
রাস্তা থেকে দোতলা মনে হলেও বাড়িটা আসলে তিনতলা। রাস্তা থেকে একটা সিঁড়ি উপরে উঠে গিয়েছে তিন তলায়, একটা সিঁড়ি গিয়েছে নীচে রান্নাঘরে। রাস্তার সমানে যাকে গ্রাউন্ড ফ্লোর বলে মনে হচ্ছে সেটি আসলে ফার্স্ট ফ্লোর। আমাদের থাকার ব্যবস্থা তিনতলায়। এখানে দু’টি মাত্র ঘর।
আমরা যে ঘরে ঢুকলাম সেখান থেকে দূরের পাহাড়ে কালিম্পং এবং তিস্তার বাঁকগুলো বেশ দেখা যায়। অরূপদার ঘর থেকে দেখা যায় সামনের রাস্তা। সুন্দর পরিবেশ। বেশ নিরিবিলি। এই হোমস্টে চালান নরেন চামলিং এবং তাঁর বোন। তাঁদের একজন সহযোগী মহিলাও আছেন যিনি রান্না করেন।
রামধুরা ঢুকতেই ৪টে বেজে গিয়েছে। এখন কী খাব এই অবেলায়? ভাত খাওয়ার ইচ্ছা না থাকলেও ওঁদের অনুরোধে ডাল, তরকারি, আলুভাজা, স্যালাড ও ডিমের তরকারি দিয়ে অল্প ভাত খেলাম।
আরও পড়ুন রহস্যময় রেশম পথ / পর্ব ১ : তিস্তার সঙ্গ ছেড়ে রামধুরায়
বেলা পড়ে আসছে। একটু বাদেই সন্ধে হবে। কাল সকালেই রামধুরা ছেড়ে বেরিয়ে যাব। তাই সময় নষ্ট না করে আমি, মৌসুমী আর রূপ বেরিয়ে পড়লাম হেঁটে আশপাশ ঘুরে দেখার জন্য। অরূপদারা একটু পরে বেরোবে।
শুনেছি এখান থেকে ইচ্ছেগাঁও দেখা যায়। গাড়িতে মাত্র ৩ কিমি রাস্তা। হোমস্টে থেকে বাঁ দিকে রাস্তা দিয়ে হাঁটা শুরু করলাম। কয়েকটা ছেলে ফুটবল খেলছে রাস্তার উপর। তাঁদের একজনকে জিজ্ঞাসা করলাম, ইচ্ছেগাঁও কোনখান থেকে দেখা যাবে? খেলায় মনোযোগ থাকায় সে কোনো রকমে শুধু আঙুল দেখিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে বলল।

রাস্তার এক দিকে পাথরের দেওয়াল, অন্য দিকে বাড়িঘর। বাড়িঘরের ফাঁকে ফাঁকে নৈসর্গিক শোভা। এখানে সব বাড়ির সামনেই অল্প হলেও ফুল গাছ বসানো আছে। অনেকে রাস্তার ও পারে পাহাড়ের গায়েও ছোট্ট ফুলবাগান বানিয়ে রেখেছে। ছোটোরা ছোটাছুটি করছে। এরই মাঝে একজন ফুটফুটে কিশোরকে বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, ইচ্ছেগাঁও কোথা থেকে দেখা যাবে?

সে আঙুল দিয়ে বাঁকের মুখটা দেখিয়ে দিল। ওকে আমাদের সঙ্গে যেতে বললাম। আমার অনুরোধ উপেক্ষা না করে সে চলল আমাদের সঙ্গে। পায়ে পায়ে চলতে চলতে ছেলেটার সঙ্গে আলাপ হয়ে গেল। নাম আয়ুস, ক্লাস এইটে পড়ে। ওদেরও একটা হোমস্টে আছে।
বাঁকের কাছে এসে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে আয়ুস বলল – ওই যে ইচ্ছেগাঁও।
বড়ো বড়ো পাইন গাছের ফ্রেমে বাঁধানো এক টুকরো ছবি যেন ইচ্ছেগাঁও। রামধুরার উচ্চতা ৫৫০০ ফুট, ইচ্ছেগাঁও আর একটু উপরে, ৫৮০০ ফুট উচ্চতায়। আমাদের সামনে পাইনের রেলিং দেওয়া পথ এঁকে বেঁকে সামনে এগিয়ে গিয়েছে। মন চাইছে এগিয়ে যেতে। আয়ুসকে বললাম সে কথা। সে রাজি নয়। বলল, সন্ধে হয়ে আসছে, মা বকবে। এ বার পড়তে বসতে হবে।

পায়ে পায়ে ফিরে এলাম হোমস্টের সামনে। আকাশে তখন লালের প্রলেপ। কিছুক্ষণের মধ্যেই ঝুপ করে সন্ধ্যা নামবে। বেশ শীত শীত করছে। গায়ে কোনো গরম পোশাক নেই। তবুও মন চাইছে না চার দেওয়ালের আশ্রয়ে ফিরে যেতে। প্রকৃতির নেশায় বুঁদ হয়ে গিয়েছি। হোমস্টের সামনে এসে রূপকে অরূপদার কাছে পাঠিয়ে দিলাম। অরূপদার মেয়ে রাজন্যার সঙ্গে সে খেলতে চায়। আমি আর মৌসুমী হোমস্টে-তে না ঢুকে সোজা সামনে এগিয়ে গেলাম।
যত এগোই ততই যেন এগোনোর হাতছানি। ঝুপ করে কখন যে সন্ধ্যা নেমে গিয়েছে খেয়াল করিনি। পুব আকাশে পাইনের ফাঁকে উঁকি দিচ্ছে আসন্ন বুদ্ধ পূর্ণিমার চাঁদ। নাহ্, এ বার ফিরতেই হবে। রাস্তার ধারে আরও কিছু বাড়ি তৈরি হচ্ছে দেখলাম। আগামী দিনে এই শান্ত স্নিগ্ধ রামধুরার কী অবস্থা হতে চলেছে এ সব তারই ইঙ্গিত।

অনিচ্ছা সত্ত্বেও ফিরে এলাম হোমস্টে-তে। রাজন্যাকে আমাদের কাছে রেখে অরূপদা আর বৌদি একটু বাইরে পদচারণা করতে বেরোল বটে, কিন্তু আধ ঘণ্টার মধ্যেই ফিরে এল। বাইরে তখন ঠান্ডা হাওয়ার দাপট। ইতিমধ্যে চা আর পকোড়া এসে গিয়েছে। ঠান্ডায় জমিয়ে আড্ডা মারতে মারতে সে সব খেতে বেশ ভালোই লাগল।
বাইরের বারান্দায় এসে দেখি সামনের পাহাড়ে দীপাবলি। বিন্দু বিন্দু আলো গোটা পাহাড় জুড়ে। ঠান্ডা হাওয়ায় কাঁপিয়ে দিচ্ছে তবুও এ সৌন্দর্য ছেড়ে যেন যেতে পারছি না। ঘরে গিয়ে উইন্ডচিটার আর মাফলার পরে এলাম। ঠান্ডার কাছে পরাজিত হয়ে এই সৌন্দর্য কিছুতেই হাতছাড়া করা যাবে না।
“সুদীপ আমাদের কালকের প্রোগ্রাম কী?” – অরূপদার ডাকে সম্বিৎ ফিরল। সুরজের সঙ্গে কালকের প্রোগ্রাম নিয়ে আলোচনা করা দরকার। ডাকাডাকি করেও তার সাড়া পাওয়া গেল না। পরে হোমস্টে থেকে জানতে পারলাম, সে ইচ্ছেগাঁও গিয়েছে বন্ধুর বাড়ি। সেখানে রাতে থাকবে, সকালে চলে আসবে। ভীষণ বিরক্ত লাগছে ওর এ ভাবে আমাদের না জানিয়ে চলে যাওয়ার জন্য। গাড়িটাও খুব একটা জুতসই নয়। অ্যাক্সিডেন্ট করা অনেক পুরোনো মডেলের বোলেরো গাড়ি। লং জার্নিতে খুব একটা আরামদায়ক নয়। দিলীপজিকে ফোন করলাম। দিলীপজি কালকের দিনটা চালিয়ে নিতে বললেন, পরশু সকালেই নতুন গাড়ি পাব।

