চোখধাঁধানো স্থাপত্যের প্রাসাদ: সিটি প্যালেস, জয়পুর  

City Palace, Jaipur

ভারতের অতীত ইতিহাস নানা দিক দিয়ে সমৃদ্ধ। এই দেশে এক সময় ছিল শত শত রাজারাজড়ার রাজত্ব। তারই ফলস্বরূপ দেশ জুড়ে গড়ে উঠেছে অসংখ্য প্রাসাদ। প্রতিটিরই কিছু না কিছু বিশেষত্ব আছে। বেশির ভাগ প্রাসাদই মিশ্র সংস্কৃতির নজির। বেশ কিছু প্রাসাদ রোমান স্থাপত্যশৈলীতে অনুপ্রাণিত। আবার বেশ কিছু প্রাসাদ ইসলামিক স্থাপত্যে প্রভাবিত। দেখে আসা যাক এ রকমই কিছু অনন্য প্রাসাদ। আজ চলুন রাজস্থানের জয়পুরে, দেখে নিন সিটি প্যালেস।

ইতিহাস

কাছোয়া রাজপুতদের বংশধর মহারাজা সোয়াই জয় সিং দ্বিতীয় ১৬৯৯ থেকে ১৭৪৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেছিলেন। তাঁর রাজধানী ছিল এখনকার জয়পুর শহর থেকে প্রায় ১৩ কিমি উত্তরে অম্বর তথা অমেরে। জনসংখ্যা ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকায় এবং একই সঙ্গে জলসংকট দেখা দেওয়ায় রাজধানী স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত নেন মহারাজা। সেই উদ্দেশ্যে তিনি জয়পুর গড়ার কাজ শুরু করেন এবং প্রাসাদ গড়ার কাজও চলতে থাকে। ১৭২৭ খ্রিস্টাব্দে অম্বর থেকে জয়পুরে রাজধানী সরিয়ে নিয়ে আসা হয়। সুতরাং সিটি প্যালসের জন্মসাল হিসাবে ১৭২৭-কেই ধরা হয়।

অম্বরে রাজ-কোষাগারের দায়িত্বে বঙ্গদেশের নৈহাটির মানুষ বিদ্যাধর ভট্টাচার্য। তিনি পরে মহারাজার মূল স্থপতি হন। জয়পুর শহর এবং সিটি প্যালেস-সহ শহরের বিভিন্ন স্থাপত্যের পরিকল্পনা এই বিদ্যাধর ভট্টাচার্যের।

সিপাহী বিদ্রোহের সময় তৎকালীন মহারাজা রাম সিং ব্রিটিশদের পাশে দাঁড়ান। তাঁরই আমলে শহরের সব কিছু স্থাপত্য গোলাপি (পিঙ্ক) রং করা হয়। প্রিন্স অব ওয়েলসের (পরবর্তী কালে রাজা সপ্তম এডোয়ার্ড) সফরের সময় এই রং-প্রকল্প রূপায়িত হয়। তখন থেকেই জয়পুর ‘পিঙ্ক সিটি’ নামে পরিচিত।

১৯৪৯-এ মহারাজা দ্বিতীয় মান সিং-এর সময় জয়পুর ভারতীয় ইউনিয়নে অন্তর্ভুক্ত হয়। সেই সময় থেকেই জয়পুর রাজস্থানের রাজধানী।

সিটি প্যালেসের ভিতরে।

সিটি প্যালেস

সিটি প্যালেস শহরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত। রাজস্থান, ইউরোপীয় এবং মুঘল স্থাপত্যশৈলীর মিশ্রণ ঘটেছে সিটি প্যালেসে। লাল এবং গোলাপি বেলেপাথরে তৈরি এই প্রাসাদ। বিশাল প্রাসাদচত্বরকে ঘিরে রয়েছে শিখরওয়ালা বেশ কিছু প্রাসাদ। এগুলিই আজ সংগ্রহশালায় পরিণত হয়েছে। এবং রাজপরিবারও আজ এই প্রাসাদেরই এক অংশে বাস করে।

সিটি প্যালেসের তিনটি গেট – ত্রিপোলিয়া গেট, বীরেন্দ্র পোল ও উদয় পোল। এর মধ্যে জনসাধারণ বীরেন্দ্র পোল ও উদয় পোল দিয়ে ঢুকতে পারেন। উদয় পোল দিয়ে ঢুকলে পৌঁছে যাওয়া যায় দেওয়ান-ই-আম-এ। দেওয়ান-ই-আম মানে জনদরবার। আর বীরেন্দ্র পোল দিয়ে আপনি চলে যাবেন মুবারক মহল চত্বরে। যেটি আবার রাজেন্দ্র পোলের মাধ্যমে যুক্ত হয়েছে ‘সর্বতো ভদ্র’ তথা দেওয়ান-ই-খাস-এ। দেওয়ান-ই-খাস অর্থাৎ রাজদরবার।

সিটি প্যালেসের ভিতরের চত্বরটির নাম প্রীতম নিবাস চক। এই চকে চারটি ছোটো গেট রয়েছে – পিকক গেট, লোটাস গেট, লহেরিয়া গেট এবং রোজ গেট।

সিটি প্যালেসের ভিতরে

মহারাজা সোয়াই মান সিং দ্বিতীয় মিউজিয়াম (MSMS II Museum)

সিটি প্যালেসের একাংশ নিয়ে গড়ে উঠেছে মহারাজা সোয়াই মান সিং দ্বিতীয় মিউজিয়াম। দেওয়ান-ই-আম, দেওয়ান-ই-আম, মুবারক মহল, বগ্গি খানা, সিলে খানা, পেন্টিং অ্যান্ড ফোটোগ্রাফি গ্যালারি, পোথিখানা নিয়ে এই মিউজিয়াম।

মুবারক মহলে রয়েছে টেক্সটাইল গ্যালারি। এখানে প্রদর্শিত হচ্ছে ঐতিহ্যশালী রাজকীয় পোশাকআশাক। রয়েছে মহারাজদের পোলো ও বিলিয়ার্ড খেলার পোশাক। শাল আর কার্পেটের বিশাল সম্ভার রয়েছে এখানে।

বগ্গি খানা হল ট্রান্সপোর্ট গ্যালারি। মধ্যযুগের বিভিন্ন যান প্রদর্শিত হচ্ছে এখানে – ঘোড়ার গাড়ি, পালকি, মিয়ানা, রথ, উটের গাড়ি ইত্যাদি।  

সিলে খানা হল অস্ত্রাগার। নানা ধরনের অস্ত্র প্রদর্শিত হচ্ছে এখানে।

পেন্টিং অ্যান্ড ফোটোগ্রাফি গ্যালারিতে আঠারো শতক থেকে বিশ শতকের মধ্যে আঁকা ও তোলা ছবি প্রদর্শিত হচ্ছে এখানে। এখানে ৩ হাজার আঁকা ছবি ও ৬০৫০টি আলোকচিত্র প্রদর্শিত হচ্ছে।

পোথিখানা অর্থাৎ পুথিখানায় রক্ষিত আছে হাতে লেখা ৭৮৬৬টি পুথি ও খসড়া। খসড়াগুলি সংস্কৃত, হিন্দি, রাজস্থানি, উর্দু এবং পার্সি ভাষায় লেখা। দেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ পুথিখানা এটি।

অন্যান্য দ্রষ্টব্য

চন্দ্র মহল – পিকক গেট দিয়ে ঢুকে সাততলা বিশিষ্ট চন্দ্র মহল। প্রাসাদচত্বরের পশ্চিমে অবস্থিত এই প্রাসাদ। এক একটা তলার এক একটা নাম – রঙ্গ মন্দির, সুখ নিবাস, মুকুট-মহল, পীতম নিবাস, শ্রী নিবাস, ছবি নিবাস ও শোভা নিবাস। এই চন্দ্র মহলই হল রাজপরিবারের আবাস। এর অনেকটা অংশেই সাধারণের প্রবেশ নেই। এখানে ঢুকতে হলে আলাদা টিকিট কাটতে হয় অথবা মিউজিয়াম ও চন্দ্র মহল দেখার জন্য কম্পোজিট টিকিট পাওয়া যায়।  

গোবিন্দজি মন্দির – প্রাসাদচত্বরেই রয়েছে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের মন্দির। জন্মাষ্টমীতে এই মন্দিরে বড়ো উৎসব হয়।      

বগ্গি খানা।

দর্শনের সময়

সকাল সাড়ে ৯টা থেকে বিকেল ৫টার মধ্যে প্রাসাদ তথা মিউজিয়াম দর্শন করা যায়। রাতেও সন্ধে ৭টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত খোলা থাকে।

দর্শনীর হার

প্রাসাদটি দু’টি ভাগে বিভক্ত – মিউজিয়াম এবং রাজপরিবারের আবাস। এ দু’টি দেখার জন্য আলাদা আলাদা টিকিট পাওয়া যায়, আবার কম্পোজিট টিকিটও পাওয়া যায়। আলাদা আলাদা করে টিকিট কাটলে ৫ থেকে ১২ বছর বয়স্কদের জন্য জনপ্রতি ১০০ টাকা করে এবং বয়স ১২-এর বেশি হলে ২০০ টাকা করে লাগে। আর কম্পোজিট টিকিটের হার ৫ থেকে ১২ বছর বয়স্কদের জন্য ২৫০ টাকা এবং বয়স ১২-এর বেশি হলে ৫০০ টাকা।

এ ছাড়াও চন্দ্র মহল ট্যুর রয়েছে। এখানে টিকিটের হার ৫ থেকে ১২ বছর বয়স্কদের জন্য ১০০০ টাকা এবং বয়স ১২-এর বেশি হলে ১৫০০ টাকা। আর একটি বিশেষ টিকিট আছে। এর নাম রয়্যাল স্প্লেন্ডার। এখানে টিকিটের হার ৫ থেকে ১২ বছর বয়স্কদের জন্য ১৫০০ টাকা এবং বয়স ১২-এর বেশি হলে ৩০০০ টাকা।         

কী ভাবে যাবেন

রাজস্থান ভ্রমণের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ জয়পুর ভ্রমণ। জয়পুর শহরের অন্যতম প্রধান দ্রষ্টব্য সিটি প্যালেস। ভারতের প্রায় সব বড়ো শহরের সঙ্গে ট্রেন ও বিমানপথে যুক্ত জয়পুর। ট্রেনের বিস্তারিত সময়ের জন্য দেখে নিন erail.in। জয়পুর স্টেশন থেকে সিটি প্যালেস ৪.৫ কিমি। উড়ানের সময় গুগুল সার্চ করলে পেয়ে যাবেন। এয়ারপোর্ট থেকে সিটি প্যালসের দূরত্ব ১২ কিমি।

আরও পড়তে পারেন

চোখধাঁধানো স্থাপত্যের প্রাসাদ: লক্ষ্মীবিলাস প্রাসাদ, বডোদরা

চোখধাঁধানো স্থাপত্যের প্রাসাদ: উজ্জয়ন্ত প্রাসাদ, আগরতলা

চোখধাঁধানো স্থাপত্যের প্রাসাদ: মাইসোর প্যালেস 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *