সুদীপ মাইতি
এখানে রয়েছে দিগন্তবিস্তৃত গঙ্গা। এক পারে বাংলা। অন্য পারে ঝাড়খণ্ড। যেতে চাইলে ছোটো ছোটো গাড়ি তো বটেই, কুড়ি চাকা পণ্যভর্তি লরির সঙ্গে ভেসেলে ভেসে যেতে পারেন ও পারের রাজমহল ঘাটে। পাশেই গঙ্গার বুকে রয়েছে একটি আস্ত দ্বীপ। নাম ভুতনি বা ভুতনির চর। আবার এক জায়গায় এই ফুঁসে ওঠা গঙ্গার দুই পারে রয়েছে এই বাংলার দুই জেলা। আবার এই অঞ্চল থেকে অনায়াসে আপনি সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশেও চলে যেতে পারেন। তবে পাসপোর্ট, ভিসা না থাকলে ও পারের রাজশাহী জেলাকে মহতীপুর সীমান্তে দাঁড়িয়ে চাক্ষুস করতে অসুবিধা নেই। এ সব ছাড়া আপনি এখানে পেয়ে যাবেন অতীতের বাংলার দু-দুটো রাজধানী, একটি গৌড় অন্যটি পাণ্ডুয়া। এর সঙ্গে পেয়ে যাবেন পাল, সেন ও তার পরের মোঘল সাম্রাজ্যের স্থাপত্যের খুবই আকর্ষণীয় সব নিদর্শন। এখানেই পেয়ে যাবেন চৈতন্যদেবের আগমনভূমি। আবার নদীমাতৃক এই এলাকার বুক চিরে চলে গেছে মহানন্দা ও কালিন্দি নদী।
কি, কিছু চেনা যাচ্ছে তো? আচ্ছা একটা পুরোনো চেনা সিনেমা ‘শত্রু’র একটি দৃশ্যের কথা মনে করাই। চারিদিকে ঘন ঘন আমগাছ। বিঘের পর বিঘে জুড়ে। তার মাঝে দাঁড়িয়ে ছোট্টুর সেই কাতর আবেদন, “ও পুলিশ, ও পুলিশ, তুমি আমার বাবাকে ছাড়লে না কেন? তোমাকে পেয়ারা দিলাম। তবুও তুমি বাবাকে ছাড়লে না?”
আরও পড়ুন বর্ষায় চলুন মুম্বই থেকে শনি শিংনাপুর-শিরডি-নাসিক
এতক্ষণে সবাই নিশ্চয় বুঝে গেছেন কোন এলাকার কথা বলতে চাইছি। হ্যাঁ, দেশ, বিদেশ, ঐতিহাসিক স্থাপত্য, ফুঁসে ওঠা আবার মজে যাওয়া নদী, ফজলি-সহ রকমারি আমের উৎপত্তিস্থল এই মালদা জেলা। হাতে তিন থেকে চার দিন যদি বের করতে পারেন তবে চলুন যাই ঐতিহাসিক মালদা জেলায়।
আমরা প্রথম দিন শুরু করেছিলাম জহুরী কালীমন্দির দর্শনের মধ্য দিয়ে। সকলের বিশ্বাস, এই কালী খুবই জাগ্রত। কথিত আছে, ডাকাতরা তাদের ডাকাতি করা জহর এনে এই বিগ্রহের নীচে পুঁতে রাখত। সেই থেকে এর নাম জহুরী কালীমন্দির। মালদা শহর থেকে পাঁচ কিমি দূরে। এই মন্দিরে কোনো কালী প্রতিমা নেই। আছে মাটির স্তূপের বিগ্রহ। এখানে প্রায়ই পাঁঠাবলি হয়। আর বৈশাখ মাসে এক মাসব্যাপী বিরাট মেলা বসে।
এর পরের গন্তব্য গৌড়। এককালে বাংলার রাজধানী। অধুনা ধংসপ্রাপ্ত একটি নগর। মালদা শহর থেকে ১২ কিমি দূরে। পাল সাম্রাজ্য থেকে সেন সাম্রাজ্য হয়ে মোগলদের হাতে পড়লেও গৌড় বাংলার রাজধানী থেকে যায় কয়েক শতক। মাঝে রাজধানী মালদারই পাণ্ডুয়াতে স্থানান্তরিত হলেও পরে আবার ফিরে আসে। গৌড়ের প্রবেশ পথে ষাট ফুট উঁচু একটি দরজা আপনাকে অভিবাদন জানাবে। সে কালের রাজপুরুষ ও সুলতানরা সওয়ারি-সহ হাতিতে চড়ে এই দরজা দিয়ে প্রবেশ করতেন। আর তখন তোপধ্বনি করে তাদের সম্মান প্রদর্শন করা হত। তাই এর নাম সালামি দরওয়াজা তথা দাখিল দরওয়াজা। কল্পনায় ডুবে গেলে আপনি নিশ্চিত রোমাঞ্চিত বোধ করবেন।
এর পর আপনি পেয়ে যাবেন বারোদুয়ারী বা বড়োসোনা মসজিদ, লোটন মসজিদ- সহ গৌড় দুর্গে প্রবেশের আরও একটি দরজা। এটি ৬৫ ফুট উঁচু ও ৪২ ফুট চওড়া। আর দু’ পাশে ছিল প্রহরীদের ঘর এবং ওপরে ছিল নহবতখানা। এটি লুকোচুরি দরওয়াজা নামে পরিচিত।
আরও রয়েছে কদম রসুল মসজিদ ও চিকা মসজিদ। কদম অর্থ পদ আর রসুল হচ্ছেন পয়গম্বর। কথিত আছে, এই মসজিদে রয়েছে হজরত মহম্মদের যুগল পদচিহ্ন। আর চিকা মসজিদ নাকি একটি কয়েদখানা। চিকা অর্থাৎ বাদুড়দের বাস ছিল এখানে, তাই নাম চিকা মসজিদ।
ধ্বংসাবশেষ হলেও গৌড়ের স্থাপত্যগুলি দেখলে আপনাকে ইতিহাস টানবেই। এখানে সে সব দিনে নদীপথে জাহাজও এসে নোঙর করত। তাই আপনি এখানে জাহাজঘাটও দেখতে পাবেন।
এখানে আরও একটি দ্রষ্টব্য হল শ্রীচৈতন্যদেবের আগমনস্থল, রামকেলি। কথিত আছে, ১৫০৬ বঙ্গাব্দের জ্যৈষ্ঠ সংক্রান্তিতে বৃন্দাবন যাওয়ার পথে শ্রীচৈতন্য এখানে আসেন। তখন গৌড়ের সুলতান আলাউদ্দীন হোসেন শাহ। এখানেই শ্রীচৈতন্যের সান্নিধ্যে আসেন হোসেন শাহের দুই মন্ত্রী সাকর মল্লিক আর দবীর খান। এখানকার তমালতলে দীক্ষা নেওয়ার পর তাঁদের নাম হয় রূপ গোস্বামী ও সনাতন গোস্বামী। শ্রীচৈতন্যের সেই আগমনকে স্মরণ করে এখানে জ্যৈষ্ঠ সংক্রান্তিতে বিরাট মেলা বসে, যা রামকেলি মেলা নামে বিখ্যাত। আষাঢ় মাসের প্রথম দিন থেকে চারদিন ধরে এই মেলা বসে।
এখান থেকে চলুন মহতীপুরে, বাংলাদেশ সীমান্ত। গৌড় থেকে চার-পাঁচ কিমি দূরে অবস্থিত এই সীমান্ত এলাকা। ও পারে বাংলাদেশের রাজশাহী জেলা। তাই এটাকে মালদা-রাজশাহী পথ বলে। মহতীপুর সীমান্তে উঁচু প্রাচীরের ওপর থেকে বাংলাদেশ দেখতে আপনি নিশ্চিত রোমাঞ্চিত হবেন। দেখবেন পায়ে হাঁটা মানুষ এ-দিক থেকে ও-দিকে কিংবা ও-দিক থেকে এ-দিকে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দেখিয়ে নিশ্চিন্তে যাতায়াত করছে। পাশাপাশি যেন আপন মনে চলেছে বড়ো বড়ো মালবাহী লরি।
এ সব দেখতে দেখতে কখন যে দুপুর গড়িয়েছে বুঝতে পারিনি। তাই মালদা শহরে না ফিরে চলে গেলাম ফরাক্কায়। গঙ্গার ও পারে মুর্শিদাবাদ। ও পারে গেলেই দেখতে পাবেন গঙ্গা থেকে বেরিয়ে গেছে ফিডার ক্যানেল, ভাগীরথীর জল বাড়ানোর জন্য। যা কিছু দূর গিয়ে ভাগীরথীর সঙ্গে মিশে গেছে। বিশাল গঙ্গার পাশ দিয়ে গেলেই দেখতে পাবেন কী ভাবে গঙ্গায় চর জেগে উঠেছে। আর অতীতে গঙ্গায় যে বড়ো বড়ো জাহাজ আসত তার নিদর্শন হিসাবে নদী এবং নদীতীরে ছড়িয়ে রয়েছে পুরোনো আমলের জাহাজের ধ্বংসাবশেষ। আর বিকেলের রৌদ্রছায়ায় বিশাল গঙ্গার তীর আপনাকে বেশ কিছুক্ষণ আটকে রাখবেই। এর পরে ফেরা মালদা শহরে। পাড়ি দিতে হবে প্রায় ৪০ কিমি। (চলবে)
কী ভাবে যাবেন
হাওড়া এবং শিয়ালদহ থেকে উত্তরবঙ্গগামী যে কোনো ট্রেনে চাপলেই আপনি আট দশ ঘণ্টায় পৌঁছে যাবেন মালদায়। আর দুপুর ২-১৫ মিনিটের শতাব্দী এক্সপ্রেসে চেপে বসলে লাঞ্চ ও সান্ধ্য টিফিন সহযোগে আপনি মালদায় পৌঁছে যাবেন সন্ধ্যা ৭-১৫ মিনিট নাগাদ। কলকাতা থেকে বাস পাবেন। দেখুন www.redbus.in । সরাসরি গাড়ি নিয়ে চলে যেতে পারেন, কলকাতা থেকে দূরত্ব ৩২৬ কিমি, পথ বর্ধমান-ভাতার-খরগ্রাম-মোরগ্রাম-ফরাক্কা হয়ে।
কোথায় থাকবেন
মালদা শহরে প্রচুর হোটেল রয়েছে। আপনার পছন্দ মতো কোনো একটিতে আপনি থাকতেই পারেন। সন্ধান পাবেন www.booking.com , www.makemytrip.com , www.yatra.com , www.trivago.in , www.airbnb.co.in , www.tripsavvy.com ইত্যাদি ওয়েবসাইট থেকে। এ ছাড়াও সরকারি ব্যবস্থাপনায় আছে মালদা ট্যুরিস্ট লজ। অনলাইন বুকিং – www.wbtdcl.com ।
ছবি লেখক