ভ্রমণ অনলাইন ডেস্ক: কোজাগরী পূর্ণিমায় লক্ষ্মীর আরাধনা করার পরেই তোড়জোড় শুরু হয়ে গিয়েছে কালীপুজোর। দীপান্বিতা অমাবস্যা আর এক পক্ষ কালও নেই। সেই অমাবস্যায় এই বাংলার বহু বনেদি বাড়িতে ধুমধাম করে কালীপুজো হয়। প্রস্তুতি চলছে তার। চলুন আজ যাওয়া যাক পশ্চিম মেদিনীপুরের খেপুত গ্রামে। দেখে আসি সাবর্ণদের কালীপুজো।
মেদিনীপুর (অধুনা পশ্চিম মেদিনীপুর) জেলার চেতুয়া অঞ্চলের জমিদারি লাভ করে সাবর্ণ গোত্রীয় রামদুলাল রায় চৌধুরী ১৭৭২ খ্রিস্টাব্দে বড়িশা থেকে চলে যান রূপনারায়ণ নদের পশ্চিম তীরে খেপুত উত্তরবাড় গ্রামে। বর্ধমান রাজপরিবারের রাজা তেজশ্চন্দ্র বা তেজচাঁদের খুবই ঘনিষ্ঠ ছিলেন রামদুলাল রায় চৌধুরী। সে সময় মেদিনীপুরের চেতুয়া ও বরদা পরগনা রাজা তেজচাঁদের জমিদারির অন্তর্ভুক্ত ছিল। ওই দুই পরগনার জন্য ছোটো জমিদারের খোঁজ করছিলেন তেজচাঁদ, যাতে নিয়মিত রাজস্ব আদায় করা যায়। তেজচাঁদের মনে পড়ে যায় রামদুলালের কথা। তাঁকেই ওই অঞ্চলের জমিদারি দেন রাজা তেজচাঁদ।
রামদুলাল রায় চৌধুরী চেতুয়ার জমিদারি পেয়ে খেপুত উত্তরবাড় মৌজায় বাসস্থান তৈরি করেন। মাটির ঠাকুরঘর নির্মাণ করেন। সেই সঙ্গে রঘুনাথজিউকেও তাঁরা খেপুতের বাড়িতে নিয়ে যান। উত্তরবাড়ের প্রাচীন বিগ্রহ শ্রীশ্রীমা খেপতেশ্বরী অষ্টভুজা মহিষমর্দিনী। দক্ষিণমুখী আটচালা মন্দির। মন্দিরের দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ যথাক্রমে ২৪ ফুট ১০ইঞ্চি এবং ২৩ ফুট ৬ইঞ্চি।
সম্ভবত ১৭৯৮ খ্রিস্টাব্দে কার্তিক মাসের অমাবস্যা তিথিতে রামদুলাল তাঁর খেপুতের বাড়িতে কালীপুজো শুরু করেন। বিজয়াদশমীর দিন রামদুলাল আমিষ ভোগ দিয়ে দেবীর তৃণমূর্তির পায়ে মাটি লেপন করেন। ওই দিন বিশেষ নিয়মে পুকুর থেকে মাটি তোলা হয়। পরের দিন থেকেই শুরু হয় কালীপ্রতিমা তৈরির কাজ। নিয়ম মেনে পারিবারিক আটচালায় তৈরি হয় প্রতিমা। অর্থাৎ বড়িশাবাড়ির দুর্গাপুজো শেষ হতেই খেপুতবাড়ির কালীপুজো শুরু হয়। সাবর্ণদের কালীপুজোর সঙ্গে গোড়া থেকে যে সব সূত্রধর, নরসুন্দর, কর্মকার, কুম্ভকার, মালাকার ও গো-পালক পরিবার জড়িত ছিলেন, তাঁরা বংশানুক্রমিক ভাবে আজও এই পুজোর সঙ্গে জড়িয়ে আছেন।
কালীঘাটের দেবী কালিকা হলেন সাবর্ণদের ইষ্টদেবী। তাঁর অনুকরণেই খেপুতের দেবীর নাসিকায় রয়েছে রসকলি, বৈষ্ণবী তিলক। দেবী দীঘলনয়না, গলায় নরমুণ্ডমালা। চতুর্হস্তা ভদ্রকালীরূপ। ভীষণা মূর্তির মধ্যেই স্নেহময়ী বরদাতৃ মাতৃরূপ। দেবীর বাঁয়ে শৃগাল ও ডাকিনী আর ডাইনে যোগিনী।
পুজোর দিন ঘট তোলার আগে প্রথমে মাটির হাঁড়িতে জল ভর্তি করা হয়। সেই হাঁড়ি রাখা হয় আটচালাতেই। জলের হাঁড়িতে প্রদীপ ভাসিয়ে দেওয়া হয়। প্রদীপে থাকে ছোটো ছোটো ছিদ্র। ওই ছিদ্র দিয়ে জল-ঢুকে প্রদীপ পূর্ণ হলে তা ডুবে যায়। প্রদীপ ডোবা মাত্রই পরিবারের এক পুকুরেই ঘট ডুবিয়ে পুজো শুরু হয়।
মা কালীর আমিষ ভোগে সব রকম সবজি দেওয়া হয়। অন্নভোগ, খিচুড়িভোগ, ডাল, ভাজা, পায়েস, নানা রকমের তরকারি ইত্যাদি নিবেদন করা হয়। মহাকালের জন্য আতপচালের নিরামিষ ভোগ হয়। সাবর্ণ পরিবারে কালীপুজোয় বলিদানের সময়ে ঢাক-ঢোল-কাঁসরের আওয়াজে পাড়া মুখরিত হয়। কালীপুজো উপলক্ষ্যে বাড়ির মেয়েরা বাজি প্রদর্শনীতে মেতে ওঠেন ও বিশেষ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যোগ দেন।
দীপান্বিতা কালীপুজোর দিন কুলো বাজিয়ে চালগুঁড়ি আর গোবরের তৈরি অলক্ষ্মী মূর্তি বিদায় করে লক্ষ্মীপুজোর রীতিও প্রচলন করেছিলেন রামদুলাল। তবে এই লক্ষ্মীপুজো দেবালয়ে না করে গৃহকোণে অনুষ্ঠিত হয়।
এই ভাবে ঐতিহ্য ও পরম্পরাকে অক্ষুণ্ণ রেখেই প্রাচীন রীতি মেনে পুজো হয়ে আসছে পশ্চিম মেদিনীপুরের খেপুত গ্রামে সাবর্ণ পরিবারে। ডাকের সাজে সজ্জিত এই প্রাচীন করালবদনা কালী আজও খেপুত-সহ গোটা মেদিনীপুর অঞ্চলের মানুষের কাছে খুবই জনপ্রিয়।
কী ভাবে যাবেন
কলকাতা থেকে রূপনারায়ণ নদের পশ্চিমপারের খেপুত গ্রামের দূরত্ব ৮৬ কিমি। সরাসরি গাড়িতে চলে যেতে পারেন। পথ বোম্বে রোড (জাতীয় সড়ক ১৬, পূর্বতন ৬) হয়ে কোলাঘাট। সেখান থেকে খেপুত। সরাসরি গাড়িতে চলে যেতে পারেন।
ট্রেনেও যেতে পারেন। হাওড়া-খড়গপুর লাইনে লোকাল ট্রেনে কোলাঘাট গিয়ে সেখান থেকে বাসে বা গাড়িতে খেপুত চলে যেতে পারেন।
আরও পড়তে পারেন
দীর্ঘ ৬০ বছর পর ভ্রামণিকদের জন্য খুলল ট্রান্স ভুটান ট্রেল
ভগবানের আপন দেশে ৭ / ঘুরে এলাম টপ স্টেশন
কাশ্মীর-কেরলের অভিজ্ঞতা পশ্চিমবঙ্গেও, রাত্রিবাস করুন হাউসবোটে