সাড়ে আটটা বাজে। এখানে সন্ধের পরেই দ্রুত রাত নামে। বেশ ঠান্ডা পড়েছে, তার উপর কনকনে ঠান্ডা হাওয়া বইছে। বাইরে আর থাকা যাচ্ছে না। নীচে ডাইনিংরুমে সবাই চলে এলাম রাতের খাবার খেতে। এ বেলার মেনু ভাত, ডাল, আলুভাজা, একটা তরকারি, মুরগির মাংস, পাঁপড়, স্যালাড আর আচার।
চমৎকার রান্না। খেতে খেতে দুই মহিলার সঙ্গে আলাপ-পরিচয় হয়ে গেল। ওরা সাড়ে ৯টার মধ্যে সব কাজ শেষ করে রান্নাঘরের পাট চুকিয়ে করে এক কিমি দূরে নিজেদের বাড়ি চলে যাবে। পুরো রাস্তাই হেঁটে যাবে এই ঠান্ডার মধ্যে। কাল সকালে আবার আসবে।
সকাল ৬টায় অরূপদার ডাকে ঘুম ভাঙল। অরূপদা কফির সরঞ্জাম নিয়ে বসে আছে। একটা ইলেকট্রিক কেটলিও নিয়ে এসেছে বাড়ি থেকে। সবাই উঠে পড়লাম। কফি খেতে খেতে বাইরে তাকালাম। তাকিয়ে বেশ হতাশই হলাম। আকাশ মেঘলা তাই কাঞ্চনজঙ্ঘার দেখা পেলাম না। এখান থেকে বেশ সুন্দর কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যায়। কুয়াশা হয়ে থাকায় তিস্তার বাঁকগুলোও অস্পষ্ট দেখাচ্ছে।

নীচে গিয়ে দেখি নরেন রান্নাঘরের কাজ এগিয়ে রাখছেন। মহিলারা সাড়ে ৭টায় আসবেন, তার পর চা আর ব্রেকফাস্ট পাওয়া যাবে। কফি খেয়েছি, তাই চা নিয়ে মাথাব্যথা নেই। সকাল সকাল রামধুরা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার ইচ্ছা। তাই ব্যাগপত্তর গুছিয়ে বেরোনোর প্রস্তুতিতে মন দিলাম।
৮টায় চা দিয়ে গেল। জানলার ধারে দাঁড়িয়ে চা খেতে খেতে বেশ একটা ভালোলাগা সকালকে খুঁজে পেলাম। হোক না মেঘলা আকাশ, হোক না কুয়াশা। তবু তো নতুন সকাল। আমার সামনের দৃশ্য যেন এক জলরঙে আঁকা ছবি। যেখানে অস্পষ্টতা থাকার কারণে কল্পনার তুলি চালানোর অবকাশ আছে।
তৈরি হয়ে ডাইনিংরুমে চলে এলাম সবাই। সুরজও এসে গিয়েছে। ব্রেকফাস্টে গরম গরম ঘুগনি, রুটি আর স্যালাড। এখানে পাতিলেবু পাওয়া যায় না। আমরা সঙ্গে করে কয়েকটা এনেছিলাম। তারই একটা কেটে ঘুগনিতে রস চিপে দিলাম। আহা যেন অমৃত খাচ্ছি। এখানে রুটিতে সামান্য বেকিং পাউডার দেয়। ফলে মোটা মোটা রুটিগুলো একদম নরম তুলতুলে হয়।

খাওয়া শেষ করে সুরজ গাড়ির ছাদে মালপত্র তুলে নিল। আমরাও সব কিছু চেক করে উঠে পড়লাম গাড়িতে। নরেন চামলিং হাত নেড়ে আমাদের বিদায় জানালেন। আমরাও তাঁকে এবং রামধুরাকে বিদায় জানিয়ে ইচ্ছেগাঁও-এর এর পথে যাত্রা শুরু করলাম। (চলবে)
ছবি: লেখক