
কথা চলছে, উনিও রঙের ব্রাশ চালিয়ে যাচ্ছেন। জিজ্ঞাসা করলাম, আপনার নাম তো সেবাস্টিয়ান প্রধান। আপনি কোন ধর্মের মানুষ?
মৃদু হেসে বললেন, আমি হিন্দু, আমি বৌদ্ধ আবার আমি খ্রিস্টান
– মানে?
– আমি ছিলাম খ্রিস্টান। পরে বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করি, বহু দিন এই ধর্মে থেকেও মনের শান্তি পাইনি। অবশেষে হিন্দুধর্মের প্রতি আকর্ষণ অনুভব করি। বুঝতে পারি এখানেই আমার শিব লাভ হবে। এখানেই পাব শান্তি। তাই আবার ধর্ম পরিবর্তন করে হিন্দু হলাম।
– শান্তি পেয়েছেন? পেয়েছেন ঈশ্বর?
– হ্যাঁ, আমি ঈশ্বর লাভ করেছি। আমি তাঁর দর্শনও পেয়েছি।
কথাটা শুনে চমকে উঠলাম। ঈশ্বর পাওয়া কি এত সোজা? বছরের পর বছর সাধনা করেও সাধু-সন্তরা ঈশ্বরের দেখা পান না। ইনি তো গৃহী মানুষ। কিন্তু তাঁকে অবিশ্বাস করতেও ইচ্ছা হচ্ছে না। বিশ্বাস-অবিশ্বাসের মাঝে দাঁড়িয়ে আছি। মনের মধ্যে অনেক প্রশ্ন ঘুরছে। জিজ্ঞাসা করব, কিন্তু অরূপদা আমার নাম ধরে হাঁকডাক জুড়ে দিয়েছে। “আবার পরে কথা বলবো” বলে চলে এলাম।
আরও পড়ুন রহস্যময় রেশম পথ / পর্ব ৪ : রিশিখোলায় জলকেলি
অরূপদার হাওয়াই চপ্পলও ওই ফেলে আসা ব্যাগে রয়ে গিয়েছে। একটা চপ্পল কেনার জন্য সে ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। খবর নিয়ে জানলাম সামনে বাজার বলতে হেঁটে ২ কিমি যেতে হবে পাকা রাস্তায়। হেঁটে গিয়ে চপ্পল কিনে ফিরে আসতে আসতে আজকের দিনটার বারোটা বেজে যাবে। রিসর্টের কেউ বাজার যাবে কিনা খবর নিলাম। জানলাম ওরা আজ সকালেই বাজার করে এনেছে। আবার কাল।
অরূপদার সঙ্গে কথা বলে বিকেলের প্রোগ্রাম, সন্ধের ক্যাম্পফায়ার ইত্যাদির ব্যবস্থা করে ফেললাম। ক্যাম্পফায়ার হবে, হবে মাংসের বার্বিকিউ। রিসর্ট সব ব্যবস্থা করে দেবে।

এ বার সবাই মিলে একটু পদচারণা করতে বেরোলাম। অরূপদাকে আমার হাওয়াই চটিটা দিয়ে আমি খালি পায়ে চললাম। রিশিখোলা নদীর ধার ধরে পাথরের উপর দিয়ে হাঁটছি। নির্জন পরিবেশে নদীর ছলাত ছলাত শব্দ একটা অন্য রকম আবহ সৃষ্টি করেছে। মাঝেমাঝে ছোটো ছোটো দু’-একটা পাখি ইতিউতি উড়ে যাচ্ছে। নদীর দু’ পাশে জঙ্গল। মাথার উপর নীল আকাশ। নদীর বুকে নীল-সবুজের প্রতিফলনের মাঝে ছিটকে-ওঠা জলের আলপনা দেখতে দেখতে কখন যেন হারিয়ে গিয়েছি। পিছন ফিরে দেখি আমার সঙ্গে শুধু রূপ, এই জঙ্গুলে পরিবেশে হরিণশিশুর মতোই লাফাতে লাফাতে চলেছে। বাকিরা পাথরের উপর হাঁটতে না পেরে রণে ভঙ্গ দিয়ে একটা বড়ো পাথরে বসে পড়েছে।
