২৬ এপ্রিল ২০১৮। রাত প্রায় সাড়ে ৮টা। শিয়ালদা স্টেশনে ডানকুনি লোকাল যখন থামল তখন আকাশ যেন ভেঙে পড়ার অবস্থা। দমদম থেকেই বৃষ্টি শুরু হয়েছে, শিয়ালদা পৌঁছোতে পৌঁছোতে একেবারে লাগামছাড়া। প্রচণ্ড বাজ, সেই সঙ্গে ঝড়। মনে হচ্ছে স্টেশনের শেডগুলো এখনই ভেঙে পড়বে। ঝাপটা খেতে খেতে কোনো রকমে লাগেজগুলো ট্রেন থেকে নামিয়ে মৌসুমী আর রূপকে নিয়ে এগোলাম ৯ নম্বর প্ল্যাটফর্মের দিকে। দার্জিলিং মেলের ঘোষণা এখনও হয়নি। প্ল্যাটফর্ম জলে থই থই।
আমাদের এই ট্যুরে আমাদের সঙ্গে সপরিবার চলেছে আমার সহকর্মী অরূপ গুহ। ৫ বছরের দু’টি শিশু-সহ আমাদের ৬ জন এর দল। সিল্ক রুটে যাওয়ার ইচ্ছা অনেক দিন ধরেই ছিল কিন্তু হয়ে উঠছিল না। শেষ পর্যন্ত সিল্ক রুটের সব থেকে সুন্দর রূপটা দেখার জন্য এপ্রিল মাসই বেছে নিলাম। এই সময় ওখানে বরফ আর রডোডেনড্রন, দু’টোই পাব। আবহাওয়াও অনুকূল থাকবে।
আরও পড়ুন ওখরে-হিলে-ভার্সে, যেন মেঘ-বালিকার গল্প
অরূপদাকে ফোন করে জানলাম, ওরাও স্টেশনে এসে গিয়েছে। জানাল, প্ল্যাটফর্মে যেখানে আমাদের বগিটা পড়বে সেখানে ওরা রয়েছে। ট্রেন দিয়ে দিয়েছে প্ল্যাটফর্মে। দু’পাশ থেকে বৃষ্টির ঝাপটায় ভিজতে ভিজতে চলে এলাম কামরার সামনে। অরূপদারাও ভিজে জবুথবু।
ট্রেন সময়মতোই ছাড়ল। কিন্তু নিউ জলপাইগুড়ি পৌঁছোল পাক্কা এক ঘন্টা লেটে। গাড়ির সারথি সুরজ বার তিনেক ফোন করে ফেলেছে ইতিমধ্যে। আমাদের এই ট্যুরে গাড়ি ও হোম স্টে ব্যবস্থা করার দায়িত্ব দেওয়া ছিল আমার পূর্বপরিচিত রংলিনিবাসী দিলীপরাজ প্রধানকে। সে-ই গাড়ি পাঠিয়েছে।
শিলিগুড়িতে অরূপদার পরিচিত একজনের বাড়ি আছে যা বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার হয়। সেখানে দু’খানা গেস্টরুমও আছে। আমরা সেখানেই গেলাম প্রথমে। স্নান সেরে, প্রাতরাশ শেষ করে চার ঘণ্টা লেটের বোঝা মাথায় নিয়ে আমাদের যাত্রা শুরু হল। পথে জল পরিশোধনের কারখানা থেকে ছ’টা পাঁচ লিটারের খাবার জলের জার তুলে নিলাম। শিলিগুড়িতে এমনিতেই জ্যাম থাকে। মহানন্দা ওয়াইল্ডলাইফ স্যাংচুয়ারি পেরোনোর পরেও দেখি জ্যাম। রাস্তার কাজ হচ্ছে। বার বার থেমে থেমে যাওয়া, গরম – এ সব কারণে সবাই একটু খিটখিটে হয়ে পড়েছে। তবে এটাও জানি, পাহাড়ে কিছুটা যাওয়ার পরেই মেজাজ পালটে যাবে সবার।
তিস্তাবাজার পৌঁছোতে পৌঁছোতে আরও এক ঘণ্টা লেটের বোঝা চেপেছে। তবে সবার মেজাজ একদম ফুরফুরে। পাহাড়ে ওঠার পর থেকেই তিস্তা আমাদের সঙ্গী। তিস্তাবাজারে তিস্তার রূপ যেন আরও বিকশিত। গাড়ি থেকে নেমে দু-চারটে ফটো তুলে, পাহাড়ি শশা খেয়ে ফের যাত্রা।
এখান থেকে রাস্তা দু’ ভাগ। একটা রাস্তা নীচের দিকে নেমে গিয়েছে দার্জিলিং-এর উদ্দেশে। আর একটা রাস্তা সামান্য কয়েক মিটার এগিয়ে ব্রিজ পেরিয়ে তিস্তার ধার ধরে এগিয়েছে। খানিকটা গিয়ে রাস্তা ফের দু’ ভাগ। ডান দিকের পথ উঠে গিয়েছে কালিম্পং-এ। সোজা রাস্তা গ্যাংটকের। আমাদের আজকের গন্তব্য রামধুরা। এনজেপি থেকে ৮২ কিমি।
এ পথে তিস্তা আবার সঙ্গী, রাস্তার বাঁ দিকে। তিস্তার অপার সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হবে না এমন কোনো বেরসিক মানুষ পৃথিবীতে নেই, এটা হলপ করে বলতে পারি। পথে মেল্লিতে দেখলাম তিস্তার বুকে রিভার র্যাফটিং হচ্ছে। আমাদের মনও তিস্তার স্রোতে বহমান। তিস্তার তুঁতে রঙের জলে যেন কোনো জাদু আছে। যে দেখে সে-ই তিস্তার প্রেমে পড়ে যায়।
সব কিছুরই শেষ আছে। তিস্তার সঙ্গে আমাদের সাহচর্যও এক সময় শেষ হল। গাড়ি ডান দিকে বেঁকে গিয়ে ন্যাশনাল হাইওয়েকে ছেড়ে দিল। পাহাড়ে সৌন্দর্যর কোনো অভাব নেই। দু’পাশের ঘন সবুজ বনানী। তার মধ্যে দিয়ে আলপনার মতো রাস্তা ক্রমশ উপরের দিকে উঠছে। উচ্চতার সঙ্গে সঙ্গে ঠান্ডা। এ ঠান্ডা অবশ্য আরামদায়ক, সোয়েটার পরতে হয় না, অনুভব করতে হয়।
তন্ময় হয়ে দেখছিলাম গাড়ির জানলা দিয়ে। সুরজ এক সময় গাড়ি দাঁড় করিয়ে দিল। ঝপাঝপ নেমে পড়লাম। ওরে বাবা! বাইরে বেশ ঠান্ডা, গাড়িতে বসে বুঝতে পারিনি। যা-ই হোক, একটু পরেই ঠান্ডা সয়ে গেল। বদ্ধ গাড়িতে বসে কখনোই প্রকৃতির সৌন্দর্য সম্পূর্ণ উপভোগ করা যায় না এবং সেটা সম্ভব নয়। তার জন্য প্রকৃতির কোলে নিজেকে সঁপে দিতে হয়।
আরও পড়ুন জঙ্গল, পাহাড় ও কাঞ্চনময় তিনচুলে
সামনে অনেক দূরে পাহাড়ের সারি। সামনের পাহাড়েই কালিম্পং, যদিও হালকা কুয়াশায় কালিম্পংকে দেখা যাচ্ছে না। পাহাড়ের নীচে দিয়ে তিস্তা এঁকে বেঁকে বয়ে যাচ্ছে। এখান থেকে বেশ কয়েক কিমি তিস্তার গতিপথ দেখা যায়। হালকা কুয়াশায় কিছুটা অস্পষ্টতা থাকলেও শেষ বিকেলের সূর্যালোকে তা যেন রুপোর নদীতে পরিণত হয়েছে। চারিদিকে উজ্জ্বল সবুজের রাজত্ব। এখান থেকে যেতেই ইচ্ছা করছে না।
সুরজ বলল, “আমরা রামধুরা প্রায় এসে গিয়েছি। এটা একটা ভিউপয়েন্ট বুঝলেন তো।”
সুরজের কাছে এটা একটা ভিউপয়েন্ট হলেও আমার কাছে পুরো যাত্রা পথটাই হাজার হাজার ভিউ পয়েন্টের সমাহার। কিছুটা ছাড়া ছাড়াই মনে হয়েছে একটু দাঁড়িয়ে দেখি। মিনিট কুড়ি ধরে প্রকৃতির রসাস্বাদন করে আবার গাড়িতে উঠলাম। ভীষণ খাড়া রাস্তা। কিছুটা এগিয়ে রাস্তার ধারে বাঁ দিকে পড়ল বড়ো বড়ো গাছপালার মাঝে ব্রিটিশ আমলে তৈরি জলসা বাংলো। গেটে তালা ঝুলছে দেখে আর গাড়ি থেকে নামলাম না। দেখারও তেমন কিছু নেই মনে হল। জায়গাটা রামধুরাতেই পড়ে। আরও মিনিট দশেক চলার পর গাড়ি এসে থামল চামলিং হোম স্টে-র সামনে। এটাই আমাদের আজকের আস্তানা। (চলবে)
ছবি: লেখক