ফের ডাকল দারিংবাড়ি ২/ তুষারপাতের ভ্রান্ত বিশ্বাস দূর করলাম

শ্রয়ণ সেন

“সবাইকে নমস্কার! রান্না ঠিকঠাক ছিল তো?”

সবে মাছের ঝোল দিয়ে ভাতটাকে মাখছি, ষাটোর্ধ্ব এক প্রৌঢ়ের আগমন। নিজেই নিজের পরিচয় দিয়ে বললেন তিনি এখানকার রাঁধুনি। ১৩ জনের ভাত, ডাল, সবজি, দু’টো করে মাছ, সব তিনিই রেঁধেছেন।

রাঁধুনি যেচে এসে খোঁজখবর নিয়ে যাচ্ছেন, এটা কিন্তু সচরাচর দেখা যায় না। রান্না কিন্তু সত্যিই দুর্দান্ত করেছেন তিনি। এতটা পথ এসে পেটেয় যে ছুঁচোয় ডন মারতে শুরু করেছিল, তা উধাও।

আমরা বসে আছি কটেজগুলোর সামনের বারান্দাটায়। সামনে একটা বিশাল পুকুর। সেখানে হাঁস খেলে বেড়াচ্ছে। পর্যটকদের বিনোদনের জন্য প্যাডেল বোট রয়েছে। পুকুরের একটা কোণে বাঁধা। ও দিকে রয়েছে এই রিসর্টেরই গেস্টহাউজের অংশটা।

পুকুরের অপর পারে গিয়ে, বেশ কয়েকটা সিঁড়ি উঠলে তবে গেস্টহাউজে পৌঁছোনো যায়। তবে সুবিধা হল, গেস্টহাউজটা এক্কেবারে মূল সড়কের ধারেই।

বৃষ্টি থেমে গিয়ে ফের একবার রোদ উঠেছে। পশ্চিম আকাশে পড়ন্ত সূর্যকে রেখেই কিছুটা হাঁটাহাঁটি করলাম। লাল মোরামের পথ এ-দিক সে-দিক ভেদ করে এগিয়ে যাচ্ছে। তিন হাজার ফুট উচ্চতায় কার্যত সমতলভূমি দারিংবাড়ি। খাপছাড়া কিছু পাহাড় কাছাকাছি থাকলেও পাহাড়ের মূল শ্রেণি দূরে সরে গেছে। ফলে হাঁটতে দারুণ লাগছে।

ইউক্যালিপটাসের সমারোহ।

তবে বেশিক্ষণ বাইরে থাকা গেল না। সূর্য ডুবতেই শীতটা আচমকা অনেকটাই বেড়ে গেল। ফুল সোয়েটারের ওপরে আর একটা হাফ সোয়েটার চাপিয়েও আর ঘরের বাইরে বসে থাকা যাচ্ছে না ঠান্ডার কারণে। অগত্যা ঘরের ভেতরে জমে উঠল সন্ধ্যার আড্ডা। ফুলকপির পকোড়া আর চা পাঠিয়ে দিয়েছে অবকাশ এবং বুধিয়া। এই ঠান্ডায় গরম চা-টা কিন্তু দারুণ লাগছে। 

দারিংবাড়ি সবারই প্রথম বার। আর এই ঠান্ডার দাপট দেখে দারিংবাড়ি নিয়ে যে ভ্রান্ত ধারণাটা সবার মধ্যে প্রচলিত, সেটা আবার চাগাড় দিয়ে উঠল অনেকের মনে। অর্থাৎ দারিংবাড়িতে সত্যিই বরফ পড়ে কি না।

অনেকের বিশ্বাস এখানে বরফ পড়ে। হিমালয়ে যেমন আকাশ থেকে কুচো কুচো বরফ নেমে আসে, তেমনই দারিংবাড়িতেও হয় বলে ধারণা। এই ভ্রান্ত বিশ্বাসকে খণ্ডন করতে আবার আমাকেই নামতে হল।    

প্রথমে সোজাসুজিই বলে দেওয়া ভালো যে দারিংবাড়িতে তুষারপাত হয় না। অতীতে কোনো দিনই দারিংবাড়িতে বরফ পড়েনি, আর ভবিষ্যতেও পড়বে না। তা হলে বরফ পড়ার প্রসঙ্গ আসছে কেন?

এটা স্রেফ সংবাদমাধ্যমের একটা অংশের তৈরি করে দেওয়া বিভ্রান্তি। যে বিভ্রান্তিতে সওয়ার হয়ে সাধারণ পর্যটকের একটা অংশ বিশ্বাস করেন এখানে বরফ পড়ে।

এই পথ ধরেই হাঁটাহাঁটি।

দারিংবাড়িতে তুষারপাত হয় না, কিন্তু শীতকালে মাঝেমধ্যে যেটা হয় তা হল গ্রাউন্ড ফ্রস্ট। অর্থাৎ, প্রবল ঠান্ডায় রাতে পড়া শিশিরই ভোরের দিকে জমে বরফ হয়ে যায়। ভোরবেলায় সাধারণ মানুষ ঘুম থেকে উঠেই খেয়াল করেন মাঠঘাটে সাদা বরফের একটা আস্তরণ তৈরি হয়ে গিয়েছে। প্রতি বছরই এই ঘটনাটি ঘটে। এমনকি এই শীতের মরশুমেও একবার হয়েছিল।

— “গ্রাউন্ড ফ্রস্ট এবং তুষারপাতের মধ্যে পার্থক্য কী?” – দলের এক সদস্যের কৌতূহলী প্রশ্ন।

তুষারপাত হতে গেলে প্রাথমিক ভাবে যেটা দরকার তা হল মেঘ এবং বৃষ্টি। বৃষ্টির পরিস্থিতি সৃষ্টি না হলে, কোনো ভাবেই তুষারপাত হবে না। অন্য দিকে গ্রাউন্ড ফ্রস্টের জন্য দরকার পরিষ্কার আকাশ, জম্পেশ ঠান্ডা।

ডিসেম্বরের শেষ দিক থেকে জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে দারিংবাড়ির সর্বনিম্ন তাপমাত্রা শূন্য ডিগ্রির কাছাকাছি চলে যাওয়া কোনো ভাবেই অস্বাভাবিক নয়। কারণ মধ্য ভারতের প্রবল ঠান্ডার প্রভাব পড়ে দারিংবাড়ি এবং সমগ্র কন্ধমল জেলা ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে। সর্বনিম্ন তাপমাত্রা শূন্যর কাছাকাছি চলে গেলেই দেখা দেবে গ্রাউন্ড ফ্রস্ট।

অন্য দিকে কখনও যদি শীতে দারিংবাড়িতে বৃষ্টির পরিস্থিতি তৈরি হয়, তা হলে কোনো ভাবেই সেখানে তুষারপাত হবে না। কারণ তুষারপাত হতে গেলে সর্বনিম্ন তাপমাত্রাকে পৌঁছে যেতে হবে শূন্যের কাছে আর দারিংবাড়িতে শীতে বৃষ্টি হলে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা কমবে তো না-ই, বরং অনেকটাই বেড়ে যাবে। কারণ বঙ্গোপসাগর থেকে জলীয় বাষ্প ঢুকবে এই অঞ্চলের ওপরে।

সূর্য গেল অন্তরালে।

এর পাশাপাশি উচ্চতাজনিত কারণও রয়েছে।

— “কখনও শুনেছেন রুদ্রপ্রয়াগে বরফ পড়ছে?”

আমার প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই কারও কাছেই। আমি আবার বলে চলি, রুদ্রপ্রয়াগ এবং দারিংবাড়ির উচ্চতা কিন্তু প্রায় একই রকম। হিমালয়ের কোলে অবস্থান করা রুদ্রপ্রয়াগেই যদি বরফ না পড়ে, তা হলে দারিংবাড়িতে বরফ পড়ার ব্যাপারটি সম্পূর্ণ অযৌক্তিক।

পাশাপাশি দারিংবাড়ি এক হাজার মিটার উচ্চতায় অবস্থিত হলেও নিরক্ষরেখার অনেকটাই কাছে। ফলে এখানে ক্রান্তীয় বা গ্রীষ্মপ্রধান আবহাওয়ার প্রাধান্যই বেশি। সুতরাং কোনো ভাবেই এখানে তুষারপাত সম্ভব নয়।

