পলাশপার্বণে মনভোলানো তুলিনে

শ্রয়ণ সেন

“দাদা, ওটা কী পাহাড়?”

ন্যাড়া মাথার একটা পাহাড়কে লক্ষ করে দারা সিংহজিকে প্রশ্নটা করেই ফেললাম। আমার দু’ দিকে দু’টো পাহাড় দেখা যাচ্ছে। বাঁ দিকের পাহাড়টা কিছুটা দূরে। ওটা বেশি নজর কাড়ছে, কারণ পাহাড়টা দেখতে বড়ো অদ্ভুত! কিছুটা দূরে হলেও, মনে হচ্ছে হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যাবে। 

“উটা বাংসা পাহাড় আছে বটে!”

“বাংসা! এমন অদ্ভুত নাম কেন?”

আমার দ্বিতীয় প্রশ্নটার কোনো সদুত্তর দিতে পারলেন না দারাজি। নামটা কিন্তু বেশ অদ্ভুত লাগল। আমরা এখন বৈকালিক হন্টনে বেরিয়েছি, কিন্তু বাংলোতে ফিরে গুগল জ্যাঠার শরণাপন্ন হতেই হবে। যতক্ষণ না এই বাংসা নামের উৎপত্তির কারণ বের করতে পারছি, আমার শান্তি নেই।

তবে বৈকালিক এই হাঁটাহাঁটির একটা উদ্দেশ্য রয়েছে। পলাশের সঙ্গে সাক্ষাৎ। সন্ধ্যা যখন প্রায় নামতে চলেছে, তখনই আমরা পৌঁছে গেলাম একটা পাহাড়ের পাদদেশে। দারাজির কথায় এই পাহাড়ের নাম সাপ পাহাড়।

সাপ পাহাড় নামটা শুনেও অদ্ভুত লাগল। কিন্তু পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে মনে হল, এর চেহারার সঙ্গে সাপের চেহারার কিছু মিল রয়েছে। সম্ভবত সে কারণেই এমন অদ্ভুত নাম।

চার দিকে শুধু পলাশ গাছের সারি। ডালে ডালে ফুটে রয়েছে পলাশ ফুল। প্রচুর ফুল মাটিতে পড়েও রয়েছে। শুরু হয়ে গেল পলাশ সংগ্রহ। আমরা মনস্থির করেই ফেলেছিলাম, কোনো ভাবেই গাছ থেকে পলাশ ফুল ছিঁড়ব না, মাটিতে যা পড়ে থাকবে, তাই সংগ্রহ হবে। যে যার বয়স ভুলে পলাশ সংগ্রহে নেমে পড়েছে। সেই সঙ্গে চলছে মাথার চুলে পলাশ ফুল লাগিয়ে ছবি তোলার পালা।

চলছে মাটি থেকে পলাশ কুড়নো।

কিন্তু বেশিক্ষণ থাকা গেল না। দারাজির হুঁশিয়ারি, অন্ধকার হয়ে গেলে নানা রকম জীবজন্তু বেরোতে পারে।

পলাশপার্বণে মেতে ওঠার উদ্দেশ্য নিয়ে আমরা কুড়ি জন ভ্রমণপাগলের দল আজ দুপুরেই এসে পৌঁছেছি তুলিন। উঠেছি এখানকার হেরিটেজ বাংলোয়। 

পুরুলিয়া জেলার পশ্চিম প্রান্তে ঝাড়খণ্ড সীমানা লাগোয়া এই তুলিনকে এখন আর গ্রাম বলা চলে না। তির তির করে বয়ে চলা সুবর্ণরেখার ধারে একটা ছোট্ট শহর এই তুলিন।

হাওড়া-রাঁচি শতাব্দী স্পেশাল বেলা পৌনে বারোটায় ঝাড়খণ্ডের মুরীতে আমাদের নামিয়ে ছুটে চলে গেল রাঁচির দিকে। স্টেশন থেকেই গাড়ি ছুটল। সুবর্ণরেখা পেরিয়ে ফের বাংলায় ঢুকলাম। শুরু হয়ে গেল তুলিন।

তুলিন বাজারের মধ্যে দিয়ে বেশ কিছুটা যাওয়ার পর ডান দিকে ঘুরলাম। একটা বিশাল বড়ো জমি। তার মাঝখান দিয়ে লাল মোরামের রাস্তা। বহু পুরোনো একটা বাড়িকে দুই ভাগ করে ভেঙে রাস্তাটা তৈরি করা হয়েছে। আরও কিছুটা যেতেই, এসে গেল তুলিন হেরিটেজ বাংলোর গেট।

যাত্রাপথের ক্লান্তি নিমেষের মধ্যে দূর হয়ে গেল এই বাংলোটা দেখেই। আমাদের আগামী দু’ দিনের রাত্রিবাস এখানে। বহু পুরোনো একটা বাড়ি। দেখে বোঝা যাচ্ছে, হেরিটেজ ব্যাপারটাকে রেখেই নতুন করে সাজিয়ে তোলা হয়েছে বাড়িটা। সামনে গোলাপ-সহ বিভিন্ন ফুলের বাগান। বাংলোর চত্বরে হরেক রকমের গাছ। সব মিলিয়ে শান্ত স্নিগ্ধ পরিবেশ।

কুড়ি জনের ব্যাগপত্তর কঠোর ভাবে স্যানিটাইজ করার পর যে যার ঘরে ঢুকলাম। আগামী দু’ দিন এই বাড়ির ৮টা ঘরই থাকবে আমাদের দখলে।

দু’তলা বাড়িটার একতলায় ছ’টা ঘর। একটা বিশাল বারান্দা এই ঘরগুলিকে জুড়ে রেখেছে। এক তলায় দুই প্রান্তে দু’টি বিশাল বসার জায়গা। শীতের দুপুর বা গরমের সন্ধ্যায় এখানে জমে উঠতে পারে আড্ডা।

বাংলোর বারান্দা।

দোতলায় যাওয়ার সিঁড়িটাও সেই পুরোনো দিনের মতো বিশাল বিশাল ধাপের। দলের ১৫ জনকে এক তলার ছ’টা ঘরে ঠাঁই দিয়ে আমরা পাঁচ জন গেলাম দ্বিতীয় তলে।

ঘরে ঢুকে ক্লান্ত শরীরটাকে বিছানায় এলিয়ে দিয়ে নিজের ছোটোবেলায় ফিরে গেলাম। ওপরে কড়িবরগার সিলিং। মনে পড়ে গেল, ছোটোবেলায় মামার বাড়িতে এইগুলোকেই বলতাম রেললাইন। এমনকি ট্রেন যাওয়ারও অপেক্ষা করতাম এই সিলিংয়ের ওপর দিয়…।

… ‘কু ঝিক ঝিক ঝিক’… ট্রেনের আওয়াজে ঘুমটা ভেঙে গেল। সিলিং দেখতে দেখতে কখন যে চোখ লেগে এসেছিল খেয়াল করিনি। ঘুম ভাঙতেই বুঝলাম ট্রেনলাইন কাছেই। হুইসল বাজিয়ে দুর্বার গতিতে ছুটে চলেছে ট্রেন।

যে ঘরে আমরা ছিলাম।

আসলে শেষ মার্চের গরমেও বাংলোর ঘরগুলো কী অদ্ভুত ভাবে ঠান্ডা। সে কারণেই চোখ লেগে এসেছিল। আমাদের ঘরের সামনে সুন্দর একটা ছাদ। সান্ধ্য আড্ডা আমাদের এখানেই বসবে।

স্নানপর্ব সেরে দুপুরের খাওয়াদাওয়ার পালা। পেটে ছুঁচোয় ডান মারছে। ভাত, ডাল, বাঁধাকপির তরকারি, মাছের কালিয়া, চাটনি, পাঁপড়-সহযোগে দুর্দান্ত মধ্যাহ্নভোজন সেরে ফেললাম। পেট শান্ত হল।

এই ধরনের বাড়ির এমন রাজসিক বারান্দা দিয়ে হেঁটে বেড়ানোর একটা আলাদা মাদকতা আছে। হাঁটতে হাঁটতেই চোখে পড়ল এক বৃদ্ধর ছবির দিকে। উনি শ্রী মহীমচন্দ্র দে। বর্তমানে এই হেরিটেজ বাংলোটির ব্যবসায়ে যিনি রয়েছেন সেই সিদ্ধার্থ দে’র ঠাকুরদা।

এই যে বাড়িটায় আমরা এখন রয়েছি, এর ঐতিহাসিক গুরুত্ব কিন্তু কোনো অংশে কম নয়।

কলকাতার দূষণ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য তিরিশের দশকে শ্রী মহীমচন্দ্র দে এই বাংলোসুলভ বাড়িটি তৈরি করেন সুদূর তুলিনে। কলকাতার খিদিরপুরে প্রায় তিনশো বছরের ঐতিহ্য রয়েছে এই দে পরিবারের। মহীমবাবুর দাদু শ্রী শ্যামাচরণ দে সরকার ১৯ শতকের গড়ার দিকে কলকাতার কালেক্টর ছিলেন।

বাংলোর বাইরে কুড়ি একর জমিতে চাষাবাদ হত। এই বাড়িতেই এক কালে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, বিমল মিত্র, মহিষাদলের রাজপুত্র, ঝালদার রাজাদের পা পড়েছে।

একটা সময়ে এখানে পশুশিকারও হত। বাড়িটার বারান্দাতেই তার অনেক নিদর্শন রয়েছে।

তুলিনের জন্য অনেক কিছু করেছেন শ্রী মহীমচন্দ্র দে। বিভিন্ন সামাজিক কাজে তুলিনকে সাহায্য করেছেন, রাস্তা তৈরির জন্য নিজের বাড়ির জমি দান করেছেন। এখনও তুলিনের প্রবীণরা শ্রী মহীমচন্দ্র দে’কে মনে রেখেছেন।

তুলিন হেরিটেজ বাংলো, রাতের বেলায়।

মহীমচন্দ্রবাবুর উত্তরসূরিরা ২০২০-তে সিদ্ধান্ত নেন নব রূপে এই বাংলো বাড়িটি সাজিয়ে তোলা হবে। পুরোনো সব কিছু অক্ষত রেখেও রঙ করে, আলো লাগিয়ে, এ ভাবেই গড়ে সাজানো হয়েছে তুলিন হেরিটেজ বাংলো। আর তার পরেই ধীরে ধীরে পর্যটকদের পা পড়তে শুরু করে তুলিনে।

তবে এখনও পর্যটকবর্জিত জায়গা এই তুলিন। সেটা বোঝা যায় স্থানীয় গ্রামবাসীদের অবাক চাহনিতে। তাই বিকেলে যখন গ্রামের কচিকাঁচাদের হাতে খাতা-পেন তুলে দিই, সব কিছুই অবিশ্বাস্য লাগে তাদের কাছে।

পলাশ ফুল কুড়িয়ে সন্ধ্যায় হোটেলে ফিরতেই মনে পড়ল গুগল জ্যাঠার শরণাপন্ন হতে হবে। ওই পাহাড়টার কেন এমন নাম, সেটা আবিষ্কার করতেই হবে। আর অবাক কাণ্ড, সেই তথ্য পাওয়াও গেল।

বাংসা পাহাড়ের পাদদেশে বাংসা গ্রাম। জনশ্রুতি যে এই গ্রামে এক বৃদ্ধ থাকতেন। তাঁর নাম ছিল বাংসাবাবা। বাংসাবাবাকে কোনো একদিন গ্রামের এক বাসিন্দা এঁটো থালায় খেতে দেন। এর পরেই নিরুদ্দেশ হয়ে যান বাংসাবাবা। বাংসাবাবাকে ফিরে পাওয়ার জন্য গ্রামবাসীরা পুজো করতে শুরু করেন। সেই থেকে বাংসাঠাকুরের পুজোর প্রচলন হয় আর তার থেকেই এই গ্রামের নাম এবং গ্রাম সংলগ্ন এই পাহাড়টির নাম হয় বাংসা পাহাড়।

চিরাচরিত অযোধ্যা পাহাড় নয়, পলাশের পুরুলিয়াকে অন্য ভাবে চিনতেই এই তুলিনকে বেছে নেওয়া হয়েছিল। নীরবে নিভৃতে সুন্দরকে উপভোগ করার মতো জায়গা এই তুলিন। পর্যটকদের ভিড়ভাট্টা নেই এখানে। আর তাই তুলিন অনন্য।

তবে এখান থেকেই খুব সুন্দর ভাবেই অযোধ্যা সার্কিটের সব জায়গা ঘুরে নেওয়া যায়, যেমনটা আমরা করলাম আমাদের অবসরযাপনের দ্বিতীয় দিনে।

মার্বেল লেক।

মুখোশের গ্রাম চড়িদা দেখে পৌঁছে গেলাম অযোধ্যা পাহাড়ের লোয়ার ড্যামে। সেখান থেকে আপার ড্যাম, মার্বেল লেকে কিছুক্ষণ সময়ে কাটিয়ে মধ্যাহ্নভোজন সারতে ফিরে চললাম তুলিনে।

পথে অবশ্য বিভিন্ন জায়গায় গাড়ি থেমেছে আমাদের। সুযোগ পেলেই মাটিতে পড়ে থাকা পলাশ ফুল কুড়োনোর প্রতিযোগিতা হয়েছে দলের সদস্যদের মধ্যে। আহ্লাদিত করেছে কুসুমগাছও।

দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতেই গাড়ি ছুটে চলল মুরগুমার দিকে। মুরগুমার এই রূপ আমার অচেনা। আগের বার এসেছিলাম বর্ষায়। কিন্তু বসন্তের মুরগুমাকে আরও বেশি রঙিন লাগছে। চারিদিকে নানা রকম রঙের মেলা।

এখানকার প্রধান আকর্ষণ মুরগুমা লেক, যার পোশাকি নাম সাহারাজোড় ইরিগেশন স্কিম। কংসাবতীর শাখা নদী সাহারাজোড়। তার ওপরেই তৈরি হয়েছে এই জলাধার, যা এখন মুরগুমা হ্রদের রূপ পেয়েছে। এখান থেকে অসাধারণ সূর্যাস্ত হয়। সূর্যের শেষ রশ্মি যখন হ্রদের জলে পড়ে তখন জলের অসাধারণ রঙের খেলা শুরু হয়, সেটাই মনভোলানো একটা ব্যাপার। আমরা তার কিছুটা টের পেলাম অবশ্য। মেঘ থাকার কারণে পুরোটা উপভোগ করতে পারলাম না। অবশ্য যতটুকু পারলাম, সেটাই বা কম কী!

দিনাবসানের পালা। বাঁধের ওপর দিয়েই কয়েক পাল গোরু। ফিরে চলেছে তাদের বাড়ি। বকে ধমকে, পিঠের ওপরে আলতো করে লাঠির বাড়ি মেরে তাদের শৃঙ্খলাবদ্ধ করার চেষ্টা করছেন গো-পালকরা।

মুরগুমায় দিনাবসান।

ঠিক একই ভাবে আমাদের দলনেত্রীও আমাদের শৃঙ্খলাবদ্ধ করার চেষ্টা করছেন। এ বার বাংলোয় ফিরতে হবে যে। দু’ দিনের অবসরযাপনের সময় প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। কালই আমাদের নিয়ে ট্রেন ছুটবে বাড়ির উদ্দেশে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *