রহস্যময় রেশম পথ / পর্ব ৬ : অরিটার হয়ে রংলি ছুঁয়ে জুলুকের পথে

aritar lake
sudip paul
সুদীপ পাল

আজ আমাদের গাড়ি ও ড্রাইভার বদল হয়েছে।  রিশিখোলায় প্রাতরাশ সেরে মহীন্দ্রা কোম্পানির একটি গাড়িতে যাত্রা শুরু করেছি। সারথিও বদল হয়েছে। পেয়েছি ভূপাল ছেত্রীকে।

রিশিখোলার কাছেই রুংডিং দিয়ে যাওয়ার সময় ভূপাল বলল- “এখানে একটা মন্দির আছে। বিশ্ববিনায়ক মন্দির। যাবেন?”  যাব না মানে? আলবাত যাব। বেড়াতেই তো এসেছি। দু’-তিন মিনিটের মধ্যেই বিশ্ববিনায়ক মন্দির পৌঁছে গেলাম। বিশাল আকারের গণেশ মন্দির। ইট, বালি, সিমেন্টের তৈরি মন্দিরের গায়ে শিল্পকর্ম বিশেষ কিছু নেই তবে মন্দিরের ভিতরে বিশাল গণেশমূর্তিটি খুব সুন্দর। হলুদ ও রুপোলি মূর্তির দু’ দিকে ৮টি করে ১৬টি হাত আছে। রুপোলি পদ্মফুলের উপর গণেশ উপবিষ্ট। ফলকে দেখলাম সিকিমের মুখ্যমন্ত্রী পবন চামলিং ২০০৮-এর ২০ এপ্রিল এই মন্দিরের শিলান্যাস করেন। মন্দিরের দরজা খোলে ২০১৬ সালের ৩ অক্টোবর।

Vishwa Vinayak temple
বিশ্ব বিনায়ক মন্দির।

কাল রিশিখোলা নদীতে স্নান করেই হোক বা অন্য কোনো কারণেই হোক, রাত থেকে রূপের জ্বর এসেছে। আমরা মন্দির দর্শন করলেও মৌসুমী গাড়িতেই ছিল ছেলেকে নিয়ে। আমাদের পরবর্তী গন্তব্য লামপোখরি লেক। নেপালি ভাষায় ‘পোখরি’ শব্দের অর্থ পুকুর। লেকটা অরিটারে, তাই একে অরিটার লেকও বলা হয়।

লেকে ঢোকার মুখেই সবার টিকিট, পার্কিং চার্জ, সব মিটিয়ে ফেলতে হল। গাড়ি সমেত ভিতরে ঢুকে গেলাম। আমরা গাড়ি থেকে নেমে এলেও মৌসুমীকে গাড়িতেই থাকতে হল। ছেলেটা ঘুমোচ্ছে। গাড়িতে বসেই অবশ্য সে লেক দেখতে পাচ্ছে।

rungding
রুংডিং গ্রাম।

পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলাম লেকের ধারে। পান্না সবুজ লেকের ধারে দু’টো রাজহাঁস খুনসুটি করছে। লেকের ধারে গোলাপ ও অন্যান্য ফুলের গাছে ফুল ফুটে আছে। এখানকার উচ্চতা ৪৬০০ ফুট। ঠান্ডা বা গরম, কোনোটাই অনুভূত হচ্ছে না। লেকের দৈর্ঘ্য ১১২০ ফুট ও ২৪০ ফুট চওড়া। উপর থেকে লেকটা পুরো বুটের মতো লাগে, তাই অনেকে একে বুট লেকও বলে।

লেকের ধার বরাবর রেলিং দেওয়া রাস্তা। হাঁটতে হাঁটতে প্রায় অর্ধেক চলে এসেছি। পান্না সবুজ জলে বোটিংও করছে কেউ কেউ। আমার নিশ্চিত ধারণা জলে প্রচুর পরিমাণ ফাইটোপ্ল্যাংটন থাকার কারণে জলের রং সবুজ। পাইন ও অন্যান্য গাছে ঘেরা লেকের ওপারে একটা ছোটো মন্দির। সম্ভবত শিবমন্দির।

ratay khola falls
রাতেখোলা ফল্‌স।

আধ ঘণ্টা কাটিয়ে গাড়িতে ফিরে এলাম। যেতে হবে বহু দূর। মাঝে রংলিতে অনেকটা সময় ব্যয় হবে। যেতে যেতে গাড়ি থেকে অরিটার জায়গাটা দেখে মনে হল বেশ বর্ধিষ্ণু এলাকা। বাড়ি, হোটেল সবই সুদৃশ্য ও সাজানোগোছানো। জায়গাটা সিকিমে। আমি আজ পর্যন্ত সিকিমে কোথাও ঝুপড়ি বা ভাঙাচোরা বাড়ি দেখিনি।

রংলির পথে চলতে চলতে পেয়ে গেলাম একটা ঝরনা, বোর্ডে লেখা ‘রাতেখোলা ফলস’। জায়গাটার নাম দালাপচাঁদ। গাড়ি দাঁড় করিয়ে নেমে এলাম। প্রায় ৮ ফুট উপর থেকে ক্ষীণকায়া এই ঝরনা ঝাঁপ দিয়ে পড়ছে। তার পর রাস্তা পেরিয়ে পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে রংপোখোলায় মিশেছে। এ জায়গার উচ্চতা অরিটারের থেকেও কম, মাত্র ৩১৫০ ফুট। আমরা ক্রমশ নীচের দিকে নামছি। রংলির উচ্চতা আরও কম, ২৭০০ ফুট।

writer with dilip raj pradhan
দিলীপরাজ প্রধানের সঙ্গে লেখক।

কিছুক্ষণের মধ্যে আমরা রংলি চলে এলাম। গাড়ি সোজা মঙ্গলদীপ রিসর্টের সামনে এসে থামল। আমার পূর্ব-পরিচিত দিলীপরাজ প্রধান এই রিসর্টের মালিক। তিনিই আমাদের এই ট্যুরের ব্যাবস্থাপনার দায়িত্বে। গাড়ি থেকে নেমে রিসেপশন কাম অফিসে ঢুকলাম। ভিতরে দিলীপজি চেয়ার-টেবিলে বসে কিছু লিখছিলেন। আমাদের দেখে উঠে দাঁড়িয়ে এক গাল হেসে অভ্যর্থনা জানালেন। তার সঙ্গে এই প্রথম সাক্ষাৎ আমাদের। আলাপ-পরিচয়ের মধ্যেই ধপধপে সাদা কাপ-প্লেটে চা এল।

সিল্ক রুট বা রেশম পথে যাওয়ার অনুমতি নিতে হয় রংলি থেকেই। দিলীপজি আমাদের জন্য সেই অনুমতির আবেদনপত্র পূরণ করে ভূপালের হাতে ধরিয়ে দিলেন। রিসর্টের লনে চলে এলাম। দিলীপজি আমাদের সবাইকে খাদা পরিয়ে সম্মান জানালেন। খাদা হল মাফলারের আকারের একটা রেশম বা টেরিকটের কাপড়। সিকিমে এটাই সম্মান জানানোর রীতি। এমন সম্মান আমি বা আমাদের দলের কেউই আগে কখনও পায়নি। আমরা অভিভূত।

rongli market
রংলি বাজার।

রংলি বাজারে গাড়ি দাঁড় করিয়ে ভূপাল পারমিশন করাতে গেল। এই ফাঁকে আমরা কিছু ওষুধ কিনে নিলাম। অরূপদা  সেলুনে ঢুকল। সেলুনে তো রীতিমতো পাখা চলছে। বেশ গরম এখানে। কপালে ঘাম জমছে বুঝতে পারছি। কিছুক্ষণ ভূপাল অনুমতিপত্র নিয়ে এল। বিরতি শেষে আবার আমাদের যাত্রা শুরু হল।

রংলি থেকে রাস্তা চড়াই হচ্ছে পরিষ্কার বুঝতে পারছি। কিছুটা যাওয়ার পর ভূপাল গাড়িটা রাস্তার এক ধারে দাঁড় করিয়ে দিল। আমরাও গাড়ি থেকে নেমে পড়লাম। জায়গাটার নাম শিস্নে। আমাদের ডান দিকে সুগভীর খাদ থাকলেও অনেকটা নীচে একটা সেতু সামনের পাহাড়ের সঙ্গে সংযোগ রক্ষা করছে। আর কংক্রিটের সেতুর পাশেই একটা মনোরম ঝরনা পাশের পাহাড় থেকে দৌড়ে এসে সোজা খাদে ঝাঁপ দিয়েছে। ঝরনার নাম ভুতখোলা ফলস। আমরা যেখানে আছি সেখান থেকে ঝরনার কাছে যাওয়ার কোনো উপায় নেই। যেতে হলে আমাদের পিছনে ফিরে যেতে হবে এবং অনেকটা ঘুরে ঘুরে যেতে হবে। কাছে গেলে ঝরনাটা সামনে থেকে দেখতে পাব ঠিকই, কিন্তু বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে সবুজ পটভূমিতে আমরা সাদা ঝরনার যে রূপ এখান থেকে দেখতে পাচ্ছি সেটা কোনো মতেই পেতাম না।

bhootkhola falls
ওই দেখা যায় ভুতখোলা ফল্‌স।

রংলিতে যেমন একটা গরম ভাব ছিল এখানে সেটা নেই। কিন্তু ঠান্ডাও নেই। বেশ মনোরম একটা তাপমাত্রা। আমাদের সামনে সবুজ গাছে মোড়া উঁচু উঁচু পাহাড় পরিষ্কার বুঝিয়ে দিচ্ছে আমরা আরও অনেক উপরে উঠব অর্থাৎ আমাদের জন্য আরও অনেক সৌন্দর্য নিয়ে প্রকৃতি অপেক্ষা করছে। পাহাড়ের গা বেয়ে আমরা যত যাচ্ছি ততই উচ্চতা বাড়ছে একটু একটু করে, তার কারণে তাপমাত্রাও ক্রমশ কমছে। গাছপালার ধরনও বদলে যাচ্ছে। প্রকৃতির রূপ আরও খুলছে।এক সময় গাড়ির জানলার কাচ তুলে দিতে হল। গাড়ি এসে থামল লিংতামে।

lingtam
পুলিশ চৌকিতে পরীক্ষা হোল অনুমতিপত্র। লিংতাম।

লিংতাম একটা ট্যুরিস্ট স্পট। সিল্করুটগামী অনেক ট্যুরিস্টই এখানে একটা রাত কাটিয়ে যান। রাস্তার ধারে বাড়ি, হোটেল, হোমস্টের ছড়াছড়ি। আমরা এখানে থাকব না বা ঘুরে দেখবও না। পুলিশ চেকপোস্টে অনুমতিপত্র দেখিয়ে এগিয়ে যাব। ভূপাল গাড়ি থেকে নেমে অনুমতিপত্র দেখিয়ে আবার ফিরে এল। মিনিট পাঁচেকের বিরতি শেষে আবার যাত্রা।

আরও পড়ুন: রহস্যময় রেশম পথ / পর্ব ৫ : রিশিখোলার আলোছায়া

লিংতাম থেকে যত সামনে এগোচ্ছি পাহাড়গুলো ততই বিশালাকৃতি হয়ে উঠছে। আমাদের ফেলে আসা পথ পাশের পাহাড়ের গায়ে আলপনা এঁকে এগিয়ে গিয়েছে দেখতে পাচ্ছি। নীচের দিকে তাকালে মাথা ঘুরে যাওয়ার উপক্রম। ভূপাল একটা উঁচু পাহাড়ের মাথার দিকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বলল, “ওই পাহাড়ের মাথায় আমরা যাব। ওই যে সাদা বাড়িটা দেখা যাচ্ছে বিন্দুর মতো, ওখানেই যাব।“

after lingtam
লিংতাম ছাড়িয়ে ফেলে আসা পথ।

যাব তো বুঝলাম কিন্তু এর উচ্চতা এখান থেকে অনেক। এমন এক জায়গায় আছি যেখান থেকে নীচের দিকে তাকালে মনে ভীতির সঞ্চার হয়, আবার উপর দিকে গন্তব্যের দিকে তাকালেও প্রাণে ভীতির সঞ্চার হয়। আমাদের বুক ঢিপ ঢিপ করলেও ভূপাল কিন্তু ভীষণ স্বাভাবিক। সে হাসছে, গল্প করছে। তার কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। উচ্চতায় আমার একটু ভয় আছে যার কারণে ছাদের চওড়া রেলিং পেলেও সেখানে বসতে পারি না বা উঁচু দোলনায় চাপতে পারি না। মনে হয় মাথা ঘুরে পড়ে যাব। আমার কথা বাদ দিলাম, দলের বাকিদের মুখেও তেমন সাড়াশব্দ পাচ্ছি না। সব নির্বাক হয়ে আছে।

সব কিছুরই শেষ আছে। এই পথেরও শেষ হল এক সময়। সেই পাহাড়ের মাথায় এলাম অবশেষে। জায়গাটার নাম নিমাচেন। উচ্চতা ৩৬০০ ফুট। রংলির উচ্চতা ২৭০০ ফুট। এত উঁচু উঁচু পাহাড় পেরিয়ে মাত্র ৯০০ ফুট উচ্চতা বাড়ল! এখন যে উচ্চতায় আছি আজই এর প্রায় তিন গুণ উচ্চতায় পৌঁছোব আমরা। আমাদের আজকের গন্তব্য জুলুক, উচ্চতা ৯৫০০ ফুট। (চলবে)

ছবি লেখক

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *