
ফুলের গ্রাম ইচ্ছেগাঁও
পিচ রাস্তা ধরে কিছুটা যাওয়ার পরেই গাড়ি ডান দিকের কাঁচা রাস্তা ধরে উপরে উঠতে শুরু করল। এই পথই আমাদের নিয়ে যাবে ইচ্ছেগাঁও। পাকদণ্ডি পথের দু’পাশে সিঙ্কোনা গাছের চাষ। গুল্ম শ্রেণির গাছ, লালচে সবুজ পাতা। পাতার আকার অনেকটা জাম পাতার মতো। আশেপাশের সমগ্র অঞ্চলই ইচ্ছা ফরেস্টের অন্তর্গত। এই জঙ্গলে বিভিন্ন পাখি ছাড়াও ভাল্লুক, পাহাড়ি ছাগল, চিতা প্রভৃতি আছে। তবে এখানকার বন্য জন্তুরা মানুষের থেকে অনেক দূরে থাকে।
আরও পড়ুন রহস্যময় রেশম পথ / পর্ব ২: স্নিগ্ধতায় ভরা রামধুরাকে বিদায়
কাঁচা রাস্তা হওয়ার কারণে মাঝেমাঝেই গাড়ি দুলছে বা ঝাঁকুনি খাচ্ছে। জঙ্গলের মধ্য দিয়ে গিয়েছে বলে এ রাস্তা পাকা করা হয় না। বন দফতর অনুমোদন দেয় না। খুব চওড়া রাস্তা না হওয়ায় সামনে থেকে কোনো গাড়ি এলে এক ধারে সরে দাঁড়িয়ে সামনের গাড়িকে পাশ দিতে হয়।

৩ কিমি রাস্তা পেরিয়ে ইচ্ছেগাঁও পৌঁছে দেখি ৪/৫ টা ট্যুরিস্ট গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। কিছু ট্যুরিস্ট বেরিয়ে যাওয়ারও তোড়জোড় করছে। ওঁরা হয়তো রাতে এখানেই ছিল। আমরা গাড়ি থেকে নেমেই ফোটোসেশন শুরু করে দিলাম। আকাশ মেঘলা। গায়ে দু-এক ফোঁটা বৃষ্টিও পড়ল। স্বাভাবিক ভাবেইই কাঞ্চনজঙ্ঘার দেখা নেই।
এ বার গ্রাম পরিদর্শনের পালা। রাস্তা একটুও সমতল নয়। রাস্তার ঢাল বেয়ে বা সিঁড়ি দিয়ে উঠতে হবে। গ্রামের মধ্যে হয় বড়ো এলাচের চাষ, মা হয় ফুলের বাগান। সব বাড়িই একতলা। আর প্রায় সব বাড়িতেই হোমস্টে।
দু’পাশে ফুলের বাগানের মাঝ দিয়ে পথ। দেখে মনে হচ্ছে, বাড়িগুলোই বাগানের। ঘুরতে ঘুরতে মনে হয় এ বুঝি কোনো এক ইচ্ছে-পরীর রাজ্য। ইচ্ছে-পরীর জাদুকাঠির স্পর্শে সমগ্র গ্রাম ফুলবাগানে পরিণত হয়েছে। যে দিকে তাকাই, সে দিকেই গোলাপ, চেরি গোল্ড, পপি প্রভৃতি ফুল ফুটে আছে।

মৌমাছিরা এক ফুল থেকে আর এক ফুলে মধু খেয়ে বেড়াচ্ছে। তাদের দু-একজন আমার ক্যামেরায় ধরা পড়ে গিয়েছে বুঝতে পেরেই লজ্জ্বায় উড়ে পালিয়ে গেল।
ঘুরতে ঘুরতে কখন যে দলছুট হয়ে পড়েছি খেয়াল নেই। যখন খেয়াল হল ততক্ষণে গ্রামের সব থেকে উঁচুতে যে বাড়ি সেখানে পৌঁছে গিয়েছি। মহিলারা গৃহকর্মে ব্যস্ত। কেউ কেউ নির্লিপ্ত ভাবে আমার দিকে এক ঝলক তাকিয়ে দেখল, কেউ বা সেটাও করল না। আমি কেমন একটা ঘোরের মধ্যে আছি। কোন রাস্তা দিয়ে উঠে এসেছি ঠাহর করতে পারছি না। একবার একটা রাস্তা দিয়ে নামতে গেলাম, কিছুটা গিয়ে মনে হল, নাঃ এ রাস্তা দিয়ে তো আসিনি। আবার ফিরে এলাম আগের রাস্তায়। বেশ হয়েছে হারিয়ে গেছি। মেঘ, মৌমাছি, ফুলেদের সঙ্গে আমার অভিসার না হয় আরও কিছুক্ষণ চলবে।

ঘুরপাক খেতে খেতে এক সময় নীচে নেমেও এলাম। হঠাৎ নজরে এল কিছু চড়ুই গাছের ডাল, বাড়ির চালে উড়ে বেড়াচ্ছে। এখানেও চড়ুই আছে দেখে অবাক হলাম, কিন্তু বেশ ভালো লাগলো। আমাদের ওখানে তো এখন আর চড়ুই দেখাই যায় না বলতে গেলে।
একজন গ্রামবাসীর কাছে বড়ো এলাচের খোঁজ করলাম। সে জানাল তার কাছে তো নেই-ই, গ্রামেও কারও কাছেই নেই। কয়েক মাস আগে এলাচের দাম উঠেছিল ৫০০ টাকা কেজি। তখনই যার কাছে যা এলাচ ছিল সব বিক্রি করে দিয়েছে।
আমরা ইচ্ছেগাঁও ভ্রমণের ইচ্ছা পূরণ করে যে পথে এসেছিলাম, সেই পথে ফিরে চললাম। পথে পড়ল সেই রামধুরা, যেখানে আমরা রাতে ছিলাম। রামধুরা ছাড়িয়ে এ বার বেশ কিছুক্ষণ চলতে হবে। পৌঁছোব আর এক গ্রামে যার নাম সিলেরি গাঁও।
সিলেরি গাঁও
ছোটো ছোটো বেশ কয়েকটা পাহাড়ি জনপদ পেরিয়ে এক সময় আমরা একটা মিলিটারি ক্যাম্পের সামনে এসে পৌঁছোলাম। পাইন গাছের সারি। তার পিছনে ক্যাম্প। সুরজকে গাড়ি থামাতে বললাম। গাড়ি থেকে নেমে ফটো তুলতে যাব তখন সামনের চৌকি থেকে একজন জওয়ান এসে বারণ করল। তার সঙ্গে কিছু কথা বলে উলটো দিকের উপত্যকায় গেলাম। আহা, কী সুন্দর! সবুজ ঘাসে মোড়া ছোট্ট উপত্যকা। দূরের পাহাড়গুলো নীলাভ হয়ে রয়েছে। হালকা হাওয়া দিচ্ছে। মন চাইছে এখানে কিছুক্ষণ বসে যাই। কিন্তু বসার উপায় নেই। ফিরে এলাম গাড়িতে।

আরও কিছুক্ষণ চলার পর গাড়ি বাঁ দিকে কাঁচা রাস্তা ধরে চলা শুরু করল। এবড়োখেবড়ো পাথুরে রাস্তা। সিলারি গাঁওয়ে যাওয়ার এই রাস্তা পর্যটকমহলে বড়ই কুখ্যাত। গাড়ি লাফাতে লাফাতে যায় বলে অনেকে মজা করে এই রাস্তাকে ড্যান্সিং রোডও বলে থাকেন। আসলে এটাও একটা বনাঞ্চল, তাই বন দফতর সড়ক পাকা করার অনুমতি দেয়নি।
বাঁ দিকে পাহাড়ের ঢাল উপরে উঠেছে আর ডান দিকে ঢাল নীচে নেমেছে। দু’দিকে পাইন ও অন্যান্য গাছের জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে আমাদের গাড়ি নাচতে নাচতে চলেছে। ভিতরে আমরাও গাড়ির সঙ্গে লাফাচ্ছি। অরূপদার একটু চোখ লেগে গেছিল, কিন্তু ঘুম চটকে গেল। আমি ক্যামেরায় তাক করে ছবি তোলার ব্যর্থ চেষ্টা করে চলেছি অনেকক্ষণ ধরে। গাড়ির ভিতর ঘোল ঘাঁটার মতো ব্যাপারটা বেশ মসৃণ ভাবেই হচ্ছিল। এমন সময় চোখে পড়ল ‘কোবরা লিলি’, এক ধরনের উদ্ভিদ। ব্যাস, সঙ্গে সঙ্গে নির্দেশ ‘গাড়ি থামাও’।

‘কি হল রে বাবা!’ – ড্রাইভার-সহ সঙ্গীদের সবার মনে এই প্রশ্ন। আমার দিকে সবাই তাকিয়ে। সে সবে ভ্রূক্ষেপ না করে সোজা গাড়ি থেকে নেমে এলাম। ‘কোবরা লিলি’র ছবি দেখেছি আগে, নিজের চোখে এই প্রথম দেখলাম। একদম ওল গাছের মতো একটা গাছ, তার গোড়া থেকে চকলেট রঙের অবিকল একটা সাপের ফনার মতো অংশ বেরিয়ে আছে। হঠাৎ করে গোখরো বা কেউটে জাতীয় সাপ বলে ভ্রম হতে পারে। ক্যামোফ্লেজ ধরতে শুধু প্রাণীরাই নয়, উদ্ভিদরাও যে কম যায় না এটা তার প্রমাণ।
ফোটো তুলে ফিরে এলাম গাড়িতে। সঙ্গীদের কৌতূহল নিরসন হল। ততক্ষণে আবার নাচ শুরু হয়ে গিয়েছে। তবে সব কিছুরই তো শেষ আছে। আমাদের ৪৫ মিনিটের নাচও এক সময় শেষ হল। সিলেরি গাঁওতে পৌঁছে দেখি নাচতে নাচতে আমার ছেলে কখন তার মায়ের কোলে ঘুমিয়ে পড়েছে।

রূপকে নিয়ে মৌসুমী গাড়িতেই বসে রইল। আমরা নামলাম। মেঘলা আকাশ। হালকা একটা ঠান্ডা ভাব। গ্রামের পিছন দিকটা পাঁচিলের মতো ঘিরে আছে একটা পাহাড়। পাহাড়ের উপরে ঝাউ জাতীয় এক ধরনের গাছ। শুনেছিলাম সিলেরি নামক এক ধরনের গাছের আধিক্যের জন্যই গ্রামের নাম সিলারি গাঁও। ওই ঝাউ জাতীয় গাছগুলোই কি তবে সিলেরি গাছ? জানি না।
কম-বেশি ১৫টা বাড়ি নিয়ে এই গ্রাম। প্রায় সব বাড়িই হোমস্টে। সামনে একটা বড়ো খেলার মাঠ। ৩/৪টে ছেলে এখানে ক্রিকেট খেলছে। মাঠের পাশেই অরুম লিলির ঝাড়। কিছু ফোটো তোলা হল।
সিলেরি গাঁওয়ে সে ভাবে দেখার কিছু নেই। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যও আহামরি কিছু নয়। তবে এখান থেকে ৩ কিমি হেঁটে রামেতি ভিউপয়েন্ট। সেখান থেকে তিস্তার অনেকগুলো বাঁক দেখা যায়। রামধুরা থেকে এ দৃশ্য আগেই দেখেছি তাই রামেতি যাওয়ার কোনো আগ্রহ নেই। ইচ্ছে গাঁওতেও সে ভাবে কিছু স্পট নেই, তবে ফুলের মেলা আছে, সিলেরিতে তা-ও নেই। শুনেছিলাম নতুন স্পটের টোপ দেওয়ার জন্য ট্যুর অপারেটরদের সৃষ্টি এই সিলেরি গাঁও। কথাটা যে কতটা সত্য এখানে এসে হাড়ে হাড়ে টের পেলাম। এক বার সিলেরি দেখার পর দ্বিতীয় বার কোনো ট্যুরিস্ট আর এখানে আসার ইচ্ছা প্রকাশ করবেন বলে মনে হয় না।
“মনটা একটু কফি কফি করছে বুঝলে সুদীপ” – অরূপদা বলে উঠল।

সামনেই একটা দোকান। ভাগ্য সুপ্রসন্ন। কফি পাওয়া যাবে। দোকানি আমাদের দোকানে বসিয়ে রেখে লাগোয়া বাড়িতে কফি বানাতে গেল। দোকানির বছর দুয়েকের শিশু সন্তানকে নিয়ে আমরা কফি আসা পর্যন্ত সময় কাটিয়ে দিলাম।
কফি খেলাম। বেশ ঝরঝরে লাগছে শরীর ও মন। এটারই বোধহয় অভাব ছিল। তাই এতক্ষণ কেমন যেন নেতানো মুড়ির মতো লাগছিল নিজেকে। সুরজ গাড়ি স্টার্ট দিল, আবার সেই ড্যান্সিং রোড ধরে নাচতে নাচতে এগিয়ে চললাম। (চলবে)