
আমাদের গাড়ির আগে আগে একটা ট্রেকার যাচ্ছিল। ট্রেকারে স্কুলের ছাত্রছাত্রী। বাড়ি ফিরছে। আমরা ওদের দেখছি, ওরাও আমাদের দেখছে। এই ভাবে বেশ কিছুটা যাওয়ার পর ট্রেকারটা থেমে গেল। গাড়ি থেকে কয়েক জন নেমে হাত নেড়ে আমাদের বিদায় জানাল। আমাদের গাড়িটাও এগিয়ে চলল রিশিখোলার দিকে। পথের নিসর্গের কোনো তুলনা নেই।
নেপালি ভাষায় খোলা শব্দের অর্থ ছোটো নদী। রিশিখোলার অর্থ রিশি নদী। রিশি নদীকে কেন্দ্র করে রিশিখোলায় গড়ে উঠেছে পর্যটনকেন্দ্র। রিশি নদীর এক পারে পশ্চিমবঙ্গ এবং অন্য পারে সিকিম। মাঝে সেতু। সেতুর এ প্রান্তে পশ্চিমবঙ্গ, অপর প্রান্তে সিকিম। পর্যটকরা যে কোনো দিকেই থাকতে পারেন। দু’দিকেই হোম স্টে আছে।

আমরা পশ্চিমবঙ্গের দিক থেকে আসছি তাই আমাদের গাড়ি সেতুর উপর দাঁড়িয়ে গেল। ও পারেই সিকিম পুলিশের চৌকি। সেখানে আমাদের পরিচয়পত্র জমা দিতে হবে। সিকিম ছাড়া ভারতের যে সব রাজ্যে আমি গিয়েছি, সে সব রাজ্যে প্রবেশের জন্য কোথাও পরিচয়পত্র দেখাতে হয়নি বা তার কপি জমা দিতে হয়নি। এমনকি কাশ্মীরেও না।
ব্রিজের নীচে দিয়ে রিশি নদী বয়ে চলেছে কুলকুল করে। ব্রিজের ঠিক পরেই নদী দু’ ভাগ হয়ে দু’ দিকে বয়ে গিয়েছে সরু ধারায়। সুরজ কাগজপত্র জমা দিতে গিয়েছে, আমরা ফোটো তুলতে লেগে গিয়েছি হইহই করে। কিছুক্ষণ পর সুরজ ফিরল, আমরা আবার রওনা হলাম। গাড়ি এ বার কাঁচা পাকদণ্ডী ধরে নীচে নামা শুরু করল। মাটি কেটে রাস্তা চওড়া করা হয়েছে। পথের ধারে যন্ত্রপাতি, খোয়া প্রভৃতি দেখে বুঝলাম এ রাস্তা পাকা করার তোড়জোড় চলছে। অর্থাৎ শান্ত, নিরিবিলি রিশিখোলাকে আমরা হারাতে চলেছি।

গাড়ি এক সময় নদীর পাশে চলে এল। নদীর বাঁ দিক দিয়ে কিছুটা চলার পর আমাদের অবাক করে দিয়ে গাড়িটা ঝপাং করে জলে নেমে পড়ল। শুধু তা-ই নয়, নদী পেরিয়ে সোজা ও পারেও চলে এল! অর্থাৎ আমরা আবার পশ্চিমবঙ্গে।
গাড়ি এসে থামল রিশি ইকোট্যুরিজম রিসর্টে, যার মালিক সেবাস্টিয়ান প্রধান। এখানেই আমরা থাকব। এটা নামেই হোমস্টে। আসলে এটা লজই বলা যায়। ৬/৭ জন কর্মচারী এখানে কাজ করেন। গাড়ি থেকে নামতেই দু’জন এগিয়ে এসে আমাদের মালপত্র তুলে নিল। দু’টো ঘর বুক করা ছিল। তাঁরা ঘর দেখিয়ে দিয়ে গেলেন। ইতিমধ্যে আবিষ্কার হল মৌমিতা বৌদি তাঁর ভিজে পোশাক ভর্তি প্লাস্টিকের ব্যাগটা রামধুরায় ফেলে এসেছেন।
আরও পড়ুন রহস্যময় রেশম পথ / পর্ব ৩ : ইচ্ছে গাঁও ছুঁয়ে সিলারি গাঁওয়ে এক ঝলক
মনটা আনচান করছে নদীতে নামার জন্য। ব্যাগকাণ্ডে বৌদির মন খারাপ, অরূপদার সাথে একপ্রস্থ কথা কাটাকাটিও হয়েছে। অরূপদা বা বৌদি নদীতে যেতে চাইল না। অগত্যা আমরাই নদীতে নামলাম। কোথাও গোড়ালি ডোবা জল আবার কোথাও একটু বেশি। হাঁটু পর্যন্ত জল কোথাও নেই। এক জায়গায় পাথর সরিয়ে কোমরসমান গভীরতা তৈরি করে রাখা হয়েছে স্নানের জন্য।

ছোটো ছোটো পাথরবিছানো বিছানার উপর দিয়ে কুলকুল করে রিশি নদী বয়ে চলেছে। জল খুব ঠান্ডা না হলেও প্রথম স্পর্শে বেশ ঠান্ডা লাগল। নদীর এ-পার ও-পার করার জন্য খুব সরু একটা বাঁশের সাঁকো আছে। জলে নেমে কিছুটা হেঁটে এগিয়ে গিয়ে সটান শুয়ে পড়লাম জলের মধ্যে। পাথরগুলো একটু পিছল হয়ে আছে। অসাবধান হলে পা পিছলে দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে।
সারা রাস্তা ধুলো মেখে আসা গাড়িগুলোকে ড্রাইভাররা সোজা নদীতে নামিয়ে দিয়ে নদীর জলে ধুয়ে নিচ্ছে। গাড়ি ধোয়ার এমন ভালো সুযোগ আর কোথায় পাবে? স্নান সেরে উঠে পোশাক বদলে খাবার টেবিলে গিয়ে বসলাম। পেটে যে ছুঁচোয় কীর্তন করছে সেটা বোঝা গেল। কিছুক্ষণের মধ্যেই এসে গেল ডাল, ভাত, তরকারি, আলুভাজা, ডিমের ঝোল, পাঁপড় আর আচার। কিন্তু যেটা খারাপ লাগল সেটা হল একটা ১২/১৩ বছরের ছেলে এখানে খাবার সার্ভ করছে। শুধুমাত্র সস্তায় কাজ করানো যাবে বলে নির্বিচারে শিশুশ্রমের মতো একটা জঘন্য কাজ করিয়ে নেওয়া হচ্ছে।
খাওয়া শেষ করে সেবাস্টিয়ান প্রধানের সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। মানুষটাকে দেখার, আলাপ করার ইচ্ছা আমার অনেক দিন ধরেই ছিল। আজ সুযোগ পেয়েছি। আজ সিল্ক রুটে ট্যুরিস্টরা যে ভ্রমণ করছেন তা অনেকটাই সম্ভব হয়েছে এই মানুষটির জন্য। আজ পত্রপত্রিকার পাতায় রেশম পথে ভ্রমণের প্রচুর বিজ্ঞাপন দেখতে পাই। অলিতে-গলিতে “চলুন বেড়িয়ে আসি সিল্ক রুট” মার্কা বোর্ড দেখা যায়। রেশম পথকে কেন্দ্র করে চলে কোটি কোটি টাকার ব্যবসা। এ সবের মূলে আছেন সেবাস্টাইন প্রধান।

মোটা মোটা কাঠের পায়ার উপর দাঁড়িয়ে আছে কর্টেজ। সিঁড়ি বেয়ে উঠে এলাম। সামনেই সেবাস্টিয়ান প্রধান আন্ডারপ্যান্ট ও স্যান্ডো গেঞ্জি পরে নিজের হাতে নতুন ঘরের কাঠের দেওয়ালে নীল রং করছেন। তাঁকে দেখে মনে হয় তাঁর বয়স ৫০ থেকে ৫৫, কিন্তু বাস্তবে এখন ৭৪ বছর বয়স। এই বয়সে তাঁর কর্মতৎপরতা দেখলে চোখ ছানাবড়া হয়ে যাবে। আলাপ-পরিচয় হওয়ার পর তাঁর কাছে শুনলাম কী ভাবে তিনি সিল্ক রুটে ট্যুরিজমের সূচনা করলেন।
আগে ওই পথ শুধু সেনাবাহিনী আর সরকারি কাজে সরকারি কর্মীরাই ব্যবহার করতেন। রাস্তার কাজ ও সেনাবাহিনীতে কুলির কাজ করেন, জুলুক, নাথাং ভ্যালি প্রভৃতি জায়গার এমন কিছু মানুষ, ওই পথে যাওয়া-আসা করতে পারতেন। এই পথে পর্যটনের প্রবল সম্ভবনা দেখেছিলেন সেবাস্টিয়ান প্রধান। সিকিম সরকারের সঙ্গে চিঠিপত্র বিনিময় শুরু করলেন, মন্ত্রীদের কাছে দরবার করা শুরু করলেন। সিকিমের অধিকাংশ পর্যটকই বাঙালি। “বাঙালিরা ও পথের প্রবল ঠান্ডা সহ্য করতে পারবে না, মারা যাবে”, এই কারণ দেখিয়ে সরকার কিছুতেই অনুমতি দিতে রাজি হল না।

অনেক দড়ি টানাটানির পর অবশেষে ২০০৭ সালে সাফল্য আসে, সরকার অনুমতি দেয়। তবে এই অনুমতির পিছনেও শর্ত আরোপ করা হয়। এ পথে কেউ রাত্রি যাপন করতে পারবে না। রংলি বা পদমচেন থেকে যাত্রা শুরু করে সে দিনই গ্যাংটকে যেতে হবে অথবা কিছুটা ঘুরে আবার রংলি বা পদমচেনে ফিরে রাত্রি যাপন করতে হবে। এ ভাবে বেশ কিছু দিন চলার পর সেবাস্টিয়ান প্রধান বুঝতে পারলেন এক দিনে ১২০/১৩০ কিমি পথ পাড়ি দিলে বেড়ানো আর সে অর্থে কিছু হবে না, শুধু গাড়ি চাপাই হবে। ট্যুরিস্ট এ পথে তেমন হবে না।
এ বার তিনি নিজেই একদিন জুলুকে ইচ্ছাকৃত ভাবে গাড়ি খারাপ হয়ে যাওয়ার বাহানা দিয়ে (যদিও গাড়ি ঠিক ছিল) সেখানে এক রাত কাটান। এ খবর সেনাবাহিনীর মাধ্যমে রাজ্য প্রশাসনের কাছে পৌঁছে যায় খুব দ্রুত। এটা নিয়ে হইহই কাণ্ড বেঁধে যায়। প্রশাসনিক কর্তারা এসে তাঁকে জুলুকে দেখে যান। এ বার পর্যটনমন্ত্রীর কাছে ডাক পড়ে তাঁর। তাঁকে তিনি এ বার বোঝাতে সমর্থ হন কেন মাঝে রাত্রিযাপনের প্রয়োজন। গাড়ি খারাপ হতে পারে, কেউ অসুস্থ হতে পারে। এত লম্বা পথ পাড়ি দিলে উচ্চতাজনিত কারণে অসুস্থ হওয়ার আশঙ্কা অতি প্রবল।
অবশেষে সরকার প্রথমে জুলুকে এবং পরে নাথাং ভ্যালিতে ট্যুরিস্টদের রাত্রিযাপনের অনুমতি দেয়। এর পর সিল্ক রুট-এর পর্যটনকে আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। (চলবে)
ছবি: লেখক