কলকাতায় ঠাকুর দেখা: চলুন বেহালা থেকে বেলেঘাটা

সেলিমপুর পল্লী।

আজকের রাত পোহালেই পঞ্চমী। শুরু হয়ে যাবে মহানগরে ঠাকুর দেখা। ভ্রমণ অনলাইন জানিয়ে দিল কিছু উল্লেখযোগ্য সর্বজনীন পুজোর থিম।

বেহালা নতুন দল

বেহালা নতুন দলের পুজো এ বছর ৫৭ বছরে পড়ল। এ বারের পুজোর থিম ‘আশ্রয়’। থিমশিল্পী অয়ন সাহা। এই থিমের ব্যাখ্যা দিলেন অন্যতম কর্মকর্তা সন্দীপন বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি জানান, চারিদিকে অশান্তি, হানাহানি, যুদ্ধ-বিগ্রহের পরিস্থিতি চলছে। এই পরিস্থিতিতে নিশ্চিত আশ্রয় হচ্ছে মায়ের আঁচল। মণ্ডপসজ্জায় কংক্রিটের টুকরো, কয়লা, কাচ ব্যবহার করা হয়েছে। প্রতিমা মাটির, তাতে শৈল্পিক ছোঁয়া।

বেহালা নতুন দলের প্রতিমা।

শিল্পী অয়ন সাহা জানান, করোনা অতিমারি ও যুদ্ধ জীবনকে টুকরো করে দিয়েছে। সেই টুকরো হয়ে যাওয়া জীবনকে একত্রিত করা হচ্ছে উৎসবের মাধ্যমে। ফেলে দেওয়া রাবিশ দিয়ে মণ্ডপ গড়া হয়েছে। আত্মপরিচয়কে পুনরায় আবিষ্কার করা বোঝাতে দর্পণ ব্যবহার করা হয়েছে। বাখারি আর কাপড় ব্যবহার করা হয়েছে। মা দুটো আঁচল ধরে আশ্রয়ের সন্ধান দিচ্ছেন। খোলা মণ্ডপ। প্রতিমার সাজসজ্জা ও গয়নায় লোহা ও টালি, ইট ব্যবহার করা হচ্ছে।

বড়িশা ক্লাব

বড়িশা ক্লাবের এ বারের নিবেদন ‘সাঁঝবাতি’। এই থিমের মাধ্যমে কী বোঝাতে চাওয়া হয়েছে তা পরিষ্কার বুঝিয়ে দিলেন ক্লাবের অন্যতম কর্মকর্তা অনিমেষ চক্রবর্তী।

বড়িশা ক্লাবের প্রতিমা।

তাঁর কথায়, “অমঙ্গলের কালো মেঘ আজ গ্রাস করেছে গোটা পৃথিবীকে। অতিমারির বিপন্নতার মাঝেই বেজে উঠেছে যুদ্ধের দামামা। চলছে প্রাণহানি ও সম্পদের বিনাশ। লোভ, হিংসা, মিথ্যা রেষারেষিতে জড়িয়ে মানুষ আজ বিবেকহীন। তাই এই চরম দুর্গতি থেকে মুক্তি পেতে আজ আমরা দেবী দুর্গার শরণাপন্ন। সংসারে সবার মঙ্গল কামনায় মা যেমন সন্ধ্যায় সাঁঝবাতি জ্বালিয়ে গৃহদেবতার কাছে প্রার্থনা জানান তেমনই হৃদয়ের পূর্ণ আকুতি দিয়ে মায়ের কাছে আমাদের প্রার্থনা পাপমুক্ত পৃথিবী।”

সমগ্র পরিকল্পনা ও সৃজনে শিল্পী রিন্টু দাস।

বেহালা ক্লাব সর্বজনীন

বেহালা ক্লাব সর্বজনীনের দুর্গোৎসব ৭৮ বছরে পড়ল। এ বছর তাদের নিবেদন ‘আব্বুলিশ’। সৃজনে অদিতি, প্রতিমাশিল্পী দীপেন মণ্ডল ও অদিতি, আবহ অর্পণ ঠাকুর চক্রবর্তী।

ক্লাবের অন্যতম কর্মকর্তা সায়ন্তন ভট্টাচার্য জানান, “আমরা আমাদের ছোটোবেলায় বাড়ির বড়োদের মিঠেকড়া শাসন এড়িয়ে স্কুল থেকে ফিরেই মাঠে খেলতে চলে যেতাম। প্রতিটি বিকেল ভরে উঠত কচিকাঁচাদের কলরবে। কিন্তু আজকের শিশুদের শৈশব বড্ড বেশি যান্ত্রিক, নিয়মের বেড়াজালে বন্দি। ওরা বাঁধা পড়েছে মা-বাবার ইচ্ছেপূরণের গণ্ডিতে। এই ভাবনাই ফুটিয়ে তোলা হয়েছে এই থিমে।”

অর্ধচন্দ্রাকার মণ্ডপ। ঝাড়গ্রাম থেকে আনা বিশেষ ধরনের ঘাস দিয়ে তৈরি হয়েছে মণ্ডপ। মণ্ডপের ভেতরে শিশুদের নানান মডেল রয়েছে। শিশুরা যেমন বাবা-মায়ের ইচ্ছার বোঝা টেনে চলেছে তা ফুটিয়ে তোলার জন্য মণ্ডপের বাইরে একটি ভ্যান। তাতে মা দুর্গা বসে। মা যেন সন্তানদের গল্প শোনাচ্ছেন এমন ভঙ্গিমায় বসে থাকা মা দুর্গার কোলে গণেশ ও কার্তিক। দু’পাশে লক্ষ্মী ও সরস্বতী দাঁড়িয়ে।

খিদিরপুর ২৫ পল্লীর প্রতিমা।

খিদিরপুর ২৫ পল্লী

৭৮তম বছরে খিদিরপুর ২৫ পল্লী ক্লাবের পুজোর এ বারের ভাবনা ‘নিরন্তর’। সৃষ্টিকর্তা ঈশ্বরের খোঁজে মানুষের জীবন কাটে। সে এক নিরন্তর যাত্রা। সেই নিরন্তর যাত্রাকে মণ্ডপে তুলে ধরেছেন দীপ দাস ও ঈশিকা চন্দ্র। প্রতিমাশিল্পী সৈকত বসু।

পুজোর অন্যতম কর্মকর্তা কালী সাহার কথায়, “মানুষের জীবন এক প্রবাহমান নদীর মতো। সময়ের হাত ধরে জীবননদীর দু’পাড়ে স্মৃতি ও অভিজ্ঞতার পলি জমা হতে থাকে। এর মধ্যে দিয়েই বয়ে চলে জীবননদী। চূড়ান্ত গন্তব্যে পৌঁছোনোই লক্ষ্য আমাদের প্রত্যেকের। এই যাত্রাপথে আমরা নিরন্তর খুঁজে চলেছি সৃষ্টিকর্তা ঈশ্বরকে।” 

খিদিরপুর পল্লী শারদীয়া

খিদিরপুর পল্লী শারদীয়ার এ বারের ভাবনা ‘ব্ল্যাকহোল’। কর্মকর্তা সুদীপ রায় জানান, “ব্রহ্মাণ্ডের মাঝে অপার বিস্ময় হল কৃষ্ণগহ্বর বা ব্ল্যাকহোল। রহস্যময় কৃষ্ণগহ্বরে লুকিয়ে আছে সৃষ্টির আদি রহস্য। সব কিছুকে মুহূর্তের মধ্যে গ্রাস করে নেয় সেই কৃষ্ণগহ্বরের মধ্যে বিরাজমান আদিশক্তি মহামায়া। আমাদের জীবনেও নৈরাশ্যের অন্ধকার কখনওসখনও চেতনাকে গ্রাস করতে চায়। অথচ আত্মশক্তির আলোয় সেই আঁধার দূর করা সম্ভব।

খিদিরপুর পল্লী শারদীয়ার শিল্পী বিশ্বনাথ দে। মণ্ডপসজ্জায় যন্ত্রপাতির ব্যবহার হয়েছে। প্রতিমা অফহোয়াইট রঙের।

রাজডাঙা নব উদয় সংঘ

গড়িয়াহাট মোড় থেকে ই এম বাইপাস যেতে কসবা কানেক্টরের কাছেই রাজডাঙা নব উদয় সংঘ। এ বার এই পুজো  দূষণরোধের বার্তা দিচ্ছে ‘অশনি সংকেত’ থিমের মাধ্যমে। শিল্পী মলয় শুভময়।

