ওয়েনাড় থেকে মালাবার/১: পথের ধারেই হাতি-হরিণের সঙ্গে সাক্ষাৎ

শ্রয়ণ সেন

কেরলের ওয়েনাড়। পর্যটক-মানচিত্রে অতটা পরিচিত নাম না হলেও পর্যটন-বৈচিত্র্যে যে কতটা ভরপুর তা অনেকটাই বুঝলাম এই সুলতান বাথেরি আসার পথে। কর্নাটকের কুর্গ থেকে রওনা হয়েছি সক্কালেই। কুট্টা শহর দিয়ে কেরলে প্রবেশ করতেই চমক। শুরু হয়ে গেল ‘আপার ওয়েনাড় ওয়াইল্ডলাইফ স্যাঙ্কচুয়ারি’।

অভয়ারণ্যের মধ্যে দিয়েই প্রধান সড়ক। বেশ ঘন জঙ্গল। পরতে পরতে সতর্কবার্তা – যে কোনো মুহূর্তে বন্যজন্তু রাস্তা পেরোতে পারে। এক বার ডান দিক, পর ক্ষণেই বাঁ দিক, তাকাতে তাকাতে চলেছি। এই ভাবে ঘাড় ব্যথা হওয়ার আগেই চমক। বাঁ দিকে তাকাতেই লক্ষ করলাম দু’টো হরিণ আপন মনে নিজেদের কাজে ব্যস্ত। কোনো কিছুর তোয়াক্কা নেই যেন। ব্যাগ থেকে বেরিয়ে এল ক্যামেরা। কয়েকটা ছবি তুলে আবার রওনা। পরক্ষণেই আবার চমক। এ বার আর দু’টো নয়, তিনটে হরিণ।

পথের ধারে একাকী হাতি।

কিছুটা পথ এগোতেই আবার থমকালাম। এ বার ডান দিকে। হাতি। একলা, সঙ্গিহীন। গাড়ি থেকে নেমে সে দৃশ্য উপভোগ করছিলাম। ছবিও নিলাম। কিন্তু সতর্ক করলেন সামনের গাড়ির চালক। ইশারায় বুঝলাম, হাতি খেপে উঠতে পারে, তাই বেশিক্ষণ না দাঁড়ানোই ভাল। আসলে নাকি সঙ্গিহীন হাতির মতিগতি বোঝা ভার। অগত্যা আবার রওনা।

বেলা সাড়ে বারোটা নাগাদ পৌঁছোলাম সুলতান বাথেরি। কেরল পর্যটনের পেপার গ্রোভ হোটেলে চেক-ইন করে কিছুক্ষণ বিশ্রাম। সুলথান বাথেরির আগের নাম ছিল হন্নারেডু বিথি, যার অর্থ বারোটা রাস্তা। ৯৩০ খ্রিস্টাব্দে বয়ালনাড় অঞ্চল (এখনকার ওয়েনাড়) দখল করে গঙ্গারা। এর পর কদম্ব, হয়সালা, বিজয়নগর, ওয়াদিয়ার প্রভৃতি সাম্রাজ্যের হাত বদল হয়ে হায়দার আলির দখলে আসে এই বয়ালনাড়। আঠারো শতকে টিপু সুলতান এখানকার জৈন মন্দিরকে তাঁর বাহিনীর শিবির হিসেবে ব্যবহার করার ব্যবস্থা করেন। তখন শহরের নাম বদলে হয় ‘সুলতান’স ব্যাটারি’, এখন এটি প্রচলিত ‘সুলতান বাথেরি’ হিসেবে।

কেরল পর্যটনের পেপার গ্রোভ হোটেল।

মধ্যাহ্নভোজন সেরে বেরিয়ে পড়লাম মুথাঙ্গা অভয়ারণ্যের উদ্দেশে। শহর থেকে বেরিয়ে মহীশূরের পথে দশ কিমি যেতেই এসে গেল অভয়ারণ্যের প্রবেশদ্বার। লোয়ার ওয়েনাড় ওয়াইল্ডলাইফ স্যাঙ্কচুয়ারি হিসেবেও পরিচিত মুথাঙ্গা। কেরলের এই মুথাঙ্গা, কর্নাটকের বন্দিপুর আর তামিলনাড়ুর মুদুমালাই – এই তিন নিয়েই এখনকার নীলগিরি বায়োস্ফিয়ার রিজার্ভ। হাতির জন্যই এই অঞ্চল বিখ্যাত। জনপ্রতি ৭৫ টাকা, ক্যামেরার ২৫ আর জিপ সাফারির জন্য তিনশো টাকার টিকিট কেটে চড়ে বসলাম ফরেস্টের জিপে। গাইড হিসেবে পেলাম ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের এক কর্মীকে। এক ঘণ্টার জিপ সাফারিতে হরিণ চোখে পড়ল বেশি। সাফারির একদম শেষ লগ্নে হাতি-দর্শন দিল। একটা নয়, অন্তত জনা পাঁচেক। তবে বেশ কিছুটা দূরে। বিকেল ৪টে নাগাদ শেষ হল সাফারি।

