মুকুট তপাদার
শীত তো শেষ। প্রকৃতির হাওয়ায় লেগেছে বসন্ত। গরমের সংকেত ফুটে উঠেছে। এই সময় সব ছাড়িয়ে দূরে চলে যেতে ইচ্ছে করে।
শহরের ইট-কাঠের আধুনিক কর্কশ শব্দের মধ্যে মন অবরুদ্ধ। সপ্তাহশেষে ঘুরতে চলে আসুন, রূপনারায়ণ-তীরের এক ঐতিহাসিক ক্ষেত্রে। পুরাকালের বন্দরনগর তাম্রলিপ্ত তথা তমলুকে।
যদি মনে করেন এই বন্দরনগরের উদ্ভব হল কী ভাবে তা হলে ফিরে যেতে হবে মহাভারতের কালে। যদিও এই নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে নানা মতবিরোধ আছে। দ্রৌপদীর স্বয়ংবরসভায় তাম্রলিপ্তের রাজা উপস্থিত ছিলেন। তাম্রলিপ্তের ময়ূর বংশীয় রাজা ছিলেন ময়ূরধ্বজ। তাঁর পুত্র ছিলেন তাম্রধ্বজ। এর পর বলতেই হয় যে ভারতবর্ষে বৌদ্ধপ্রধান জায়গাগুলোর মধ্যে তাম্রলিপ্তের গুরুত্ব কিছু কম নয়।
রাম তিনটি তীর নিক্ষেপ করছে। টেরাকোটা অলংকরণের চিত্র।
অতীতে এই জায়গাটি ছিল পূর্ব ভারতের একমাত্র বন্দর। কলিঙ্গরাজ অশোক তাম্রলিপ্ত বন্দরে এসেছিলেন। বৌদ্ধধর্ম প্রচারের জন্য অশোকের প্রেরিত দূতেরা এই বন্দর দিয়ে সিংহল যাতায়াত করেছেন। ফা হিয়েন এই বন্দরে একাধিক বৌদ্ধমঠ দেখেন। দেশ-বিদেশ থেকে বহু পরিব্রাজক এখানে এসেছেন বৌদ্ধশাস্ত্রে শিক্ষিত হতে।
রূপনারায়ণ নদীর পাড়ে আজকের তমলুক ছিল সে কালের তাম্রলিপ্ত নগর। এই জায়গায় মাটির নীচ থেকে বহু প্রত্নসামগ্রী খুঁজে পাওয়া যায়। বিভিন্ন মৃৎপাত্র, দেবদেবীর মূর্তি, পোড়ামাটির মূর্তি ইত্যাদি মাটি খুঁড়ে পাওয়া গিয়েছে।
তাম্রলিপ্তে পাল যুগের সময়কার একটি মন্দিরের গায়ে রাম সীতা।
পাল যুগে ভারতীয় শিল্পরীতি এক আলাদা উচ্চতায় পৌঁছোয়। তাম্রলিপ্তে একাধিক বৌদ্ধ মঠ ছিল। অনুমান করা হয় যে প্রাচীন মঠগুলি বহু সময় বিভিন্ন আক্রমণের ফলে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। সেই জায়গায় বিভিন্ন মন্দির নির্মাণ করা হয়। তার ছায়াও লক্ষ করা গেছে। বৌদ্ধ মঠগুলির আশেপাশে মন্দির নির্মিত হয়েছে। এর পরবর্তীতে পাল যুগে সেই সব মন্দিরের দেওয়ালে কারুকার্যে বিভিন্ন মূর্তি নির্মিত হয়। আজও তাম্রলিপ্তের বহু মন্দিরের গায়ে কারুকার্যে সেই সময়কার দেবমূর্তি দেখা যায়। এমনকি তমলুক ও তার আশপাশের গ্রাম থেকে বেশ কয়েকটি পাথরের মূর্তি পাওয়া যায়। সেগুলি পাল যুগের বিষ্ণুর মূর্তি বলে অনুমান করা হয়।
নবম, দশম, একাদশ ও দ্বাদশ শতকের মূর্তি তমলুকের কিছু মন্দিরে আজও পুজো করা হয়। ঐতিহাসিকরা দাবি করেন যে হরির বাজারে কৃষ্ণ ও বলরামের মন্দিরে বহু প্রাচীন দুটি মূর্তি পাল যুগের সময়কার।
তাম্রলিপ্তের প্রাচীন একটি মন্দিরের দেয়ালে অলংকরণ।
‘সেই সত্য যা রচিবে তুমি, ঘটে যা তা সব সত্য নয়’।
বহু কাহিনি দীর্ঘকাল ধরে সত্য হয়ে আছে সাধারণ লোকসমাজে। যার ঐতিহাসিক তথ্য সব সময় পাওয়া যায় না।
সন্ধ্যাকর নন্দী পাল যুগের একজন বিখ্যাত কবি। তিনি মদন পালের সভাকবি ছিলেন। দ্বিতীয় মহীপালের ঘটনা লিপিবদ্ধ করে যান তাঁর রামচরিত সাহিত্যকর্মে। তা ছাড়া শ্রীরামচন্দ্রের পৌরাণিক ঘটনাও লিখেছিলেন। ধরে নেওয়া যায় ওই সময় বাংলার কারিগররা মন্দিরনির্মাণে রামায়ণ ও কৃষ্ণের পৌরাণিক কাহিনি শিল্পকর্মে ফুটিয়ে তুলেছিলেন, যা পরবর্তীতে টেরাকোটা শিল্পে ব্যাপক ভাবে প্রচলিত হয়েছিল। এই সময় রামের বিগ্রহ লোকসমাজে পূজিত হতে থাকে।
রূপনারায়ণের তীরে শান্ত স্নিগ্ধ পরিবেশে তাম্রলিপ্তর ইতিহাস অন্তরকে অতি গভীর ভাবে স্পর্শ করে। সে যেন অতীতের একটি জ্যান্ত ছবি!
তথ্যসূত্র: ত্রৈলোক্যনাথ রক্ষিত, বিনয় ঘোষ