পুজোয় অদূরে ৬ / পটনা-বৈশালী

Golghar, Patna

বেড়ানোর কথা ভাবলে আমরা বিহারের কথা খুব একটা মাথায় আনি না। অথচ এই রাজ্যের পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে ইতিহাস। বুদ্ধদেব, মহাবীর, অজাতশত্রু, বিম্বিসার, চন্দ্রগুপ্ত, অশোক যে রাজ্যের সঙ্গে জড়িয়ে, যে রাজ্যে বিশ্বের প্রথম রিপাবলিকের পত্তন হয়, শরদিন্দুর ঐতিহাসিক উপন্যাসের ভিত্তি যে রাজ্য, সেই রাজ্যকে কি পর্যটন-মানচিত্রে ব্রাত্য রাখা যায়? আমাদের প্রতিবেশী বিহারে পৌঁছেও যাওয়া যায় সহজে। তাই এ বার গন্তব্য হোক বিহার, বিহারের মগধ। চলুন পুজোর ছুটিতে বেরিয়ে পড়ি, দিন পাঁচেকের মধ্যে ঘুরে আসি পটনা-বৈশালী।

ভ্রমণসূচি

প্রথম দিন – যাত্রা করুন পটনার উদ্দেশে।

কলকাতা থেকে পটনা যাওয়ার অনেক ট্রেন আছে। কিন্তু হাতে তো সময় নেই। রাতের ট্রেনে শোয়ার বার্থ পাওয়া মুশকিল। তাই হাওড়া থেকে ধরা যাক পটনা জনশতাব্দী এক্সপ্রেস। শেষ মুহূর্তেও জায়গা পেয়ে যাবেন এই ট্রেনে ট্রেনটি রবিবার বাদে প্রতি দিন দুপুর ২:০৫-এ হাওড়া থেকে ছেড়ে পটনা পৌঁছোয় রাত ১০:২০-তে।

কলকাতা থেকে পটনা বাসেও যেতে পারেন। সাধারণ থেকে বিলাসবহুল, সব রকম বাসই পাবেন। সারা দিনই চলে। খুব বেশি হলে ১০ ঘণ্টা সময় নেয়। বাসের জন্য কলকাতার বাবুঘাট বাসস্ট্যান্ডে খোঁজ করুন। আর আকাশপথ তো আছেই।

দ্বিতীয় ও তৃতীয় দিন – গঙ্গার তীরে পটনা শহরে ঘোরাঘুরি।

বৌদ্ধ স্মৃতি মন্দির।

কী দেখবেন পটনায়

(১) কুমরাহর – পর্যটন ভবন থেকে ৮ কিলোমিটার দূরে পটনা বাইপাসে। কুমরাহর, ভিকনাপাহাড়ি, বুলন্দি বাগে রাজধানী মগধের ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হয়েছে। দেখুন মৌর্য আমলের প্রাসাদ, ৮০টি স্তম্ভবিশিষ্ট অ্যাসেম্বলি হল, বৌদ্ধ মনাস্ট্রি আনন্দবিহার। খ্রিস্টপূর্ব ৬০০ থেকে ৬০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়কালের সংগ্রহ নিয়ে রয়েছে মিউজিয়াম।

(২) গান্ধী ময়দান – শহরের হৃদপিণ্ড।

(৩) গান্ধী ঘাট – বারাণসীর মতো পটনায় গঙ্গার তীরে অত ঘাট না থাকলেও, বেশ কিছু ঘাট আছে। এর মধ্যে গান্ধী ঘাট বেশ পরিচ্ছন্ন ও সুন্দর। পটনা বেড়াতে এসে এখানে কিছুক্ষণ কাটিয়ে যেতেই পারেন।

(৪) বুদ্ধ স্মৃতি মন্দির – পটনা জংশন স্টেশনের কাছে ফ্রেজার রোডে মহাবীর মন্দিরের বিপরীতে ২২ একর জমির উপর এই পার্ক। এখানে দলাই লমার রোপণ করা দু’টি বোধিবৃক্ষ রয়েছে। রয়েছে ভগবান বুদ্ধের স্ট্যাচু, ২০০ ফুট উচ্চতার পাটলিপুত্র করুণা স্তূপ।   

(৫) গোলঘর তথা কেন্দ্রীয় শস্যাগার – ১৭৭০-এর মন্বন্তরের বিভীষিকায় সন্ত্রস্ত ব্রিটিশ সরকার ফৌজের জন্য খাদ্যশস্য সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে ১৭৮৬-তে গান্ধী ময়দানের পুবে গঙ্গার তীরে গড়ে গোলঘর। এতে ১৪ লক্ষ টন খাদ্যশস্য সংরক্ষণ করা যায়। অভিনব স্থাপত্য, ধনুকাকার সিঁড়িতে ১৪৫ ধাপ উঠে উপর থেকে পটনা শহর দেখতে বেশ ভালো লাগে। দেখুন এর হুইসপারিং গ্যালারি। বিপরীতে গান্ধী সংগ্রহালয়। সন্ধ্যায় গোলঘর চত্বরে দেখে নিন লাইট অ্যান্ড সাউন্ড শো।

(৬) পটনা মিউজিয়াম – বুধমার্গে, মোগল ও রাজপুত শৈলীতে তৈরি। দেখুন বিশ্বের বৃহত্তম (১৭ মিটার) বৃক্ষ-ফসিল। মৌর্য, গুপ্ত ও কুষান যুগের স্থাপত্য, নানা মূর্তি, টেরাকোটা, মুদ্রা, ব্রোঞ্জ ও মিনিয়েচার পেন্টিং-এ সমৃদ্ধ। বোধগয়া ও নালন্দার নানা সংগ্রহও প্রদর্শিত হয়েছে।

(৭) সদাকত আশ্রম – প্রথম রাষ্ট্রপতি ড. রাজেন্দ্র প্রসাদের বসতবাটি। দানাপুর রোডের এই বাড়িতে তৈরি হয়েছে রাজেন্দ্র স্মৃতি মিউজিয়াম।

(৮) শহিদ-কি-মকবরা – জংশন স্টেশন থেকে ১০ কিমি দূরে পটনা সিটি স্টেশনের পাশে নবাব সিরাজের তৈরি সাদা-কালো পাথরে পিতার স্মারক।

হরমন্দির সাহিব তথা পটনা সাহিব।

(৯) পটনা সাহিব – পটনা ঝাউগঞ্জে দশম শিখগুরু গোবিন্দ সিং-এর জন্মস্থানে গড়ে উঠেছে শ্রী হরমন্দির সাহিব বা পটনা সাহিব। গুরুত্বে স্বর্ণমন্দিরের পরেই এর স্থান। স্থাপত্যও সুন্দর। রয়েছে গুরু গোবিন্দ সিং-এর পাদুকা, দোলনা ইত্যাদি স্মারক।

(১০) শের শাহি মসজিদ – হরমন্দির লাগোয়া দুর্গের ধ্বংসাবশেষের উপর আফগান স্থাপত্যে শের শাহ সুরির গড়া প্রাচীন মসজিদ। রাস্তা জুড়ে শের শাহের কিল্লা হাউস।

(১১) আগম কুয়া – গুলজারিবাগ স্টেশনের কাছে। সম্রাট অশোক তাঁর ছয় ভাইকে হত্যা করে এই কুয়োয় ফেলে সিংহাসনে বসেন।

চতুর্থ দিন – পটনা থেকে চলুন বৈশালী, ৬৩ কিমি। পটনার গান্ধী ময়দান বাসস্ট্যান্ড বাস ধরে চলুন বৈশালী। গাড়ি ভাড়া করেও আসতে পারেন। পটনা থেকে সক্কাল সক্কাল বেরিয়ে পড়ুন, ঘণ্টা দুয়েকে পৌঁছে যান বৈশালী। সারা দিন বৈশালীর দ্রষ্টব্য স্থানগুলি দেখে সন্ধ্যা নাগাদ ফিরুন পটনা।

অশোক পিলার, বৈশালী।

কী দেখবেন বৈশালীতে

বিশ্বের প্রথম রিপাবলিক তৈরি হয়েছিল এই বৈশালীতে। খ্রিস্টজন্মেরও ৬০০ বছর আগে। বৈশালী বুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত। তাঁর শেষ ভাষণটিও এই বৈশালীতেই দেন, গন্ধকি নদীর তীরে কলুহায়। বুদ্ধের নির্বাণের ১০০ বছর পরে দ্বিতীয় বৌদ্ধ কাউন্সিল বসেছিল এই বৈশালীতেই। এই বৈশালীকে ঘিরেই গড়ে উঠেছিল ১৩টি বৌদ্ধস্তূপ, যার মধ্যে ৬টির ধ্বংসাবশেষ স্মৃতি রোমন্থন করায়। রাজনর্তকী আম্রপালি আম্রকানন যৌতুক দেন বুদ্ধকে, বৌদ্ধধর্মে দীক্ষাও নেন এই বৈশালীতে।

(১) অশোক পিলার – শহরের কেন্দ্রস্থল ৪ কিমি দূরে কলুহায় ১৮.৩ মিটার উঁচু লাল বেলেপাথরের স্তম্ভের মাথায় ওলটানো পদ্মের উপর সিংহমূর্তি, বুদ্ধের শেষ ভাষণদানের স্মারক।

(২) বৌদ্ধস্তূপ ১। অশোক পিলারের সামনে।

(৩) অদূরে চার শতকের চতুর্মুখী মহাদেব

(৪) সামনে যেতে মিউজিয়ামের পথে বৌদ্ধস্তূপ ২। ১৯৫৮-য় এখানে খননকাজ চালিয়ে বুদ্ধের চিতাভস্ম সংবলিত পাত্র পাওয়া যায়।

(৫) মিউজিয়াম

(৬) অভিষেক পুষ্করিণী – এখানকার পবিত্র জলে পূত হয়ে বৈশালীর জনপ্রতিনিধিরা শপথ নিতেন। এর কাছেই ছিল লিচ্ছবি স্তূপ।

বিশ্ব শান্তি স্তূপ।

(৭) বিশ্ব শান্তি স্তূপ – অভিষেক পুষ্করিণীর পাড়ে।

(৮) বাওয়ান পোখর মন্দির – বাওয়ান পোখর অর্থাৎ বাহান্ন তীর্থের জল সঞ্চিত হয়েছিল ৫২টি কুণ্ডে, কালে কালে একটি পুকুর। তারই ধারে পাল আমলের মন্দির।

(৯) রাজা বিশাল কা গড় – বিশাল মাটির স্তূপ, এক কিমি পরিধি। এটাই ছিল ৭৭০৭ জনপ্রতিনিধির সংসদ ভবন।

(১০) অদূরেই হরিকাটোরা মন্দিরে রাম-লক্ষ্মণ-সীতা।

পঞ্চম দিন – ঘরপানে ফেরা। পটনা-হাওড়া জনশতাব্দী এক্সপ্রেস পটনা থেকে ছাড়ে ভোর সাড়ে ৫টায়, হাওড়ায় পৌঁছোয় দুপুর ১.২৫-এ।

কোথায় থাকবেন

পটনায় রয়েছে বিহার রাজ্য পর্যটন উন্নয়ন নিগমের হোটেল কৌটিল্য বিহার। অনলাইন বুকিং: http://bstdc.bihar.gov.in/। যোগাযোগ করতে পারেন বিহার পর্যটনের কলকাতা অফিসেো। ঠিকানা- ২৬বি, ক্যামাক স্ট্রিট, দূরভাষ- ২২৮০৩৩০৪। অনেক বেসরকারি হোটেল রয়েছে। যোগাযোগ করুন Travelism (ট্রাভেলিজম)-এর সঙ্গে। ফোন: 8276008189

কী ভাবে ঘুরবেন 

(১) পটনা শহরের দ্রষ্টব্য দেখে নিন অটো বা গাড়ি ভাড়া করে।

(২) বৈশালীতে ট্যুরিস্ট রেস্ট হাউসের ডাইনে-বাঁয়ে এক কিমির মধ্যে প্রায় সব দ্রষ্টব্যস্থান, অশোক পিলার ৪ কিমি বামে। অটো রিকশায় চেপে ঘুরে নিতে পারেন বৈশালী।

(৩) পটনা থেকে গাড়ি ভাড়া করে এলে তাতেই ঘুরে নিতে পারেন বৈশালী।

গঙ্গার ধারে গান্ধী ঘাট, পটনা।

মনে রাখবেন

(১) কুমরাহরের মিউজিয়াম সোমবার ছাড়া সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত খোলা।

(২) পটনা মিউজিয়াম সোমবার ছাড়া সকাল সাড়ে ১০টা থেকে বিকেল সাড়ে ৪টে পর্যন্ত খোলা।

(৩) পটনায় সদাকত আশ্রম সোমবার ছাড়া অন্যান্য দিন খোলা। দুপুরের দিকে ঘণ্টা দুই-তিন বন্ধ থাকে। গ্রীষ্ম আর শীতে খোলার সময় কিঞ্চিৎ আলাদা। আগেভাগে জেনে নেবেন।

(৪) ট্রেনের সময় পালটাতে পারে। অবশ্যই দেখে নেবেন erail.in।

আরও পড়তে পারেন

পুজোয় অদূরে ৫ / দেওঘর-মধুপুর-গিরিডি

পুজোয় অদূরে ৪ / শিমুলতলা

পুজোয় অদূরে ৩ / রাঁচি-নেতারহাট-বেতলা

পুজোয় অদূরে ২ / রাঁচি-ম্যাকলাস্কিগঞ্জ

পুজোয় অদূরে ১ / ঘাটশিলা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *