দুর্গাপার্বণ: শান্তিপুরের বড়ো গোস্বামীবাড়িতে প্রতিমার ১০টি হাতের মধ্যে দু’টি হাত বড়ো

নিজস্ব প্রতিনিধি: শান্তিপুরের প্রাচীন ঐতিহ্যের মধ্যে অন্যতম এই অঞ্চলের দুর্গাপুজো, যা বহু বছর ধরে হয়ে আসছে বিভিন্ন বনেদিবাড়িতে। বৈষ্ণব এবং শৈব ধারার পাশাপাশি এখানে শাক্তমতের আড়ম্বরও লক্ষ করা যায়, ধুমধাম করে পালিত হয় দুর্গাপুজো, কালীপুজো।

এই অঞ্চলের একটি প্রাচীন পরিবারে রাস উৎসবের পাশাপাশি সাড়ম্বর পালিত হয় দুর্গাপুজো। শান্তিপুরনাথ অদ্বৈতাচার্যের পুত্র বলরাম মিশ্রের পুত্র মথুরেশ গোস্বামীর প্রথম পুত্র রাঘবেন্দ্র গোস্বামী থেকেই বড়ো গোস্বামীবাড়ির সৃষ্টি। এই বাড়িতে আজও নিত্য পূজিত হন অদ্বৈতাচার্যের সেবিত শালগ্রামশিলা এবং আরও অনেক দেবদেবী।

বড়ো গোস্বামী বাড়ির পূর্বপুরুষ মথুরেশ গোস্বামী তাঁর পিতার কাছ থেকে শ্রীশ্রীরাধামদনমোহন, প্রভু সীতানাথ, সীতামাতা ও অচ্যুতানন্দের সেবাভার পেয়েছিলেন। মথুরেশ গোস্বামী বাংলাদেশের যশোহর থেকে এনেছিলেন শ্রীরাধারমণকে  এবং সেই বিগ্রহ সেবা পান শান্তিপুরের বড়ো গোস্বামীবাড়িতে।

এই রাধারমণ একবার বাড়ির মন্দির থেকে রহস্যজনক ভাবে উধাও হয়ে যান। সেই বিগ্রহ ফিরে পেতেই বাড়ির মহিলারা ব্রত রাখলেন দেবী কাত্যায়নীর। কারণ বৃন্দাবনে গোপীরা যেমন কাত্যায়নীব্রত করে লীলাপুরুষোত্তমকে পেয়েছিলেন ঠিক তাঁদেরও তেমন বিশ্বাস ছিল যে তাঁরাও তাঁদের রাধারমণকে ফিরে পাবেন দেবীর ব্রতপূজা করলে।

পুজোর সময় স্বপ্নাদেশে জানতে পারা গেল, বাড়ি থেকে কিছুটা দূরেই রয়েছেন রাধারমণ। তখন বড়ো গোস্বামীবাড়ির সদস্যরা তাঁকে নিয়ে আসেন। এ ভাবেই প্রায় সাড়ে তিনশো বছর আগে বড়ো গোস্বামীবাড়িতে শুরু হয় কাত্যায়নী তথা মা দুর্গার আরাধনা, যা আজও নিষ্ঠার সঙ্গে পালিত হয়ে আসছে।

প্রত্যেক বনেদিবাড়ির দুর্গাপ্রতিমায় যেমন কিছু বৈশিষ্ট্য থাকে, বড়ো গোস্বামীবাড়িও তার ব্যতিক্রম নয়। এই বাড়িতে দেবীর বাহন সিংহ ঘোটকাকৃতি। প্রতিমার দশটি হাতের মধ্যে দু’টি হাত বড়ো, আটটি হাত ছোটো। কার্তিক, গণেশ, লক্ষ্মী এবং সরস্বতী থাকে বিপরীত দিকে। দেবীর ডান দিকে থাকে কার্তিক ও লক্ষ্মী এবং বাঁ দিকে গণেশ ও সরস্বতী। এই পরিবারের পুজো হয় পূর্বপুরুষদের তৈরি করা বিশেষ পুথি দেখে এবং মহানবমীতে হয় বিশেষ প্রার্থনা।

এই বাড়িতে ভোগরান্না করেন বাড়ির দীক্ষিত মহিলারা। ভোগরান্নায় অন্য কারও অধিকার নেই। এই বাড়ির পুজোয় ৩৬ রকমের পদ দিয়ে ভোগ দেওয়া হয়। ভোগে থাকে সাদা ভাত, খিচুড়ি, নানা রকমের ভাজা, শুক্তানি, তরকারি, পোলাও, ধোঁকার তরকারি, ছানার ডালনা ইত্যাদি।

দশমীর দিন শান্তির জল দেওয়া হয়। সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকেন এলাকার মানুষেরাও। সব থেকে উল্লেখযোগ্য বিষয় হল এখানে মায়ের সকালবেলায় বিসর্জন হয়ে যায়। কারণ মা যতক্ষণ না বিসর্জিত হন ততক্ষণ বড়ো গোস্বামীবাড়ির ইষ্টদেবতা শ্রীশ্রীরাধারমণ জিউয়ের ভোগ রান্নার কাজ শুরু হয় না। মা চলে যাওয়ার পরেই তা শুরু হয়।

দশমীর দিন মায়ের বিসর্জনের আগেই রাসের খুঁটি পুঁতে রাস উৎসবের শুভ সূচনা হয়। এ ছাড়াও শ্রীশ্রীআগমেশ্বরী মায়ের পাটপুজো দেখে তার পর মা বিসর্জনে যান। বিসর্জনের পরে ঘাটে উপস্থিত প্রায় ৩০০-৪০০ জনকে মিষ্টিমুখ করানো হয়।

কী ভাবে যাবেন

শান্তিপুর যাওয়া কলকাতা থেকে খুবই সোজা। শিয়ালদহ থেকে প্রতি মুহূর্তে লোকাল ট্রেন রয়েছে। পুজোর কোনো এক দিন সকালে বেরিয়ে পড়ুন। বড়ো গোস্বামী বাড়ির পুজো দেখে আবার সন্ধ্যার মধ্যে ফিরে আসুন কলকাতায়।

আরও পড়তে পারেন

দুর্গাপার্বণ: চট্টোপাধ্যায়, মুখোপাধ্যায় ও চক্রবর্তী, পশ্চিম বর্ধমানের নবগ্রামে তিন শরিকের দুর্গাপুজো

দুর্গাপার্বণ: উখড়ার মুখোপাধ্যায় পরিবারের পুজোয় পাঁঠাবলির কাহিনি বেশ সুখশ্রাব্য

দুর্গাপার্বণ: ছয় হাজার ফুট উচ্চতায় ‘স্বর্গের পুজো’, চমক ঝান্ডিতে

দুর্গাপার্বণ: সিঙ্গি গ্রামের ভট্টাচার্য বংশের ৩৫০ বছরেরও বেশি পুরোনো ‘মঠের বাড়ির দুর্গোৎসব’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *