
হোমস্টের বৃদ্ধ মালিকের তত্ত্বাবধানে ভূপাল গাড়ির ছাদ থেকে মালপত্র নামিয়ে দিল। আমরা সেগুলো দু’টো ঘরে নিয়ে এসে রাখলাম। টিনের চাল, টিনের দেওয়াল। ঘরের ভিতরটা প্লাইউড দেওয়া থাকলেও এই স্যাঁতসেঁতে আবহাওয়ায় ঠান্ডা যেন কামড়ে দিচ্ছে। বিকেলেই এই অবস্থা! রাতে কী হবে ভগবান জানে।
গৃহকর্তা আমাদের হাত-মুখ ধুয়ে খাবার টেবিলে আসতে বললেন। অরূপদা ঠান্ডায় বেশ কাবু হয়ে পড়েছে। তবে যতটা কাবু হয়েছে তার থেকে বেশি আতঙ্কিত। যা-ই হোক, দু’টো ঘরে দু’খানা রুমহিটার জ্বালানো হয়েছে। ১৫০ টাকা করে এক একটার ভাড়া।
খাবার টেবিলে কথাবার্তা চলছে। অবেলা হয়ে গেলেও আমরা অল্প করে ডিমের ঝোল, ভাতই খাচ্ছি। এ ছাড়া কোনো উপায় নেই। রূপের আবার জ্বর আসছে। ওকে নিয়ে খুব চিন্তায় আছি।
রূপের জ্বরের খবর শুনে গৃহকর্তা আশ্বস্ত করলেন। বিকেলে এখানকার মিলিটারি ট্রানজিট ক্যাম্পে ডাক্তারবাবু বসেন। সেখানে নিয়ে যাবেন বললেন। এক জন ভালো ডাক্তার দেখানো যাবে জেনে একটু আশ্বস্ত হলাম।

টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছে। রাস্তায় নেমে পড়লাম। আমাদের সামনে বিশাল এক পর্বত দেওয়ালের মতো দাঁড়িয়ে। পাহাড়ের মাথাটা মেঘের মধ্যে ঢুকে গিয়েছে। তার ফলে পাহাড়টা ঠিক কত উঁচু বুঝতে পারলাম না। সন্ধের মুখে এখনও ট্যুরিস্টবোঝাই গাড়ি ওই পাহাড়ে উঠছে। ওরা এই পথে নাথাং ভ্যালি যাচ্ছে। ওখানেই রাত কাটাবে। এখান থেকে নাথাং পৌঁছোতে আরও প্রায় ৩ ঘণ্টা সময় লাগবে। আকাশের এই অবস্থায় ওই উচ্চতায় পাহাড়ের বুকে অন্ধকারে গাড়ি চালানো! সত্যিই বড়ো দুঃসাহস এঁদের। কাল ভোরবেলা আমরাও ওই পথে যাত্রা করব।
জুলুক আসলে একটি কুলিবস্তি ছিল। এখানকার বাসিন্দারা সেনাবাহিনীর মালপত্র পৌঁছে দেওয়া, ফাইফরমাশ খাটা ও রাস্তা সারাইয়ের কাজ করত। এখনও অনেক বাসিন্দাই এ সব কাজই করে। আমরা যে হোমস্টেতে আছি তার মালিক গাড়ি করে সেনাবাহিনীর ক্যাম্পে সবজি ও অন্যান্য জিনিস পৌঁছে দিতেন এবং মালকিন রাস্তা সারাইয়ের কাজ করতেন। এখন বার্ধক্যের কারণে সে সব কাজ ছেড়ে হোমস্টে খুলেছেন। ওঁদের ছেলে এখন ট্যুরিস্ট গাড়ি চালায়। শুনলাম সে-ও ট্যুরিস্ট নিয়ে এসেছে এখানে। বাড়িতেই আছে এখন, যদিও তার দেখা পাইনি আমরা।
আরও পড়ুন রহস্যময় রেশম পথ / পর্ব ৭ : অবশেষে জুলুক
৯০০০ ফুট উচ্চতা থেকে জুলুক শুরু হয়ে ১১৫০০ ফুটে গিয়ে শেষ হয়েছে। জুলুকের দু’টো অংশ – আপার জুলুক ও লোয়ার জুলুক। ট্যুরিস্টরা সব লোয়ার জুলুকেই থাকে। আপার জুলুকে থাকার কোনো ব্যবস্থা নেই। একটা মন্দির আছে সেখানে। দূর থেকে দেখতে পাচ্ছি। ঘণ্টার আওয়াজও কানে আসছে। ওখানেও এক চক্কর দেব ভাবলাম। কিন্তু কয়েক পা এগোতেই ঝমঝম করে বৃষ্টি নামল। অগত্যা আবার হোমস্টের চার দেওয়ালের মধ্যে সেঁধিয়ে গেলাম। অরূপদার বাঁ পায়ের বুড়ো আঙুলের নখ মাংসের মধ্যে ঢুকে গিয়েছে। বেচারা ঠিকমতো হাঁটতে পারছে না। যন্ত্রণা হচ্ছে। অরূপদাও মিলিটারি ক্যাম্পে ডাক্তার দেখাতে যাবে।
কিছুক্ষণ পরেই হালকা বৃষ্টির মধ্যে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। ট্রানজিট ক্যাম্প আরও উপর দিকে। পাঁচ মিনিটের রাস্তা। ট্রানজিট ক্যাম্পের গেটে জওয়ানরা আমাদের এখানে আসার কারণ জিজ্ঞাসা করলেন। কারণ জানানোর পর অভ্যর্থনা করে নিয়ে গিয়ে বসালেন। এর আগেও আমি ট্যুরিস্ট হিসাবে সেনাক্যাম্পে গিয়েছি, ওঁদের ব্যবহার সত্যিই মন ছুঁয়ে যায়।
আমাদের নাম-ঠিকানা লিখে নেওয়ার কিছুক্ষণ পর দু’জন মেডিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট এসে সব জিজ্ঞাসাবাদ করলেন। তাঁরা অরূপদার পায়ের বুড়ো আঙুল পরীক্ষা করলেন। ডাক্তার আসার আগেই ওই দুই অ্যাসিস্ট্যান্ট পাশের ঘরে অরূপদাকে নিয়ে গিয়ে তাঁর চেঁচামেচির মধ্যেই নখ কেটে মাংস থেকে বের করে দিয়ে ওষুধ লাগিয়ে ব্যান্ডেজ করে দিলেন।
একটু পরে মহিলা ডাক্তার এলেন। রূপকে দেখে জানতে চাইলেন কী হয়েছে। রূপকে কী ওষুধ খাইয়েছি সব বললাম। উনি ওগুলোই চালু রাখতে বললেন, সঙ্গে পেটে ইনফেকশনের একটা সিরাপ দিয়ে দিলেন।

সন্ধ্যায় অরূপদার ঘরে আড্ডা চলছে। আমারও কেমন যেন অস্বস্তি লাগছে। নিঃশ্বাসও খুব সাবলীল লাগছে না। সবটাই উচ্চতাজনিত কারণে। কাল অনেক উপরে উঠব তাই একটু চিন্তায় আছি। একটু কোকা ৩০ খেয়ে নিলাম। রাত আটটায় খাবার টেবিলে চলে গেলাম। লোহার টেবিল, নীচে আগুন জ্বলছে। বেশ আরামদায়ক ব্যাপার।
গল্প করতে করতে খাচ্ছি। গৃহকর্তা নিজে দাঁড়িয়ে থেকে খাবারের তদারকি করছেন। এই ট্যুরে এই প্রথম হোমস্টের এতটা উষ্ণ আপ্যায়ন পেলাম। মালিকের একটি কন্যাসন্তান আছে। কালিম্পং-এ বিয়ে হয়েছে। এ সব এলাকায় বিয়ের পাত্র হিসাবে ড্রাইভার ছেলের ভীষণ কদর। গাড়ি চালিয়ে তারা প্রচুর উপার্জন করে। একটা গাড়ির উপার্জন থেকে অনেকেই অনেক গাড়ি কিনেছে। অনেকে আবার হোমস্টে, হোটেল পর্যন্ত করে ফেলে।
খাওয়া শেষ করে উঠে পড়লাম। বাইরে তখন মুষলধারায় বৃষ্টি। কনকনে ঠান্ডা। কাল যত সকালে সম্ভব বেরিয়ে পড়তে হবে।
জুলুক ভিউ পয়েন্টে
সারা রাত তুমুল বৃষ্টি হল। বার বার বৃষ্টির আওয়াজে ঘুম ভেঙেছে। যত বার ঘুম ভেঙেছে তত বার জানলার পর্দা সরিয়ে দেখেছি বরফ পড়ছে কিনা। দাম্পত্যজীবনে কখনও কখনও মাথায় বরফ চাপা দিয়ে রাখলেও জীবনে কখনও বরফ পড়া দেখিনি। সকালে দরজা খুলে বাইরে উঁকি মেরেও বরফের চিহ্ন খুঁজে পেলাম না। প্রকৃতি এ যাত্রা বেইমানি করল।
কনকনে ঠান্ডায় হাত-পা পেটে সেঁধিয়ে যাওয়ার দশা। বাড়ির মালিক গরম জলের ব্যবস্থা করে দিলেন। ওই জলের উপর ভরসা করেই আমাদের প্রস্তুতি চলতে লাগল।
তৈরি হয়ে খাবারঘরে চলে এলাম সবাই। টেবিলের তলায় হালকা আগুন করা আছে। চলে এল অরূপদার প্রেসক্রাইব করা গরম গরম রেসিপি। নর সুপের মধ্যে ম্যাগি দিয়ে রান্না করা খাবার। ম্যাগি সুপ নাম দেওয়া যেতে পারে। এক চামচ মুখে দিয়েই আঁতকে উঠলাম। এমন বাজে স্বাদের খাবার আমি জীবনে কখনও খেয়েছি কিনা মনে করার চেষ্টা করলাম। অরূপদা খাবারটা একবার নাড়ছে আর ট্যাবলেট খাওয়ার মতো কোঁত করে গিলে নিচ্ছে। বাকিদেরও মুখ সিঁটকে আছে। এ বার নিজের খাবারের দিকে তাকিয়ে বললাম, খাবারটা দারুণ হয়েছে। সবাই আমার দিকে তাকিয়ে রইল কয়েক মুহূর্ত, তার পরেই হাসিতে ঘর ভরে গেল।
এত উচ্চতায় জার্নির জন্য সহজপাচ্য খাবার খাওয়াই উচিত। সে দিক থেকে দেখলে আজকের জার্নির উপযুক্ত খাবারই খাচ্ছি। বিস্বাদকে সুস্বাদে ফেরাতে বেশ করে টোম্যাটো সস ঢাললাম। আমার দেখাদেখি বাকিরাও তা-ই করল।

সকাল ৮টা। আবার যাত্রা। সামনের ওই উঁচু পাহাড়টা আমাদের পেরিয়ে যেতে হবে। পাহাড়ের গায়ে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে আমাদের চলার পথ। আকাশ এখনও মেঘলা। জায়গায় জায়গায় ঘন কুয়াশা। হঠাৎ ভূপাল গাড়ি থামিয়ে বলল, ওই দেখুন সাদা রডোডেনড্রন। গাড়ি থেকে নেমে ছবি তুললাম। কাল যে লাল রডোডেনড্রন দেখেছিলাম, তার রূপের কাছে এ কিছুই নয়।
এগিয়ে চলেছি। যত এগোচ্ছি ততই মেঘেরা ঘিরে ধরছে। যেন কী একটা আক্রোশে আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। পাহাড়শ্রেণির অজানা কোনো গহীন অন্তরাল থেকে তারা দলে দলে ছুটে এসে আমাদের ঘিরে ফেলছে। এরই মাঝে মেঘেদের ফাঁক দিয়ে দূরে অনেক নীচে দেখা গেল আমাদের কাল রাতের আস্তানা। উড়ন্ত ঈগল পাখির চোখে জুলুক কেমন দেখায় তা কিছুটা আন্দাজ করতে পারছি। সবুজ জুলুক যেন সাদা মেঘের মুকুট পরে আছে। আমাদের ফেলে আসা অর্ধচন্দ্রাকার পথগুলো মনে হচ্ছে তার গলায় ঝুলন্ত মালা।
পাহাড়ের গায়ে শুধুই ঘাস জাতীয় গাছ। মাঝে মাঝে দু-একটা পাইন মাথা তুলে দাঁড়িয়ে। এক সময় এসে পৌঁছোলাম জুলুক ভিউ পয়েন্টে। উচ্চতা ১০৪৫০ ফুট। এখান থেকে অনেক নীচে জুলুককে বড়ো সুন্দর দেখায়।

গাড়ি থেকে নেমে কাঙালের মতো এ-দিক ও-দিক করছি যদি হঠাৎ মেঘ সরে গিয়ে প্রকৃতির দর্শন পাওয়া যায়। আমরা ক’জন ছাড়া এখানে আর এক জনও ট্যুরিস্ট নেই। এখান থেকে ভালো সানরাইজ দেখা যায়, কিন্তু মেঘই বাধা। “বাবুজি খুলজা সিম সিম বলিয়ে। মেঘ ক্লিয়ার হো জায়েগা।” ভূপালের কথায় হেসে ফেললাম। ওর কথা শুনে মৌসুমী চিৎকার জুড়ে দিল, “খুল যা সিম সিম।”
পাশেই বাঁশ ও টিন দিয়ে তৈরি এখানকার একমাত্র দোকানঘরটিতে হাজির হলাম। খানকয়েক পপকর্নের প্যাকেট কিনলাম। পপকর্ন শুধু যে পেট ভরায় তা নয়, এটি উচ্চতাজনিত কারণে শ্বাসকষ্ট ও অন্যান্য শারীরিক সমস্যা থেকে রক্ষা করে।
দাম মিটিয়ে দুই দোকানির সঙ্গে গল্প জুড়ে দিলাম। ভোরবেলা নাথাংগামী কোনো গাড়িতে করে ওরা এখানে চলে আসে। সারা দিন বেচাকেনা করে বিকেলে ফিরে যায় লোয়ার জুলুক। বড়ো কষ্টের জীবন ওঁদের কিন্তু মুখের হাসিটি বড়ই স্বতঃস্ফূর্ত।
সবাইকে এ বার ডেকে নিলাম। যেতে হবে অনেক দূর। জুলুক থেকে নাথাং, কুপুপ হয়ে গ্যাংটক – ৯৩ কিমি রাস্তা। পথের উচ্চতা আরও বাড়বে। বেলা বাড়লে আবহাওয়া খারাপ হয় এই উচ্চতায়। এক বার আবহাওয়া খারাপ হলে বিপদে পড়তে হতে পারে। (চলবে)
ছবি: লেখক