হোটেলে ফেরার পথে শহরেরই মধ্যে দেখে নিলাম সেই ঐতিহাসিক জৈন মন্দির। চোদ্দো শতকের মন্দির। গ্র্যানাইট পাথরে তৈরি এই মন্দিরে কেরলের ঐতিহ্য মেনে রয়েছে গর্ভগৃহ, অন্তরাল, মহামণ্ডপ, মুখ্যমণ্ডপ আর নমস্কারমণ্ডপ। তবে নমস্কারমণ্ডপটি মূল মন্দিরের থেকে বিচ্ছিন্ন। গর্ভগৃহে কোনো মূর্তি নেই। মহামণ্ডপে রয়েছে জৈন প্রতিকৃতি। তিনি রয়েছেন পদ্মাসনে, ধ্যানমুদ্রার ভঙ্গিতে।

রাত পেরিয়ে সকাল হল। এই ওয়েনাড়কে আরও ভালো করে চিনতে হবে। তাই প্রথম গন্তব্য এড়াক্কাল গুহা। আমাদের হোটেলের কাছেই। হোটেল থেকে বেরিয়ে জাতীয় সড়কে কোড়িকোড়ের (কোঝিকোড়) দিকে সাড়ে পাঁচ কিলোমিটার যেতেই বাঁ দিকের একটা রাস্তার মুখে এড়াক্কালের দিকনির্দেশ দেখা গেল। ঢুকে পড়লাম। আরও কিলোমিটার পাঁচেক। এসে গেল এড়াক্কাল গুহার পাদদেশ। পাহাড়ে তো অল্পবিস্তর বিচরণ করেছি। কিন্তু আম্বুকুটি পাহাড়ের কোলে এই গুহায় ওঠার জন্য এই রকম কালঘাম এর আগে খুব কমই ছুটেছে।

এড়াক্কাল গুহার পথে।

জনপ্রতি ২০ টাকার টিকিট কেটে হাঁটা শুরু। প্রথম ৭০০ মিটার বাঁধানো রাস্তা দিয়ে পাহাড়ে ওঠা। তার পর বাঁধানো রাস্তা উধাও। পাহাড়ের গা বেয়ে খাড়া উঠে যাচ্ছে পথ। কিছুটা অংশ পাথরের ওপর দিয়ে সন্তর্পণে উঠে শেষ চড়াইটা সিঁড়িতে। এ সিঁড়ি সে সিঁড়ি নয়। একটা পাহাড়ের মাথা থেকে আরও একটা পাহাড়ের একটা ধাপকে যুক্ত করার জন্য ফাঁক ফাঁক লোহার সিঁড়ি। ধরার জন্য রয়েছে রেলিং। কারও মাথাঘোরার রোগ থাকলে তাঁর এই সিঁড়িতে না চড়াই ভালো। তবে এক বার ওপরে উঠে গেলে চার দিকের শোভায় মুগ্ধ হতেই হবে। প্রাগৈতিহাসিক যুগের মানুষের আঁকা গুহাচিত্রের জন্যই বিখ্যাত এই এড়াক্কাল। পাহাড়ের গায়ে খোদাই করা রয়েছে বিভিন্ন চিত্র। আমাদের চোখে এগুলো সাধারণ আঁকিবুঁকি হলেও তখনকার দিনের মানুষের কাছে নিশ্চয়ই এর কোনো তাৎপর্য ছিল।

সাড়ে দশটা নাগাদ নেমে এলাম আম্বুকুটি পাহাড়ের নীচে। পরের গন্তব্য পুকোট লেক। জাতীয় সড়কে উঠে ফের বাঁ দিক। আবার কোড়িকোড়ের দিকে গাড়ি ছুটল। পাহাড়ি পথ দিয়ে এগিয়ে চলেছি। রাস্তা মাঝে মাঝে পাহাড় বেয়ে উঠে যাচ্ছে ওপরে, আবার কখনও নীচে নামছে। আধ ঘণ্টা পর পৌঁছোলাম কালপেট্টা। ওয়েনাড় জেলার সদর। শহর থেকে চেম্ব্রা পিক দৃশ্যমান। সাড়ে ছ’হাজার ফুট উচ্চতার এই চেম্ব্রা পিক কেরলের দ্বিতীয় উচ্চতম আর ওয়েনাড় জেলার উচ্চতম পাহাড়শীর্ষ।

পুকোট লেক।

কালপেট্টা ছাড়িয়ে ভাইথিরি। পথ নির্দেশ মেনে ডান দিকে পুকোট লেকের দিকে গাড়ি ঘুরল। দেড় কিলোমিটার পেরোতেই এসে গেল এই বিরাট হ্রদ। এখানেও জনপ্রতি ২০ টাকা প্রবেশ দক্ষিণা। পশ্চিমঘাটের কোলে স্বচ্ছ জলের এই হ্রদের ধার দিয়ে পায়ে চলার পথ রয়েছে। অত্যুৎসাহী টুরিস্টরা বোটিং করছেন। আমরা অবশ্য লেকের ধার দিয়ে হাঁটাকেই শ্রেয় মনে করলাম। মিনিট কুড়ি সময় কাটিয়ে পার্কিং-এ ফিরে এলাম। গাড়ি ছুটল লক্কিড়ি ভিউ পয়েন্টের উদ্দেশে। (চলবে)

আরও পড়ুন: পলাশপার্বণে মনভোলানো তুলিনে

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top