নিজস্ব প্রতিনিধি: আনুমানিক দশম শতক। উত্তরপ্রদেশের অযোধ্যার রামগড় অঞ্চলের বণিক কুলপতি সনক আঢ্য তাঁর অনুগত ষোলোটি বণিক পরিবারকে সঙ্গে নিয়ে বঙ্গে এসেছিলেন। বঙ্গে তখন মহারাজা আদিশূরের রাজত্ব চলছে। ষোলোটি বণিক পরিবারের অনুগত ৩০ জন বণিক অযোধ্যা থেকে অবিভক্ত বঙ্গের (অধুনা বাংলাদেশ) বিক্রমপুর হয়ে বর্ধমানের উজানিনগরে এসেছিলেন। সেই বণিক পরিবারের মধ্যে শীল বংশের পূর্বপুরুষও ছিলেন।
শীল বংশের সন্তান যাদব শীল সম্ভবত সুলতানি শাসকদের সঙ্গে বাণিজ্যে যুক্ত ছিলেন এবং লাভ করেছিলেন ‘মল্লিক’ উপাধি। কিন্তু পারিবারিক বিবাদের কারণে পরিবার ভাগ হয়ে যায়। যাদব শীলের বংশধরেরা সপ্তগ্রামেই থেকে যান এবং চৈতন্য শীলের পরিবার বর্ধমানের পাঁচড়া গ্রামেই বসবাস করতে থাকেন।
এর কিছু কাল পরে অর্থাৎ ১৭৪১ সাল থেকে বাংলা জুড়ে শুরু হয় বর্গীদের তাণ্ডব। সেই আক্রমণের হাত থেকে বাঁচার জন্য শীল পরিবারের সদস্যরা সে বছরই বর্ধমান ত্যাগ করে ব্যান্ডেলের কাছে শাহগঞ্জে বসবাস শুরু করেন। শীল পরিবারের সদস্যরা ১৭৫৭ সাল অবধি সেখানেই বসবাস করেন।
শুধুমাত্র বর্গীদের আক্রমণই নয়, শুরু হয় ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে নবাব সিরাজের বিবাদ-পর্ব, যেখানে ব্রিটিশ জেনারেল রবার্ট ক্লাইভের সেনাদল চন্দননগর, হুগলি, ব্যান্ডেল অঞ্চলে লুটপাট চালায়। তার ফলে শাহগঞ্জ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই অবস্থায় নীলাম্বর শীল, যিনি পাঁচড়া গ্রামেই জন্মগ্রহণ করেছিলেন, চলে আসেন চুঁচুড়ার কনকশালিতে ১৭৫৮ সালে। কনকশালিতে বসবাস করার পর ১৭৬৩ সালে বর্তমান বড়ো শীলবাড়ি স্থাপিত হয়।
নীলাম্বর শীলের তৈরি করা বাড়িটিতে ইন্দো-ডাচ স্থাপত্যশৈলীর প্রভাব দেখা যায় এবং বাড়ির কেন্দ্রস্থলে রয়েছে এক অপূর্ব ঠাকুরদালান যা তৈরি করেছিলেন নীলাম্বর শীলের পুত্র মদনমোহন শীল ১৮০৩ সালে। এই ঠাকুরদালানেই রমরমা করে পুজো হয়ে আসছে দেবী দুর্গার।
এই বাড়ির দেবী কিন্তু দশভূজা নন, তিনি শিবনন্দিনী অর্থাৎ শিবের ক্রোড়ে বসে আছেন তিনি। তাঁর দুই হাত, এক হাতে তিনি বরদাত্রী এবং অন্য হাতে তিনি অভয়দায়িনী। একচালার প্রতিমায় সপরিবার হরগৌরী বসে থাকেন শীলবাড়ির ঠাকুরদালানে। প্রতিমা ডাকের সাজের হয় এবং চালচিত্রে দুর্গার বিভিন্ন রূপ অঙ্কিত থাকে।
ষষ্ঠীতিথিতে বোধন হয় মায়ের, সপ্তমীর দিন কলাবউকে স্নান করানো হয় এবং তার পর দেবীর চক্ষুদান ও মূলপূজা শুরু হয়। এই বাড়িতে চালের নৈবেদ্য, চিনির নৈবেদ্যর সঙ্গে থাকে নানা রকমের মিষ্টান্ন, ফল ইত্যাদি। আগে ভিয়েন বসিয়ে হরেক রকম মিষ্টি তৈরি করা হত। এখনও বাড়িতে মিষ্টি তৈরি হয় তবে পরিমাণে কম।
এই বাড়িতে পুজোর সময় ধুনো পোড়ানোর রীতি রয়েছে এবং মহাষষ্ঠীর দিন সন্ধিপূজায় ১০৮টি পদ্ম নিবেদন করে ১০৮টি দীপ জ্বালানো হয়। দশমীর দিন সকালে চিঁড়েভোগ হয় এবং সন্ধ্যায় দেবীবরণের পর সিঁদুরখেলা ও তার পর বিসর্জনের পথে রওনা।
বিসর্জন থেকে ফিরে এসে পরিবারের সদস্যা সকলে মিলে ঠাকুরদালানে শান্তির জল নেন এবং কুলদেবতার ঘরে গিয়ে তাঁকে প্রণাম করেন। চুঁচুড়ায় বড়ো শীলবাড়ির ঠাকুরদালানে গেলে অনুভূত হয় এই পরিবারের পুজো কেন এত বিখ্যাত এবং এই পরিবারের ঐতিহ্য কতটা প্রাচীন।
আরও পড়তে পারেন
তাজ মহলের ৫০০ মিটারের মধ্যে ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড চলবে না, জানাল সুপ্রিম কোর্ট
কলকাতায় ঠাকুর দেখা: ঢাকুরিয়ার শহিদনগর সর্বজনীনের পুজোয় সম্মানিত হচ্ছেন অনামা শিল্পীরা