আমরা বাপ-বেটা প্রকৃতিকে গায়ে মেখে তার না-বলা কথা শুনতে শুনতে আরও এগিয়ে চললাম। মাঝে মাঝে দাঁড়িয়ে পড়ে বিভিন্ন পাথরের গায়ে রঙের আলপনা দেখছি। আজ যেখানে হিমালয় পর্বত এক সময় এখানেই ছিল টেথিস সাগর। সমুদ্রগর্ভে একের পর পলি জমে জমে এ পাথরের সৃষ্টি। পাথরগুলি ভালো করে দেখলে পলির স্তরগুলো পরিষ্কার বোঝা যায়।

অনেকটাই চলে এসেছি। আলো কমতে শুরু করেছে। এ বার ফেরা যে পথে এসেছিলাম। ২০০০ ফুট উচ্চতায় এই রিশিখোলা আর কিছু দিন পর আর এত শান্ত থাকবে না। নদীর ধার দিয়ে রাস্তা তৈরি হচ্ছে। বছর খানেক পরেই রিশিখোলার গায়ে লাগবে কৃত্রিমতার ছোঁয়া।
নদীর ধার থেকে একটা রাস্তা উপর দিকে উঠে গিয়েছে। সেই রাস্তায় এ বার পাড়ি জমালাম। জংলা পথ। খালি পায়ে হাঁটতে একটু ভয় লাগলেও এগিয়ে চললাম সাবধানে। কিছুটা গিয়েই একটা হোমস্টে। পুরো জঙ্গলের মধ্যেই বলা যায়। আরও একটু এগিয়ে গেলাম। খচমচ আওয়াজ শুনে পিছন ঘুরে দেখি একটা ১২/১৩ বছরের ছেলে আসছে। এখানে তো সর্বমোট ৩টে হোমস্টে দেখলাম। তার মধ্যে একটায় আমরা আছি। এই জঙ্গলে স্থানীয় মানুষের বসতিও নেই। তা হলে ছেলেটা কোথা থেকে এলো?
কিছু বলার আগেই ছেলেটি আমায় হিন্দিতে প্রশ্ন করল – এ দিকে কোথায় যাচ্ছেন?
– এই একটু ঘুরে দেখছি। আচ্ছা এই রাস্তা কোথায় গেছে?
– মেন রোডে।
– এখান থেকে কত দূর?
– আমার যেতে ১৫/২০ মিনিট লাগবে। আপনাদের অভ্যাস নেই, আধ ঘণ্টা লেগে যাবে।

এইটুকু ছেলে এত হিসাব জানে! ছেলেটা আমায় ছেড়ে হন হন করে এগিয়ে গেল। জঙ্গলের মেঠোপথে গাছপালার আড়ালে চলে গেল। আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তার চলে যাওয়া দেখলাম। জঙ্গলের ভিতর দিয়ে আলোআঁধারি ফুঁড়ে ছেলেটা কতটা পথ পাড়ি দেবে কী জানি! ছেলেটা কোথা থেকে এল, সেটাও তো জানা হল না।
ফিরে এলাম হোমস্টের সামনে। সুর্যদেব সামনের পাহাড়ের আড়ালে গা ঢাকা দিয়েছেন অনেকক্ষণ। চার পাশে এখনও বেশ আলো, তবে কিছুক্ষণের মধ্যেই অন্ধকারে ডুব দেবে রিশিখোলা। হোমস্টে থেকে ৫০ টাকা দিয়ে ছিপ ভাড়া করে কয়েক জন নদী থেকে বরোলি মাছ ধরছেন। মৌরলা মাছের মতো ছোটো ছোটো মাছ।
একজনকে জিজ্ঞাসা করলাম, “মাছ উঠছে?”
তিনি হাসিমুখে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “ওই উঠছে আর কী।”
– কতগুলো ধরলেন?

ভদ্রলোক একটা ছোটো বালতি তুলে দেখালেন। তাতে ১০/১২টা মাছ আছে। বুঝলাম ৫০ টাকা খরচ করে এঁরা আনন্দ কিনছেন। যাঁদের ছিপ ফেলার নেশা আছে তাঁরা লাভ-ক্ষতির হিসাব জানেন না। এই আনন্দ সবাই বোঝে না, বোঝানোও সম্ভব নয়। মনে আছে ছোটোবেলায় পাড়ার একজনের পুকুরে ছিপ ফেলতে গিয়েছিলাম। সেটাই ছিল জীবনে প্রথম বার ছিপ ফেলা। অপটু হাতে দু’টো তেলাপিয়াও ধরেছিলাম। কিন্তু বাড়িতে আমার এই সাফল্যের কেউ মূল্য দিল না। বাবা এমন মার মারল যে সে দিনই জীবনের শেষ ছিপ ফেলা হয়ে গেল আমার।
ঘরের সামনে বারান্দার মতো কিছুটা জায়গা। সেটা আসলে চলাচলের রাস্তা। সেখানে চেয়ার পেতে মৌসুমী, অরূপদা, বৌদি বসে আছে। এখান থেকে নদী-সহ সামনের নিসর্গ বড়ো সুন্দর লাগে। এমন নিসর্গ দেখতে দেখতে চা খাওয়ার সুযোগ কদাচিৎ পাওয়া যায়।
আঁধার নেমেছে। হালকা মেঘলা আকাশ। কোনো তারা দেখা না গেলেও হালকা একটা আলো-আলো ভাব। ক্যাম্পফায়ারের আগুন জ্বলা শুরু হয়েছে এ-দিকে ও-দিকে। আমাদের এখনও শুরু হয়নি। মিস্টার প্রধানের ছোটো মেয়ের কাছে খোঁজখবর নিতে গেলাম। ক্যাম্পফায়ারের ব্যাপারটা সে-ই দেখে। সে জানাল, কাঠ সাজানো আছে। আমাদের যথাস্থানে বসতে বলল।
ঠিক সাড়ে ৮টা। আমাদের ক্যাম্পফায়ারের আগুন জ্বলে উঠল। গান-বাজনার ব্যবস্থা নেই। নিজেরাই হুল্লোড় করছি। আমাদের পাশে কয়েকটি ছেলেমেয়ে ক্যাম্পফায়ারে মদের ঝরনাধারা বইয়ে দিয়েছে। আমরা হাঁ করে ওদের বিচিত্র কাণ্ডকারখানা দেখছি। এমন সময় দেখি, মিস্টার প্রধানের ছোটো মেয়ে আসছে, সঙ্গে হুঁকো টানতে টানতে আসছে ১২/১৩ বছরের এক কিশোর। অর্থাৎ হুঁকোর আগুনটা ভালো করে ধরানোর জন্য বাচ্চাটাকে দিয়ে টানানো হচ্ছে। দৃশ্যটা দেখে থাকতে না পেরে তীব্র প্রতিবাদ করলাম। কিন্তু আমার কথার কোনো জবাব না দিয়ে তারা চলে গেল।
এখানে এসে অব্দি দেখতে পাচ্ছি শৈশবকে জাঁতায় পেশা হচ্ছে প্রতি মুহূর্তে। এ সব দেখে মিস্টার প্রধানের প্রতি শ্রদ্ধা ও অশ্রদ্ধা দু’দিকের পাল্লাই সমান হয়ে উঠেছে আমার মনে। এ সব এখানে দেখার প্রত্যাশা আমি করিনি।
৫০০ গ্রাম মুরগির মাংসের বার্বিকিউ করা হয়েছিল। দু-এক পিস করে খেয়ে ক্যাম্পফায়ারে ইতি টানলাম টেনে দিলাম। সাড়ে ৯টা বাজে। আমাদের পাশের ছেলেমেয়েগুলো তখনও জঠরে তরল ঢেলে চলেছে। কথা জড়িয়ে গিয়েছে কিন্তু হাত সাবলীল। মদবিহীন আমাদের ক্যাম্পফায়ার নেহাত মন্দ হয়নি। আজকের এই সন্ধ্যা আমাদের বহু দিন মনে থাকবে।
কাল সকালে এখান থেকে চলে যাব। কিন্তু এই একটা দিন আমাদের যেন অনেক কিছু দিয়ে গেল। জীবনে আর কখনও এখানে আসব কিনা জানি না তবে ভবিষ্যতে রিশিখোলার কী হাল হতে চলেছে সেটা অনুমান করে আজ আমরা গর্ব করতেই পারি। কারণ আমরা যা দেখলাম আগামী দিনে রিশিখোলার এই রূপ আর কেউ দেখবে না। (চলবে)
ছবি লেখক