তা হলে ব্যাপারটা কী দাঁড়াল? দারিংবাড়িতে তুষারপাত হয় না। কিন্তু মাঝেমধ্যে গ্রাউন্ড ফ্রস্ট দেখা দেয়। তাই তুষারপাতের আকাঙ্ক্ষায় দারিংবাড়ি গেলে ব্যর্থ হবেন। কিন্তু আপনার ভাগ্য যদি অত্যন্ত ভালো হয়, তা হলে কড়া শীতের কোনো এক ভোরে দেখবেন আপনার ঘরের বাইরে শিশির জমে বরফ হয়ে গিয়েছে। এটাই দারিংবাড়ির সৌন্দর্য।

প্রায় এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলা শেষ করলাম। দারিংবাড়িতে বরফ পড়ার ভ্রান্ত ধারণাকে দূর করতে পেরে নিজেকেই বেশ তৃপ্ত লাগছে। তবে এটাও ঠিক যে কয়েক জন সদস্য এই বিষয়টা নিয়ে আগে থেকেই অবগত। বাকিদের ধারণাটা দূর করা গেল।

রাত বাড়ছে ক্রমশ। সেই সঙ্গে বাড়ছে নিস্তব্ধতা। সেই নিস্তব্ধতাকে ভেদ করে দূর থেকে নানা রকম ডাক ভেসে আসছে। তার মধ্যে শিয়ালের ডাকও রয়েছে বলে আমার বিশ্বাস।

কটেজবাসীকে আজকের মতো বিদায় জানিয়ে আমরা চার জন চলে গেলাম গেস্টহাউজে। আরও এক প্রস্থ আড্ডা, আর তার পরেই নৈশভোজন। রুটি-তরকারি-ওমলেট দিয়ে দুরন্ত খাওয়াদাওয়া হল।

রিসর্টের মালিক পিন্টুজি নিজের হাতেই পরিবেশন করছেন সব কিছু। এটাও কি কাকতালীয় ব্যাপার যে আমাদের সারথি এবং রিসর্ট মালিক, দু’জনেরই নাম পিন্টু।

তখনও উঁকি মারে সে।

কিন্তু দিন শেষ হওয়ার আগে দারিংবাড়িকে আরও এক প্রস্থ চেনা তখনও বাকি ছিল। ‘কৈলাশে কেলেঙ্কারি’-তে চট্টরাজের সেই কথাগুলো বেড়াতে এলে আমি সব সময় মাথায় রাখি, “আফটার ডিনার ওয়াক আ মাইল।” তাই বেড়াতে এলে সুযোগ থাকলেও ডিনারের পর একটু হেঁটে আসি। আর এখানে যখন হাঁটার এত সুবন্দোবস্ত, সুযোগ কি ছাড়া যায়!

কোনো জন্তুজানোয়ার বেরোবে না, পিন্টুজির থেকে এই আশ্বাস পেয়ে হাঁটতে বেরিয়ে পড়লাম। রাত তখন সাড়ে দশটা। আশেপাশে চূড়ান্ত নিস্তব্ধতা। তবে রাস্তায় এখন আলো লাগানো হয়েছে, ফলে চারিদিকে রোশনাই।

দারিংবাড়ির লাইনপাড়া অঞ্চলে অবস্থিত আমাদের রিসর্ট। গেস্টহাউজ থেকে বেরিয়ে বাঁ দিকে গেলে দারিংবাড়ির সেই চৌমাথা এবং ডাক দিকে সানসেট পয়েন্ট। সাত বছর আগে সানসেট পয়েন্ট যাওয়ার সময় এই রাস্তা দিয়েই গিয়েছিলাম। তখন কিন্তু এই অঞ্চলে এমন উন্নয়নের জোয়ার দেখা যায়নি।

লাইনপাড়ার ঠিক পড়শি পাড়া হল গ্রিনবাড়ি। কড়া শীতকে উপেক্ষা করেই আমরা হাঁটতে থাকি ক্রমশ। পুরো উপত্যকা অঞ্চল বলে হাঁটতে বেশ মজাই লাগছে। আকাশে অগুনতি তারা। এ এক অন্য রকম অনুভূতি।  

আচমকা খেয়াল হয়, গল্প করতে করতে প্রায় কুড়ি মিনিট হেঁটে ফেলেছি। ফের ঘুরে যাই রিসর্টের দিকে। বিছানা যে ডাকছে। (চলবে)

ছবি: লেখক

আরও পড়তে পারেন

ফের ডাকল দারিংবাড়ি ১/ বদলে গিয়েছে কত!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *