
পপকর্ন খেতে খেতে যাত্রা শুরু। কিছুটা যাওয়ার পর গতি মন্থর করে ভূপাল দেখাল – ওই দেখুন পুরোনো সিল্ক রুট।
অনেকগুলো ডব্লিউ-এর আকারে একটা সরু পথ নীচের দিকে নেমে গিয়েছে। দেখামাত্র একটা শিহরণ জাগল। এই সেই সিল্ক রুট! বিশ্বের প্রথম সুপার হাইওয়ে! এ যেন এক জীবন্ত ইতিহাস। এই সেই পথ যার মাধ্যমে সারা বিশ্বের সঙ্গে ভারতের যোগাযোগ হত এক সময়। চলত রেশম, ধাতু, অলংকার, কাপড়, সুগন্ধি দ্রব্য, মশলা, মূল্যবান পাথর প্রভৃতির ব্যবসা-বাণিজ্য। প্রায় ৬৫০০ কিমি এই পথ তিব্বতের রাজধানী লাসা হয়ে (অধুনা চিন) মধ্য এশিয়া চলে গিয়েছে।
আরও পড়ুন রহস্যময় রেশম পথ / পর্ব ৮ : জুলুকের উষ্ণ আপ্যায়ন
দ্বিতীয় খ্রিস্টপূর্বাব্দেও এই পথে মধ্য এশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্য চলত। পরে ইউরোপ থেকেও মধ্য এশিয়া হয়ে বণিকরা আসত লাসায়। লাসা থেকে জেলেপ-লা দিয়ে ভারতে প্রবেশ করে কুপুপ লেকের পাশ দিয়ে সোজা এই পথে জুলুক হয়ে ক্রমে সমতলে চলে আসত এবং সারা ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য চালাত। যারা সমুদ্র পাড়ি দিয়ে শ্রীলংকা, অস্ট্রেলিয়া, মালয়েশিয়া প্রভৃতি দেশের সঙ্গে বাণিজ্য করতে চাইত তারা সিল্ক রুট দিয়ে ভারতে প্রবেশ করে সোজা বঙ্গের তাম্রলিপ্ত বন্দর (অধুনা মেদিনীপুরের তমলুক) দিয়ে জাহাজে সমুদ্রযাত্রা করত।

এ পথ শুধু ব্যবসা-বাণিজ্যের পথ ছিল না। এই পথেই যেমন বিভিন্ন দেশের শিল্প-সংস্কৃতি ভারতে প্রবেশ করেছে তেমনই ভারতীয় শিল্প-সংস্কৃতি বিশ্বের দরবারে পৌঁছে গিয়েছে। এই পথেই গ্রিক শিল্পকলা ভারতে এসেছে। এই পথেই ভারত থেকে বৌদ্ধধর্ম বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। ভারতের গণিতশাস্ত্র ও বিজ্ঞান আরবে ছড়িয়ে পড়েছিল এই সিল্ক রুট ধরেই। চিনা পরিব্রাজক ফা-হি-য়েন এবং হিউ-এন সাং এ পথেই ভারতে এসেছিলেন। ভারত থেকেও এই পথে তিব্বত বা চিনে গিয়েছেন অতীশ দীপঙ্কর, শান্ত রক্ষিত, শরৎচন্দ্র দাস প্রমুখ পরিব্রাজক। এমনকি রাজা রামমোহন রায়ও জেলেপ-লা দিয়ে তিব্বত যান।

ভারত-চিন যুদ্ধের আগে পর্যন্ত এ পথে ব্যবসা-বাণিজ্য চলত। যুদ্ধের পর এই পথ বন্ধ করে দেওয়া হয়। এখন অবশ্য এ পথ সক্রিয় করার জন্য ভারত-চিন ভাবনাচিন্তা চালাচ্ছে।
আমরা এগিয়ে চলেছি। কখনও মেঘ আমাদের গ্রাস করছে, আবার কখনও উগরে দিচ্ছে। গাড়িতে ভালো ভালো গান বাজছে, কিন্তু সে দিকে কারওর খেয়াল নেই। জোড়া জোড়া চোখ বন্ধ জানলার বাইরে পাড়ি দিয়েছে। থেকে থেকেই উল্লাসধ্বনি বেরিয়ে আসছে মুখ থেকে। বয়সকে সবাই যেন কখন ছুড়ে ফেলে দিয়েছে পাহাড়ের খাদে।

থাম্বি ভিউ পয়েন্টে যখন গাড়ি থেকে নামলাম মনে হল ঠান্ডায় জমে যাব। চারিদিকে ঘন মেঘ বা কুয়াশায় ৫০ ফুট দূরও দৃশ্যমান নয়। থাম্বি ভিউ পয়েন্টের উচ্চতা ১১২০০ ফুট। এখান থেকে পরিষ্কার আকাশে সুন্দর নিসর্গ দেখা যায়, আমাদের কপাল মন্দ। আমরা ছাড়াও আরও দু’গাড়ি ট্যুরিস্ট এসেছে। চলছে ফটোসেশন। একটা হলুদ কংক্রিটের ফলকে কালো রং দিয়ে ‘থাম্বি ভিউ পয়েন্ট’ লেখা। এই ফলককে পাশে রেখে ছবি তোলারও উন্মাদনা রয়েছে। এখানে আসার প্রমাণ সবাই ছবিতে রাখতে চাইবে, সেটাই তো স্বাভাবিক।

এখানে আবার রডোডেনড্রন ফুল। এ বারে সে রাঙা পোশাকে হাজির হলেও কালকের সেই রূপ আজ আর নেই। কেমন একটা লাবণ্যহীনতা গ্রাস করেছে। গাছে ফুটে থাকা ফুলগুলিকে দু’হাত দিয়ে স্পর্শ করলাম। বড় কোমল এ ফুল। রডোডেনড্রন ফুল থেকে টপ টপ করে ঝরে পড়ছে কুয়াশার জলরূপী অশ্রু, যার ছোঁয়া লাগল আমারও চোখে-মুখে।

মেঘের পর্দার ওড়াউড়ির ফাঁকে প্রকৃতির সৌন্দর্য দেখতে দেখতে পৌঁছে গেলাম লক্ষ্মণচক। জায়গাটা নাথাং এলাকায়। একটা ক্যাফেটেরিয়া কাম গিফট শপের সামনে গাড়ি দাঁড়াল। এটি সিকিম পর্যটন দফতরের তৈরি। এখানে দাঁড়ানোর কারণ দু’টো – এক, এখানেই প্রথম বরফ দেখলাম। ক্যাফেটেরিয়ার চালে কাল রাতে যে বরফ পড়েছিল সেগুলো গড়িয়ে নীচে এসে জড়ো হয়েছে। সেই বরফ একটু ঘাঁটার সাধ হয়েছে। দুই, যদি কেউ গরম চায়ে একটু গলা ভেজাতে চায়। কিন্তু গরম চা বা কফিতে গলা না ভিজিয়ে সবাই বরফ ছোড়াছুড়িতেই ব্যস্ত হয়ে গেল। ক্যাফেটেরিয়ার পাশেই কর্নেল লক্ষ্মণ সিং-এর স্মৃতিসৌধ। তাঁর নামেই এই জায়গার নাম।

আবার যাত্রা। যত যাচ্ছি ততই বরফের পরিমাণ অল্প অল্প করে বাড়ছে। জানলার কাচ সামান্য নামিয়ে ফটো তুলছি, গ্লাভস পরা নেই, হাত যেন জমে যাচ্ছে। টুকলা ভ্যালিতে যখন এলাম চারিদিকে কুয়াশায় ভরে গিয়েছে। বরফের ঘনত্ব আরও বেড়েছে। রাস্তার উপরে বরফের পাতলা চাদর।
নাথাং ভ্যালি চলে এলাম। উচ্চতা ১৩১৪০ ফুট। ভিউ পয়েন্টে গাড়ি থামতেই নেমে পড়লাম। রাস্তা থেকে একটা ঢাল নীচে নামতে নামতে কুয়াশার মধ্যে হারিয়ে গিয়েছে। এখানে বরফ আর কুয়াশা, উভয়েরই আধিক্য বেশি। হাতের সামনে বরফ পেয়ে খুশির অন্ত নেই। বরফে পা হড়কে যাচ্ছে। খুব সাবধানে হাঁটতে হচ্ছে।

গাড়িতে উঠে আবার যাত্রা। একটু এগিয়েই বাঁ দিকে কিছুটা নীচে বেশ কিছু বাড়ি দেখলাম। অনেকেই এখানে এসে রাত্রিযাপন করেন। সম্ভবত এগুলোই সেই সব হোমস্টে। রাস্তায় এখন ইঞ্চি ছয়েক পুরু বরফ। পৃথিবীর সব রং এখান থেকে মুছে গিয়েছে। প্রকৃতি শুধু সাদা আর কালো। এ রকম মনোক্রম প্রকৃতি আগে কখনও দেখিনি। এ এক নতুন অভিজ্ঞতা।
আমরা এখন পুরোনো বাবামন্দিরের দিকে চলেছি। বরফের আধিক্যে বহু ট্যুরিস্ট গাড়ি ফিরে আসছে। গাড়িগুলিকে পাশ দিতে গিয়ে আমাদের গাড়িকে বারে বারে খাদের কিনারায় চলে যেতে হচ্ছে। এটা খুবই বিপজ্জনক। এই বরফে গাড়িতে ব্রেক মারলেও চাকা স্লিপ করে, ফলে গাড়ির উপর নিয়ন্ত্রণ থাকে না। এই ভয়েই অধিকাংশ ড্রাইভার ফিরে আসছে। অনেক ড্রাইভারই ইশারায় বা চেঁচিয়ে আমাদের ফিরে যাওয়ার পরামর্শ দিল। ভূপাল কাউকে পাত্তা না দিয়ে এগিয়ে চলল।
– যাওয়া যাবে তো?
– দেখি না, যত দূর যাওয়া যাবে তত দূর যাব। আট বছর এই রুটে গাড়ি চালাচ্ছি, এদের আমি খুব ভালো করেই জানি। জবাব ভূপালের।

কথা না বাড়িয়ে চুপ করে বসে রইলাম। চকলেট, পপকর্ন দিয়ে সবাই মুখ চালাতে লাগল। কিছু দূর যাওয়ার পর দাঁড়িয়ে পড়তে হল। একটা গাড়ি ফেঁসে গিয়েছে ইউ টার্ন করতে গিয়ে। ঠেলেও গাড়িটাকে নড়ানো যাচ্ছে না। দু’ জন জওয়ানও হাত লাগিয়েছেন। গাড়ি থেকে নেমে পড়লাম। মাটিতে পা দিতেই পুরো জুতোটাই বরফে ঢুকে গেল। অবশেষে সেই গাড়ি ঘুরল। আমরা এগোলাম, আমাদের সঙ্গে এখন আর একটাই গাড়ি। একটা মাইলস্টোন দেখলাম, লেখা কুপুপ ৬ কিমি। ভূপাল জানাল, পুরোনো বাবামন্দির আসতে সামান্যই বাকি।
১০ মিনিট বাদেই চলে এলাম বাবামন্দির। ট্যুরিস্ট বেশি নেই। আমাদের গাড়ি ছাড়া আর গোটা তিনেক গাড়ি। আমাদের সঙ্গে যে গাড়িটা আসছিল সেটাও আছে। পরে জেনেছিলাম ওই গাড়ির সওয়ার পাঁচ বান্ধবী, সিল্ক রুট বেড়াতে এসেছে।

বাবামন্দিরে পিতলের সিংহাসনে বাবা হরভজন সিং-এর একটি মূর্তি ও একটা ফটো রাখা আছে। এ ছাড়াও আরও কিছু ঠাকুর-দেবতার ফটো রাখা আছে এবং শিখ, খ্রিস্টান ও মুসলিমদের কিছু ধর্মীয় ছবিও রাখা আছে।
হরভজন সিং ছিলেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর পঞ্জাব রেজিমেন্টের এক জওয়ান। ঠিক এই জায়গাতেই ছিল তাঁর বাঙ্কার। ১৯৬৮ সালে সিকিমে এক ভয়াবহ প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটে। প্রবল বৃষ্টিতে বন্যা দেখা দেয়। বহু জায়গায় ধস নামে। কয়েকশো মানুষ প্রাণ হারান। ভারতীয় সেনাবাহিনী স্বাভাবিক ভাবেই উদ্ধারকাজে হাত লাগায়। ১৯৬৮ সালের ৪ অক্টোবর হরভজন সিং টুকলাদাড়া কিছু মানুষকে উদ্ধার করে ব্যাটেলিয়ানের হেড কোয়ার্টার ছোঙ্গুচুইলায় নিয়ে যাচ্ছিলেন। যাওয়ার পথে পা পিছলেই হোক বা জলের তোড়েই হোক তিনি এক খরস্রোতা নালায় পড়ে যান। জোরদার তল্লাশি চালিয়েও সেনাবাহিনী তাঁর দেহ খুঁজে পায় না। অবশেষে পাঁচ দিন পর তাঁর এক সহকর্মীকে স্বপ্নে দেখা দিয়ে তিনি তাঁর মৃত্যু সম্পর্কে বলেন। তাঁর দেহ কোন জায়গায় আছে তা-ও বলেন। পরে সেই জায়গায় তল্লাশি চালিয়ে তাঁর দেহ উদ্ধার হয়।
এর পর তাঁর সহকর্মীরা ছোঙ্গুচুইলায় অর্থাৎ এই স্থানে তাঁর একটি মন্দির তৈরি করেন। শোনা যায় হরভজন সিং-এর আত্মা এখনও এখানে বিরাজমান। বিপদে পড়লে অনেককেই তিনি উদ্ধার করেছেন। ডিউটিরত অবস্থায় ঘুমিয়ে যাওয়ার কারণে বা কর্তব্যে ঢিলে দেওয়ার কারণে অনেক জওয়ানই তাঁর অদৃশ্য হাতের চড় খেয়েছেন।

মন্দিরের পাশেই হরভজন সিং-এর বাঙ্কারের সিঁড়ি। জুতো খুলে রেখে সেনাবাহিনীর রেখে দেওয়া হাওয়াই চপ্পল পরে যেতে হবে। আর কেউ যাবে না, আমি একাই চললাম। ভূপাল তাড়াতাড়ি আসতে বলল। আবহাওয়া খারাপ হতে শুরু করেছে। বরফ পড়া শুরু হলে ভীষণ বিপদ হয়ে যাবে। ৩০/৩৫টা সিঁড়ি দৌড়ে উঠে। উপরে ছোটো ছোটো তিনটে ঘরে হরভজন সিং-এর ব্যবহৃত জিনিসপত্র রাখা। প্রসঙ্গত বলি, হরভজন সিংকে এখনও সেনাবাহিনীর একজন মনে করা হয়। প্রতি বছর তাঁর জন্য পোশাক ও অন্যান্য জিনিস বরাদ্দ হয়। মিটিং-এ তাঁর জন্য একটা চেয়ার ফাঁকা থাকে। ওই চেয়ারে তাঁর ফটো রাখা থাকে।
মন্দিরের সামনেই একটা স্টিলের গুমটি। তার ভিতরে এক গামলা কিশমিশ রাখা। বাবা হরভজন সিং-এর প্রসাদ। কাছে যেতেই এক জওয়ান আমায় একমুঠো কিশমিশ দিয়ে দিলেন। কিশমিশ গুলো খেতে খেতে গাড়িতে গিয়ে উঠলাম। টিপটিপ করে হালকা বৃষ্টি শুরু হয়েছে। (চলবে)
ছবি লেখক