কর্মকর্তা সুশান্তকুমার ঘোষ জানান, প্রত্যেক বছর সমুদ্রে বিশাল পরিমাণে টন টন প্লাস্টিক জমা হচ্ছে। এটা গোটা বিশ্বের সামনে বিশাল এক সমস্যা। প্রায় ৮০০ প্রজাতির সামুদ্রিক প্রাণী ও জলজ উদ্ভিদ ধ্বংস হয়ে গেছে। মূলত প্লাস্টিক বন্ধ করার বার্তা দেওয়া হয়েছে। চট, বাঁশ, বাখারি, হোগলার মতো ইকো ফ্রেন্ডলি জিনিস দিয়ে তৈরি হচ্ছে মণ্ডপ। মাটির সাবেকি প্রতিমা।

সিংহী পার্ক

গড়িয়াহাট মোড়ের কাছে ডোভার লেনে সিংহী পার্কের পুজোর এ বার ৮১তম বছর। সিংহী পার্কের এ বারের ভাবনা ‘নারায়ণে নারায়ণী’।

পুজোর অন্যতম কর্মকর্তা অভিজিৎ মজুমদার জানালেন, “এ বছর তাঁরা থিমের মাধ্যমে কার্টুনিস্ট নারায়ণ দেবনাথকে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন। থিমের নাম ‘নারায়ণে নারায়ণী’। নারায়ণ দেবনাথের অসাধারণ সব কার্টুনচরিত্র হাঁদা-ভোঁদা, বাঁটুল দি গ্রেট, নন্টে-ফন্টে ইত্যাদি দিয়ে মণ্ডপসজ্জা হয়েছে।”

চন্দননগরের লাইটের মাধ্যমে কার্টুনচরিত্রগুলো তুলে ধরা হয়েছে। সাবেকি একচালা প্রতিমা গড়েছেন প্রদীপরুদ্র পাল। মণ্ডপ পরিকল্পনা মিঠুন দত্তের।

হাজরা পার্ক

দক্ষিণ কলকাতার হাজরা মোড়ে হাজরা পার্ক। এই দুর্গোৎসবের ৮০তম বছরের থিম ‘তাণ্ডব’।

পুজোর অন্যতম কর্মকর্তা সায়নদেব চট্টোপাধ্যায় জানান, সমুদ্রের ঢেউ যেমন প্রতিনিয়ত ধাক্কা খায় বালির চরে, তেমনই মানুষের জীবনও নিয়ত ভাঙাগড়ার পাকেচক্রে আটকে রয়েছে। হিন্দুশাস্ত্রে বর্ণিত তাণ্ডব এমনই এক বৈজ্ঞানিক সত্য, মহাবিশ্বের নিরন্তর প্রক্রিয়া যা অনবরত ঘটে চলেছে দৃষ্টির অগোচরে আর আমরা তা জানছি ঐশ্বরিক প্রেক্ষিতে।”

হাজরা পার্ক দুর্গোৎসবের থিমশিল্পী কৃশানু পাল, আলোকশিল্পী আশিস সাহা, আবহ আশু চক্রবর্তীর।

শিবমন্দির সর্বজনীনের প্রতিমা।

শিবমন্দির সর্বজনীন

দক্ষিণ কলকাতার লেক অঞ্চলে শিবমন্দির সর্বজনীন দুর্গোৎসব সমিতির পুজো। এদের পুজোর এ বার ৮৬তম বছর। পুজোর থিম ‘বিশ্বাস’।

অন্যতম কর্মকর্তা পার্থ ঘোষের কথায়, “আমরা ভাবি, তাঁর কৃপাতেই বিনাশ হবে সমাজের অসুর। বিশ্বাসে মিলায় বস্তু তর্কে বহু দূর। দেবদূতের নিবেদনে সমর্পণের সুর। বিশ্বাসে মিলায় বস্তু তর্কে বহু দূর।”

প্রতিমা গড়েছেন দীপেন মণ্ডল, আলো প্রেমেন্দুবিকাশ চাকীর, আলোর সহযোগী সুশান্ত হালদার। গ্রন্থনায় রয়েছেন দেবদূত ঘোষঠাকুর আর সৃজনে সৌরজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়।

সেলিমপুর পল্লীর প্রতিমা।

সেলিমপুর পল্লী

ঢাকুরিয়ার সেলিমপুর পল্লীর এ বারের থিম ‘বন্ধন’। কর্মকর্তা পার্থ রায় জানান, মানুষের মধ্যে আত্মিক যোগাযোগ এখন কমে গেছে। বিষয় ভাবনা তুলে ধরা হচ্ছে মণ্ডপে। শৈল্পিক ভাবনার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে প্রতিমা হচ্ছে। ভাবনা অনির্বাণ দাস, প্রতিমা গড়ছেন নব পাল।

ট্যাংরা ঘোলপাড়া সর্বজনীন

পূর্ব কলকাতার ট্যাংরা অঞ্চলের পুজো ট্যাংরা ঘোলপাড়া সর্বজনীন দুর্গোৎসব। এ বছর এদের নিবেদন ‘সৃষ্টির জন্যই ধ্বংস’।

থিমের ব্যাখ্যা দিলেন পুজোর কর্মকর্তা সমীর ঘোষ। তিনি বলেন, “পুরাণমতে দেবাদিদেব মহাদেব হলেন সয়ম্ভূ। একাধারে সৃষ্টিকারী অন্য দিকে বিনাশকারী হলেন শিব। মণ্ডপের ঢোকার মুখে দ্বিখণ্ডিত পৃথিবীর মাঝে শিবের তাণ্ডবনৃত্য ও ধ্বংসের ছবি ফুটে উঠছে।”

মূলমণ্ডপে রয়েছে শঙ্খশোভিত শিবলিঙ্গ। থিমশিল্পী কমলেশ সেনগুপ্ত, প্রতিমাশিল্পী পরিমল পাল।

বেলেঘাটা ৩৩ পল্লী

বেলেঘাটা ৩৩ পল্লীর ২২ বছরের নিবেদন ‘চুপকথা’। কর্মকর্তা পরিমল দে কাব্য করে বললেন, “দেখুন দেখুন সবই দেখুন/চোখ দুখানি খুলে। বললে কথা বিপদ ভারী, চড়িয়ে দেবে শূলে। অনেক কথা যায় না শোনা ফিসফিসিয়ে বলা/যদি তুমি চেঁচিয়ে ওঠো ধরবে টিপে গলা। যেই না তুমি রোলার দিয়ে গুঁড়িয়ে দিলে সব-/আমরা সে শব টানিয়ে দিয়ে সাজাবো উৎসব। /মুখে কোনও রা করি না/বুকে রাখি তেজ।/চুপের ওজন বড্ড বেশি/নাড়িও না লেজ।/খেলতে পারি খেলাতে পারি উঁচু থেকে নীচু, মুখে এবার আঙুল রেখে বলব না আর কিছু /বাকিরা সব বলুক কথা আমরা এবার চুপ।/ কুলুপ এঁটে দেখতে এসো চুপকথাদের রূপ।’

কাঁকুড়গাছি মিতালি সংঘ

পূর্ব কলকাতার কাঁকুড়গাছি মিতালি সংঘের ৮৬তম বছরের পুজোর থিম ‘দুর্গোৎসব’। কর্মকর্তা নীলকমল পাল জানান, কাঠামোপুজো থেকে বিসর্জন, দুর্গাপুজোর প্রতিটি আচার-অনুষ্ঠান পটচিত্রের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে। মণ্ডপে ঢোকার মুখে রয়েছে কাঠের বাক্সের তৈরি ২টি তোরণ, তার মধ্যে খড়ের তৈরি একটি দেবীমূর্তি।

শিল্পী সন্দীপ মুখোপাধ্যায় দুর্গাপুজোর আভিজাত্য ও জৌলুসের বার্তা পৌঁছে দিতে প্রচুর শঙ্খ ও ঘণ্টার ব্যবহার করছেন। সনাতনী ডাকের সাজের প্রতিমা।

ছবি: রাজীব বসু

আরও পড়তে পারেন

কলকাতায় ঠাকুর দেখা: ঢাকুরিয়ার শহিদনগর সর্বজনীনের পুজোয় সম্মানিত হচ্ছেন অনামা শিল্পীরা

দুর্গাপার্বণ: বলিদানের প্রথাই নেই চুঁচুড়ার বড়ো শীলবাড়ির দুর্গাপুজোয়

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *