হৈমন্তীপার্বণ: শঙ্খ নয়, হাওড়ার ভট্টাচার্যবাড়ির জগদ্ধাত্রীর বাঁ হাতে থাকে খড়্গ

শুভদীপ রায় চৌধুরী

দেখতে দেখতে জগদ্ধাত্রীপুজোও এসে গেল। সারা বছরের ক্লান্তি ভুলে উৎসবের দিনগুলিতে মানুষ সংসারের গণ্ডি থেকে বেরিয়ে আসে একটু আনন্দ উপভোগ করার জন্য। প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে ঠাকুর দেখার ভিড় উপচে পড়ে। একটি বার সবাই চায় মায়ের সেই জ্যোতির্ময়ী বিগ্রহকে সামনে থেকে দেখতে। হাওড়া শহরেও বেশ কিছু বনেদিবাড়ি রয়েছে যেখানে বহু কাল ধরে জগদ্ধাত্রীপুজো হয়ে আসছে।

হাওড়ার ভট্টাচার্যবাড়ির জগদ্ধাত্রীপুজো এ বার ২৫৮ বছরে পদার্পণ করল। এই পরিবারের ঐতিহ্য এবং বনেদিয়ানা যেন পলকে পলকে অনুভব করা যায় ঠাকুরদালানে দাঁড়ালেই।

কথিত আছে জগদ্ধাত্রী হলেন উমা হৈমবতী দুর্গা। তিনি আদি, তিনি অনন্ত, আর তিনি মহামায়ার সাত্ত্বিক রূপ। মহামায়ার রাজসিক গুণের প্রকাশ যদি হন দুর্গা, তা হলে সাত্ত্বিক রূপ এই জগদ্ধাত্রী। সাধকের মন যখন স্থির হয়, চঞ্চলতা কেটে গিয়ে মন আত্মভিমূখে গিয়ে দেবীর চরণে নিমগ্ন হয়, তখনই শ্রীশ্রীজগদ্ধাত্রী কৃপা করেন। তিনি ধারণী শক্তি। তিনি এ জগত ধরে আছেন, না ধরলে এ জগত পড়ে যাবে কালের অনন্ত কালে।

১৭৬৫ সালের কার্তিক মাসের শুক্লানবমীতে ত্রিপুরাসুন্দরী জগদ্ধাত্রী দেবীর আরাধনা শুরু হয় আন্দুলের বিখ্যাত ভট্টাচার্য বংশীয় গোপীমোহন ভট্টাচার্যের হাত ধরে বর্তমান হাওড়া শহরের মল্লিকফটকের বাড়িতে। গোপীমোহন সেই বছরেই তাঁর বংশের প্রাচীন কূলদেবী শ্রীশ্রীশঙ্করীদুর্গা (কালীযন্ত্রের আধারে) এবং পারিবারিক দুর্গাপূজা নিয়ে আসেন তাঁদের আন্দুলের বসতবাটী থেকে।

গোপীমোহনের পিতা আন্দুলের বিখ্যাত তন্ত্রসাধক ভৈরবীচরণ বিদ্যাসাগর তাঁর বসতগৃহে দুর্গাপূজা করতেন এবং তাঁর ইষ্টদেবী শঙ্করীকালীর সেবার্চনা করতেন। তাঁর শেষ বয়সে তিনি তাঁর সম্পত্তি দুই পুত্রের মধ্যে ভাগ করে দেন। বড়ো পুত্র জগমোহন বাচস্পতিকে শঙ্করীকালীর সেবা আর ছোটো পুত্র গোপীমোহনকে শঙ্করীদুর্গার সেবার দায়িত্ব দেন।

গোপীমোহন দুর্গাসেবার দায়িত্ব নিয়ে হাওড়ার মল্লিকফটকে তাঁদের দ্বিতীয় গৃহে আসেন এবং ঠাকুরদালান নির্মাণ করে পারিবারিক প্রাচীন দুর্গাপূজা চালিয়ে যান। কিন্তু শাস্ত্রমতে দুর্গাপূজার শেষে আরেক শক্তিপূজা করা আবশ্যক। কিন্তু কালীসাধক বংশীয় হয়েও গোপীমোহন কালীপূজা করলেন না কারণ তাঁদের বংশীয় প্রতিষ্ঠিত শঙ্করীকালী অবস্থান করছেন আন্দুলে তাঁর পিতার প্রতিষ্ঠিত কালীমন্দিরে, যা আজকের আন্দুলে দেবী সিদ্ধেশ্বরী শঙ্করীকালী মন্দির হিসাবে বিখ্যাত। কালীপূজার পরিবর্তে গোপীমোহন পিতৃ-আদেশ মেনে শ্রীশ্রীজগত্তারিণী জগদ্ধাত্রী দুর্গাপূজা শুরু করেন। সেই পূজাই তাঁর পুত্র রামনারায়ণ হতে সাত পুরুষ ধরে মল্লিকফটকের বাড়িতে হয়ে আসছে।

রামনারায়ণের পুত্র উমাচরণ তৎপুত্র বরদাচরণের এক মেয়ে অভয়াবালা দেবী। অভয়াবালা দেবী বৈবাহিক সূত্রে আবদ্ধ হন রমেশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে। পিতার অকাল প্রয়াণের পর দুর্গা এবং জগদ্ধাত্রীপূজার গুরু দায়িত্ব পড়ে অভয়াবালার উপরে। ওঁর চার পুত্র এবং তাঁদের পরিবার সেই দায়িত্ব পালন করে আসছে। অভয়াবালা দেবীর সেজো পুত্র ভুপেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়ের পরিবার ১৯৮৪ সাল থেকে জগদ্ধাত্রীপূজার মূল দায়িত্ব পালন করছেন।

জগদ্ধাত্রীপূজার আচার শুদ্ধ তান্ত্রিক আচার। এই বাড়িতে শুক্লানবমীতেই সপ্তমী, অষ্টমী এবং নবমীর পূজা হয়। মহাস্নানে ডাবের জল আবশ্যিক কারণ সেটি দক্ষিণাচারী তান্ত্রিক আচার। দেবীর বাঁ হাতে শঙ্খের জায়গায় থাকে খড়্গ। আগে পাঁঠাবলি হলেও ১৯৮৪ থেকে প্রাচীন হাঁড়িকাঠে চালকুমড়ো, বাতাবিলেবু এবং আখবলি হয়। নবমীপূজায় বলিদান এবং অষ্টমীতে ২৮টি দীপ দান হয়। মাকে মাছভোগ দেওয়া হয়ে থাকে এবং ‘নবান্ন’ নৈবেদ্য নিবেদিত হয়। ‘নবান্ন’য় জোড়া কড়াইশুঁটি, চাল আর নতুন নলেনগুড় হল আবশ্যিক।

সময় বদলেছে তার সঙ্গে বদলেছে আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি। খালি বদলায়নি মাতৃআবেগে ভরপুর হাওড়া তথা বাংলার এই প্রাচীন জগদ্ধাত্রীপুজো।

আরও পড়তে পারেন

রাজস্থানে উন্মোচিত হল বিশ্বের উচ্চতম শিবমূর্তি

হৈমন্তীপাবর্ণ: শিবপুরে যে বারোয়ারি জগদ্ধাত্রীপুজোর সূচনা হয়েছিল রায় চৌধুরীদের উঠোনে

চলুন ঘুরে আসি রাজস্থান ১: আগ্রা-ভরতপুর-দৌসা-জয়পুর-সরিস্কা-অলওয়র

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *