রহস্যময় রেশম পথ / পর্ব ৭ : অবশেষে জুলুক

Zuluk
sudip paul
সুদীপ পাল

নিমাচেনে একটা ঝরনা আছে। নাম কিউখোলা ফল্‌স। এ পথের যাত্রীদের কাছে খুবই পরিচিত ঝরনা। ঝরনার কাছেই আমাদের গাড়ি দাঁড়াল। ১৫ ফুট উপর থেকে পাহাড়ের গা বেয়ে জল নেমে আসছে। তবে শিস্নের ভুতখোলা ফলসের মতো অত জল নেই। সে অর্থে কিউখোলা ফলস দরিদ্রই বলা যায়। পাশেই বাঁ দিক থেকে একটা জলধারা এসে সমগ্র জায়গাটা জলময় করে রেখেছে। এই জল আন্ডারপাসের মাধ্যমে রাস্তার এ পার থেকে ও পারে গিয়ে কোন অজানার উদ্দেশে পাড়ি দিয়েছে কে জানে?

ঝরনার পাশে একটা বছর পাঁচেকের শিশু জানি না কীসের খুশিতে আপন মনে হাততালি দিচ্ছে আর লাফাচ্ছে। এই বয়সটাই এমন, কারণে অকারণে মন খুশিতে ভরে যায়। এই শিশুদের কাছে বাস্তবের কোনো গুরুত্ব নেই। বাস্তবকে ছাপিয়ে যায় কল্পনার রং। হয়তো সে স্পাইডারম্যান হয়ে ঝরনার মধ্যে দিয়ে পাহাড়ের গা বেয়ে উপরে উঠছে। কিংবা মাছ হয়ে সামনের জলে সাঁতার কেটে বেড়াচ্ছে। কল্পনার রাজ্যে তার অবাধ বিচরণ। আমরা বড়োরা শিশুদের এই কল্পনার রাজ্যে কোনো ভাবেই আর প্রবেশ করতে পারব না। আমাদের ছেলে রূপের বয়সও পাঁচ। তার ড্রইং খাতায় মাঝে মাঝেই কল্পনাশক্তির পরিচয় পাই। হয়তো এরা কী  দেখছে সে সব কয়েক সপ্তাহেই ভুলে যাবে। আকাশের মেঘের মতো সব কিছুই এদের কাছে ক্ষণস্থায়ী হলেও সব কিছুই রামধনুর মতো বর্ণময়।

que khola falls
কিউখোলা ফল্‌স।

আধ ঘণ্টা সময়  এখানে কাটিয়ে কিছু ছবি তুলে গাড়িতে ফিরে এলাম। রাস্তার ও পাশে ফুড কর্নারে ভূপাল কিছু খাওয়াদাওয়া করছে। দুপুর একটা। খিদে পাওয়ারই কথা। আমরাও ভূপালকে দেখে ড্রাই ফুডের প্যাকেট খুলে মুখ চালানো শুরু করলাম। কিছুক্ষণ বাদে ভূপাল ফিরে আসতেই আবার পথ চলা শুরু।

উচ্চতা যে বাড়ছে, গাছপালা দেখেই বোঝা যাচ্ছে। এর মধ্যে আবার কুয়াশার উৎপাত। এমনিতেই পাহাড়ে বেলা বারোটার পর থেকেই আবহাওয়া খারাপ হওয়ার প্রবল সম্ভাবনা থাকে, তার উপর মেঘলা থাকলে তো কথাই নেই।

pamgolakha checkpost
প্যাঙ্গোলাখা চেকপোস্ট।

চলতে চলতে এক সময় গাড়ি দাঁড়িয়ে গেল। আশেপাশে দু’ চারটে বাড়ি দেখতে পাচ্ছি। রাস্তার ডান দিকে একটা সাদা রঙের ঘর। ঘরের দেওয়ালে লেখা আছে ‘প্যাঙ্গোলাখা চেকপোস্ট’। ঘরের পাশে সবুজ রঙের একটা বোর্ডে সাদা রং দিয়ে লেখা ‘ফরেস্ট চেক পয়েন্ট’।

আসলে এখান থেকে শুরু করে ছাঙ্গু লেক পর্যন্ত পুরো এলাকাটাই প্যাঙ্গোলাখা ওয়াইল্ডলাইফ স্যাংচুয়ারি। এখানে সিকিমের রাজ্য পাখি মোনাল তো আছেই এ ছাড়াও সিকিমের রাজ্য পশু রেড পান্ডা , হিমালয়ান মাস্ক ডিয়ার, লেপার্ড, গাউর, ফ্লাইং স্কুইরেল, হিমালয়ান ব্ল্যাক বিয়ার, বুনো শুয়োর, জংলী কুকুর প্রভৃতি আছে। ২০০২ সালে সিকিম সরকার ১২৮ বর্গ কিমির এই জঙ্গল এলাকাকে অভয়ারণ্য হিসাবে ঘোষণা করে। ১৩২০ মিটার উচ্চতা থেকে শুরু করে ৪৬০০ মিটার উচ্চতা পর্যন্ত এর বিস্তৃতি।

আরও পড়ুন: রহস্যময় রেশম পথ / পর্ব ৬ : অরিটার হয়ে রংলি ছুঁয়ে জুলুকের পথে

গাড়ি থেকে নেমে পড়লাম। বেশ ঠান্ডা। যে হেতু অভয়ারণ্যে প্রবেশ করছি তাই একটা প্রবেশ মুল্য দিতে হবে। ভূপাল টাকা নিয়ে সাদা ঘরে চলে গেল। আমিও ক্যামেরা নিয়ে রেডি। মিনিট পাঁচেক পরেই শুনি ভূপাল ডাকছে। দুর বাবা, এত তাড়াতাড়ি হয়ে গেল! এখনও তো গাছের ফাঁক দিয়ে কোনো পান্ডা বা ভাল্লুক উঁকি মারছে কিনা তার সন্ধান করা হল না। নীচের দিকে কোনো মাস্ক ডিয়ার ঘাসপাতা চিবাতেও তো পারে। কি আর করব? অগত্যা আবার গাড়িতে গিয়ে বসলাম। আবার চলা শুরু।

towards Zuluk
জুলুকের পথে প্রকৃতির সাথে।

রাস্তার দু’ ধারে কুয়াশায় ঢাকা পাইন গাছের সারি। গাছের ডাল থেকে টপ টপ জল ঝরে পড়ছে। মাঝে মাঝে বৌদ্ধদের রঙবেরঙের প্রেয়ার ফ্ল্যাগ। দূরের পাহাড়গুলো থেকে সাদা মেঘেরা গুঁড়ি মেরে উপরে উঠে আসছে। পথের পাশে আর খাদ দেখা যাচ্ছে না। সমস্ত খাদ কেউ মেঘ ঢেলে ভর্তি করে দিয়েছে। আচমকা চোখে পড়ল লাল থোকা থোকা ফুল ফুটে আছে সামনের একটা গাছে। ভূপাল বলে উঠল, “ওই দেখুন রডোডেনড্রন।“

রডোডেনড্রন! আমার এই সময় এখানে আসার মূল কারণ দু’টি – এক, রডোডেনড্রন ফুল দেখা। এই সময়ই ফোটে এই ফুল। রডোডেনড্রন সিকিমের রাজ্য ফুল। আর দুই, বরফ দেখা, যার দর্শন হয়তো জুলুকের পর থেকে পাব।

“গাড়ি দাঁড় করাও, আমি নামব”, উত্তেজিত ভাবে বলে উঠলাম। আমার স্বপ্নের ফুল। কত ইচ্ছা ছিল রডোডেনড্রন ফুল দেখবো। আজ এই ফুল আমার সামনে! নিজের চোখে দেখেও যেন বিশ্বাস হচ্ছে না। জীবনে প্রথম দেখছি রডোডেনড্রন ফুল। এর উজ্জ্বল লাল রং দেখে আমি মুগ্ধ।  হিংসুটে কুয়াশা শত চেষ্টা করেও এর রংকে চাপা দিতে পারেনি। কুয়াশা ভেদ করে ফুটে বেরোচ্ছে এর রূপ।

rhododendron flower 1
কুয়াশা মাখা রডোডেনড্রন।

রাস্তায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দু’ চোখ ভরে দেখছিলাম রডোডেনড্রন ফুল। সম্বিত ফিরল ভূপালের ডাকে – “চলে আসুন। অনেকটা পথ যেতে হবে। সামনে আরও গাছ আছে, একটা ভালো জায়গা দেখে আবার দাঁড়াব।“

ঝরে পড়া কয়েকটা রডোডেনড্রন ফুল কুড়িয়ে নিয়ে ফিরে এলাম গাড়িতে। আবার পথ চলা শুরু। কিছুক্ষণ পরে মেঘ থেকে বেরিয়ে এলাম। পাইন গাছও আমাদের সঙ্গ ত্যাগ করেছে। এখন রাস্তার দু’পাশে শুধু ঘাস, আখের মতো সরু সরু বাঁশ গাছের ঝাড় আর গুল্মরাজি। পাহাড়ের খাদ তুলোর মতো সাদা মেঘে পরিপূর্ণ। এমন সময় আবার তার দর্শন পেলাম। এ বার ভুপাল নিজেই গাড়ি থামাল। এক গাল হেসে বলল, “এ বার নেমে দেখুন।”

দুমদাম সপার্ষদ গাড়ি থেকে নেমে পড়লাম। যেন নন্দন কাননে এসেছি। কানে যেন বেজে উঠল খিল খিল হাসি। পিছন ঘুরে দেখি রডোডেনড্রন ফুল আমার দিকে তাকিয়ে যেন হাসছে। কোন দিক দেখি? বাঁ দিকে রডোডেনড্রন ফুল আর ডান দিকে নিসর্গ। আমি তালকানা হয়ে গেছি।

rhododendron
মন ভরাল রডোডেনড্রন।

রডোডেনড্রনের সঙ্গে মনে মনে আমার অনেক কথা হল। আমার অবস্থা দেখে মনে হল ও যেন হাসছে। রডোডেনড্রন দেখার জন্য আমার এত বছরের অপেক্ষা আজ সার্থক হল। কিন্তু মেঘগুলো এমন উৎপাত করছে যে ভালো করে দেখা হচ্ছে না তাকে। কিন্তু আমি তো পথিক, আমায় তো এগোতেই হবে। কিন্তু তার আগে কিছু ভালো ছবি চাই তার।

কিন্তু ভালো ছবি পেতে হলে পাহাড়ের গা বেয়ে উঠতে হবে যে। চেষ্টা করলাম, পারলাম না। আমার আকুলতা দেখে ভুপাল এগিয়ে এসে কী ভাবে উঠতে হবে দেখিয়ে দিল। ব্যাস আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। তরতরিয়ে উঠে গেলাম ফুট দশেক উপরে। রডোডেনড্রন ফুল এল আরও কাছে। স্পর্শ করলাম, ছবি তুললাম। বললাম, এ বার আমায় যেতে হবে।

রডোডেনড্রন তো যেতে দিতে চায় না। সে যেন চায় রাতের আঁধারে চাঁদের আলোয় নীল আকাশের চাঁদোয়ার নীচে মেঘের বিছানায় রাত কাটিয়ে দিই।

না লাল রূপসী। এ বার আমায় যেতেই হবে। আবার দেখা হবে একদিন।

অরূপদা ডাকাডাকি করছে। ঘোর কাটিয়ে নীচে নেমে আবার গাড়িতে গিয়ে বসলাম। ইচ্ছা করছে এখানেই থাকি আজকের রাতটা। কিন্তু বাস্তব বড়ো কঠিন ঠাই। সেখানে ইচ্ছার বড়ো একটা মূল্য নেই।

near zuluk
জুলুকের কাছে।

গাড়ি চলছে, জুলুকের দূরত্ব ক্রমশ কমছে। আকাশে বাড়ছে মেঘের ঘনঘটা। আধ ঘন্টার মধ্যেই পৌঁছে গেলাম আমাদের আজকের গন্তব্য জুলুকে। ঘড়ি বলছে এখন বিকাল চারটে। ঘড়ি যা-ই বলুক তাতে আমাদের কিছু যায়-আসে না। আজ আমরা সময়ের দাসত্ব শৃঙ্খলকে ছিন্ন করে ফেলেছি। গাড়ি থামল, শুরু হল টিপ টিপ বৃষ্টি । (চলবে)

ছবি লেখক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *