদ্ধাত্রীর বাঁ হাতে থাকে খড়্গ
হৈমন্তীপাবর্ণ: শিবপুরে যে বারোয়ারি জগদ্ধাত্রীপুজোর সূচনা হয়েছিল রায় চৌধুরীদের উঠোনে